নতুন বাংলাদেশ গড়ার শপথ নিয়ে যাত্রা শুরু করেছে গণঅভ্যুত্থান থেকে সৃষ্টি হওয়া নতুন দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। রাজনীতিতে এখন আলোচনার কেন্দ্রে রয়েছে দলটি। এবার নিজেদের শক্তিমত্তা দেখানো ও নির্বাচনের মাঠে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা দেখানোর চ্যালেঞ্জ তাদের সামনে। আর রমজান মাস থেকেই সে পথে হাঁটার পরিকল্পনা আঁকছেন দলটির নীতিনির্ধারকরা। নিজেদের সাংগঠনিক ভিত্তি মজবুত করতে শিগগির জেলা উপজেলায় কমিটি গঠনের কাজও শুরু করবেন তারা। যার বড় অংশজুড়ে থাকবেন নাগরিক কমিটিরই সদস্যরা।
গত শুক্রবার মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে জাতীয় সংসদ ভবনের সামনের সড়কে তৈরি মঞ্চ থেকে নতুন দলের আনুষ্ঠানিক আত্মপ্রকাশ ও কমিটি ঘোষণা দেওয়া হয়। এর পর থেকেই এ দলকে ঘিরে আলোচনা চলছে। বিশেষ করে আগামী নির্বাচন ঘিরে এরই মধ্যে শুরু হয়েছে জল্পনা-কল্পনা। চলতি সপ্তাহে দলের বাকি কাজগুলো তথা গঠনতন্ত্র পূর্ণাঙ্গ করা, মূলনীতি, স্লোগান, পূর্ণাঙ্গ কমিটি প্রকাশসহ অন্যান্য কাজগুলো শেষ করতে এরই মধ্যে কাজ শুরু করেছেন শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা।
জাতীয় নাগরিক পার্টির কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, রমজান মাস জুড়ে ঢাকা এবং সারা দেশে ইফতার পার্টির মাধ্যমে নিজেদের জানান দেবেন তারা। বিশেষ করে ঢাকায় প্রথমবারের মতো বৃহৎ পরিসরে ‘ইফতার রাজনীতি’ করার চিন্তা তাদের। আগামী সপ্তাহ থেকে শুরু হতে পারে জেলা, উপজেলা পর্যায়ে কমিটি গঠনের কাজও। এ ক্ষেত্রে জাতীয় নাগরিক কমিটির ৪০০ এর অধিক থানা কমিটি থাকায় তাদের কাজটি সহজ হবে বলে মনে করেন নেতারা। সেখানের বড় একটি অংশ সরাসরি এনসিপিতে যোগ দেবেন।
জাতীয় নাগরিক পার্টির যুগ্ম সদস্য সচিব আব্দুল্লাহ আল আমিন কালবেলাকে বলেন, রমজান মাসে আমরা সাংগঠনিক বিস্তৃতি এবং ইফতারকেন্দ্রিক প্রোগ্রাম তৃণমূলে ছড়িয়ে দিতে চায়। এর মধ্য দিয়ে সারাদেশে আমাদের সংগঠনকে পরিচিত এবং বিস্তৃত করতে চাই। আমাদের জন্য কমিটি করা জটিল হবে না। নাগরিক কমিটি থেকে কারা আসতে চায় এবং কাদের আমরা আনতে চাই তাদের নিয়েই মূলত কমিটি হবে। আশা করি মার্চের মধ্যে আমরা সব প্রস্তুতি নিয়ে নিতে পারব।
কেন্দ্রীয় যুগ্ম মুখ্য সংগঠক আবু সাঈদ লিয়ন কালবেলাকে বলেন, দেশের যে রাজনৈতিক শূন্যতা এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা দূর করতে নাগরিকদের চাহিদার কারণে আমরা দ্রুত রাজনীতির মাঠে নেমেছি এবং দল গঠন করেছি। মানুষের যে চাহিদা তা পূরণ করতে আমরা রমজান মাস থেকেই মাঠে যাব। সারা দেশে মানুষের মাঝে জাগরণ তৈরি করব। এখন থেকে একজন কৃষকের সন্তানও এমপি হবে, মন্ত্রী হবে, প্রধানমন্ত্রী হওয়ার স্বপ্ন দেখবে। মানুষের অধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার যে বার্তা সেটি আমরা বাংলাদেশের প্রতিটি ঘরে ঘরে পৌঁছে দিতে আমরা শিগগির মাঠে নামব। মানুষকে পুরোপুরি রাজনৈতিকভাবে স্বাধীন করাটাই আমাদের মূল চ্যালেঞ্জ। আমাদের পূর্ণাঙ্গ কমিটি আজ বা কালকের মধ্যে প্রকাশিত হয়ে যাবে।
যুগ্ম সদস্য সচিব মশিউর রহমান কালবেলাকে বলেন, নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত করার জন্য আমরা কাজ করে যাচ্ছি। লক্ষাধিক মানুষ আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছে। জাতীয় নাগরিক কমিটি এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সদস্যদের বাইরেও অনেকে স্বেচ্ছায় পার্টির রাজনীতি করতে আসবেন এবং এরই মধ্যে মানুষ সে আগ্রহ প্রকাশ করছেন। আমরা মনে করি, আগামী নির্বাচন হবে বিএনপি বনাম এনসিপি। ভোটের মাঠে মনস্তাত্ত্বিক লড়াই শুরু হয়ে গেছে। যেখানে তরুণদের নেতৃত্ব দিচ্ছে নাগরিক পার্টি। বাংলাদেশের সব সচেতন মানুষ আশা করি তরুণদের সঙ্গে থাকবে।
জেলা-উপজেলায় কমিটির বিষয়ে মশিউর বলেন, আমরা আশা করি এই সপ্তাহের মধ্যেই জেলা-উপজেলা পর্যায়ে কমিটি গঠনের কাজ শুরু করতে পারব। এক থেকে দুই মাসের মধ্যে আমরা ৬৪ জেলায় কমিটি গঠন করতে পারব। এটি আমাদের জন্য কঠিন নয়।
কেন্দ্রীয় জ্যেষ্ঠ আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব কালবেলাকে বলেন, সাংগঠনিক ভিত্তি শক্ত করার জন্য আমাদের কাজ চলমান আছে। এখন আমাদের মূল কাজ হচ্ছে মূলনীতি গঠনতন্ত্রসহ অন্য বিষয়গুলো ঠিক করা। কেন্দ্রীয় পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনের পর সভার মাধ্যমে পরবর্তী কর্মসূচির বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। আমাদের লড়াইটা হচ্ছে বিদ্যমান রাজনৈতিক সংস্কৃতি পরিবর্তনের। সে পরিবর্তনের জন্য আমরা কাজ করব।
নাগরিক কমিটির বিষয়ে মুখপাত্র ও পার্টির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক সামান্তা শারমিন বলেন, নতুন দল আত্মপ্রকাশের মাধ্যমে জানাকের রাজনৈতিক দল গঠনের ঐতিহাসিক দায়িত্ব সম্পন্ন হয়েছে। দল গঠনের পর থেকে জানাক সিভিল-পলিটিক্যাল প্ল্যাটফর্ম হিসেবে থেকে যাবে। আর কোনো দল গঠনের উদ্যোগ নেবে না।
এদিকে রায়েরবাজারে গণঅভ্যুত্থানের শহীদদের কবর জিয়ারত ও ফুলেল শ্রদ্ধা নিবেদনের মধ্য দিয়ে নাগরিক পার্টির ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের সাংগঠনিক কার্যক্রম শুরু হয়েছে। গতকাল শনিবার দুপুরে সংগঠনের নেতারা রায়েরবাজার কবরস্থানে গিয়ে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এসময় বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ আহ্বায়ক (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়) আব্দুল কাদের বলেন, যে উদ্দেশ্য জুলাই আগস্টে ছাত্র জনতা জীবন দিয়েছে সেই উদ্দেশ্য বাস্তবায়নই নতুন সংগঠনের মূল লক্ষ্য।
বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের সদস্য সচিব জাহিদ আহসান জানান, লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতি বন্ধ করাসহ যে কোনো ধরনের অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ।
এ ছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র রাজনীতি করে এমন ডান-বাম মিলিয়ে ৯টি ছাত্র সংগঠনকে সঙ্গে নিয়ে পরিচিতি সভা করেছে নতুন এই ছাত্র সংগঠন। শনিবার বিকেল সাড়ে ৫টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে এ সভার আয়োজন করে সংগঠনটি। সভায় উপস্থিত ছিলেন সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের (মার্ক্সবাদী) সভাপতি সালমান সিদ্দিকী, ইসলামী ছাত্র আন্দোলন ঢাবি শাখার সভাপতি ইয়াসিন আরাফাত, বাংলাদেশ ছাত্রপক্ষের ঢাবি শাখার আহ্বায়ক খালিদ সাইফুল্লাহ জিহাদ, বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক সৈকত আরিফ, স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংসদের আহ্বায়ক জামাল উদ্দিন খালিদ, ইসলামী ছাত্রশিবিরের ঢাবি শাখার সাধারণ সম্পাদক মহিউদ্দিন খান, বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রীর সাধারণ সম্পাদক জাবির আহমেদ জুবেল, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি মেঘমল্লার বসু, বাংলাদেশ জাতীয়বাদী ছাত্রদলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মানসুরা আলমসহ অনেকে।
সভায় বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের কেন্দ্রীয় আহ্বায়ক আবু বাকের মজুমদার বলেন, ‘জুলাইয়ে আমরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করেছি। জুলাইয়ের পর এখনো আমরা সহাবস্থানের রাজনীতির চর্চা করছি। আশা করি সহাবস্থানের এ ধারা বিরাজমান থাকবে। বাংলাদেশের প্রশ্নে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ রাখার চেষ্টা করব।’
তিনি আরও বলেন, ‘জুলাই অভ্যুত্থানে ৯ দফার সপ্তম দফায় লেজুড়বৃত্তির বিরোধিতা করেছি। আমরা সামনেও লেজুড়বৃত্তির বিপক্ষে থাকব। ডাকসু এবং সব ছাত্র সংসদ অতিদ্রুত বাস্তবায়ন হওয়া চাই। এক্ষেত্রে সবাই মিলে বসে এটি দ্রুত বাস্তবায়নের চেষ্টা করা প্রয়োজন।’
মন্তব্য করুন