নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আত্মপ্রকাশের রাজনীতি থেকে কূটনীতি, শহর থেকে গ্রাম, পাড়া-মহল্লা সর্বত্রই চলছে আলোচনা। সাধারণ মানুষ ও বিশিষ্টজন বলছেন, গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতন ও আওয়ামী লীগের নিষ্ক্রিয়তায় এনসিপির আবির্ভাব সময়োপযোগী। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের অগ্রভাগে থাকা একদল উদ্যমী তরুণ-তরুণীর নেতৃত্বে গঠিত এনসিপির কাছে সবার প্রত্যাশা অনেক। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নতুন দলটি দেশের গতানুগতিক রাজনীতির ধারা থেকে বেরিয়ে ভিন্ন আঙ্গিকে নিজেদের জনগণের সামনে তুলে ধরবে—এটাই প্রত্যাশা। গ্রহণযোগ্য কর্মসূচির মাধ্যমে জনসম্পৃক্ততা বাড়াবে দলটি। নতুন দলের কাছে সবাই নতুন রাজনীতিই প্রত্যাশা করছে।
তবে এনসিপির সামনে পাহাড়সমান চ্যালেঞ্জও রয়েছে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে অতীতে অনেক রাজনৈতিক দল গঠিত হয়েছে। তার মধ্যে কোনোটি জনপ্রিয়তা অর্জন করে ভালোভাবেই রাজনীতিতে টিকে আছে। আবার অধিকাংশই নামকাওয়াস্তে রাজনীতি ধরে রেখেছে। এর পেছনের কারণ হলো, ধীরে ধীরে স্বৈরশাসনের উত্থান হওয়ায় রাজনীতি অনেকটাই কলুষিত। শেখ হাসিনার ১৬ বছরের দুঃশাসনে দেশের তরুণসমাজ অনেকটা রাজনীতিবিমুখ হয়ে পড়েছিল। কিন্তু ২০২৪ সালের জুলাই অভ্যুত্থানে ছাত্র-জনতার ব্যাপক অংশগ্রহণে অনেকেই আশান্বিত হন। এখন নতুন রাজনৈতিক দল এনসিপি যাতে কলুষিত রাজনীতিমুক্ত পরিচ্ছন্ন রাজনীতির ধারা ফেরাতে পারে সেই প্রত্যাশা দেশের সাধারণ মানুষ।
ভাষার মাস ফেব্রুয়ারির শেষ দিনে (২৮ ফেব্রুয়ারি) রাজধানীর মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে জাতীয় সংসদ ভবনের সামনে জাঁকজমক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে নতুন দল এনসিপির আত্মপ্রকাশ ঘটে। নতুন দলের ঘোষণাপত্র পাঠ করেন আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম। যেখানে উঠে আসে নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণের কথা, শপথ নেওয়া হয় ছাত্র-জনতার নতুন বাংলাদেশ গড়ার।
নতুন রাজনৈতিক দল এনসিপিকে স্বাগত জানিয়ে দলটির সাফল্য কামনা করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মোহাম্মদ কামরুল আহসান। তিনি গতকাল কালবেলাকে বলেন, নতুন দল নিয়ে এখনই মূল্যায়নের সময় হয়নি। তবে প্রাথমিকভাবে মনে হয়, রাজনৈতিক দলগুলোর মাঝে ঐক্য প্রতিষ্ঠার জন্য ছাত্রদের যে প্রতিনিধিত্ব থাকে সেটা সরকারের তুলনায় রাজনৈতিক দলের পক্ষে তাদের জন্য কাজ করা সহজ হবে। সরকারে থেকে একটি সংগ্রামী তরুণ গোষ্ঠী রাজনৈতিক দলের সঙ্গে ঐক্য তৈরি করে দেশের পরিবর্তন করা কঠিন। তার চেয়ে এখন যদি রাজনৈতিক দলের ব্যানারে দেশের স্বার্থ নিয়ে লড়াই করে সেটাতে দেশের লাভ হবে।
কামরুল আহসান বলেন, এনসিপির নেতারা সেকেন্ড রিপাবলিক প্রতিষ্ঠার কথা বলেছেন। এসব তো সময়ের ব্যাপার। সময় বলে দেবে। বাংলাদেশে পরিবর্তনগুলো পর্যায়ক্রমে করতে হবে। হুট করেই তো কিছু করা যায় না। প্রতিষ্ঠানগুলোকে কার্যকর করা, নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি করা, সবাইকে সমান সুযোগ করে দেওয়া—এসবই হচ্ছে আমাদের সমাজের জন্য খুব জরুরি। এটা করতে পারলে পরবর্তী কার্যক্রম নিয়ে চিন্তা করা যাবে। এভাবে স্টেপ বাই স্টেপ না করলে পরিবর্তনটা স্থায়ী হয় না। মানুষের মাইন্ডসেট আগে বদলাতে হবে। দুর্নীতির বাইরে আসতে হবে। তারপর অনেক কিছু করা যায়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক কাজী মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান বলেন, শেখ হাসিনার সরকারের পতন আন্দোলনে সম্পৃক্ত ছাত্ররা একটি নতুন দল গঠন করেছে। এজন্য রাজনীতিতে তাদের এক ধরনের আবেদন থাকবে। তবে বর্তমানে যেসব রাজনৈতিক দল আছে, তাদের মতো করে নতুন দলকে মানুষের মনে স্থান করে নিতে অনেক পরিশ্রম করতে হবে। নতুন দলটি হলো বর্তমানে যারা ডানপন্থি আছে তাদের মতো করেই আরেকটি দল। তবে তাদের এজেন্ডা একটু ভিন্নরকম। তারা সেকেন্ডে রিপাবলিকের কথা বলছে এবং নতুন বাংলাদেশের কথা বলছে। এই সেকেন্ড রিপাবলিক বা নতুন বাংলাদেশের ধারণাটা কী সেটি এখনো পরিষ্কার নয়।
তিনি বলেন, এনসিপি যে নতুন বাংলাদেশের কথা বলছে, সেখানে বিদ্যমান রাজনৈতিক দলগুলোর বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ সেগুলো থেকে এনসিপি কতটা মুক্ত থাকতে পারে সেটাও গুরুত্বপূর্ণ। বাড়ি দখল, জমি দখল, হানাহানি, মারামারি, কাটাকাটি, চাঁদাবাজি এবং অন্য যেসব সংস্কৃতি আছে সেসব থেকে এনসিপি কতটা মুক্ত হতে পারবে, এটার ওপর নির্ভর করবে তাদের গ্রহণযোগ্যতা।
কাজী মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান আরও বলেন, এনসিপির চিন্তা-আদর্শ সমাজের সকল শ্রেণির, সকল ধর্মের মানুষের কাছে কতটুকু পৌঁছাবে সেটিও আরেকটি বিরাট চ্যালেঞ্জ। এজন্যও সময় দরকার। একটা রাজনৈতিক দলকে লম্বা সময় ধরে অপেক্ষা করতে হয়। এখন এরাও যদি টিকে যায়, সময়ের পরীক্ষা উত্তীর্ণ হয় তাহলে তাদেরও সম্ভাবনা থাকবে। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের ভোটারদের যে ধরন, সেজন্য কেউ আওয়ামী লীগের চিন্তা-চেতনার মতো ধারণ করতে না পারলে আওয়ামী লীগের ভোট নেওয়া যাবে না।
নতুন দল এনসিপি বিদ্যমান রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য কী প্রভাব ফেলবে—এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, নতুন রাজনৈতিক দল এনসিপি দাঁড়িয়ে গেলে প্রথমে চ্যালেঞ্জে পড়বে জামায়াতে ইসলামী। এরপর অন্যান্য জাতীয়তাবাদী দলগুলোও কিছুটা চ্যালেঞ্জে পড়বে। যদিও কিছু কিছু দল অনেকটা লড়াই করে একটি টেকসই জায়গায় এসেছে। তবে জামায়াতের জন্য চ্যালেঞ্জ বেশি। কারণ হচ্ছে, ক্ষমতার জন্য সবারই আগ্রহ থাকে। অনেকেই মনে করছেন, নতুন দলে ইসলামী দলগুলোর অনেকে যুক্ত হতে পারে। যেমনটি জামায়াত থেকে শিবিরের সাবেক নেতারা বেরিয়ে এবি পার্টি গঠন করেছে। সুতরাং নতুন দলের কাছে প্রত্যাশাও আছে, চ্যালেঞ্জ অনেক বেশি।
বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য মোহাম্মদ মিজানুর রহমান ভুইয়া মিল্টন নতুন দল এনসিপিকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, গণতান্ত্রিকভাবে যে কেউ দল বা সংগঠন করতে পারে। ছাত্ররা নতুন গঠন করলেও তাদের আদর্শ কিন্তু স্পষ্ট নয়। ফলে তাদের কার্যক্রম শুরুর আগে খুব বেশি বলার সময় হয়নি।
মন্তব্য করুন