নিজেকে অনিয়মের বাইরে রাখতেই পারছে না দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ গ্যাস অনুসন্ধানের একমাত্র রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম এক্সপ্লোরেশন অ্যান্ড প্রোডাকশন কোম্পানি লিমিটেড (বাপেক্স)। গ্যাস অনুসন্ধানে ঠিকাদার নিয়োগে নানা অনিয়মে জড়িয়ে পড়া বাপেক্সের বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। নতুন করে আরও একটি অনিয়মে জড়িয়ে পড়েছে পেট্রোবাংলার আওতাধীন সংস্থাটি। সম্প্রতি গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য নেওয়া প্রকল্প অনুমোদনের আগেই ঠিকাদার নিয়োগ দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি, প্রকল্প অনুমোদনের পর আগেই ঠিক করে রাখা সেই ঠিকাদারকে কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছে। এভাবে টেন্ডার প্রক্রিয়ায় অনিয়মকেই নিয়ম বানিয়ে চলেছে বাপেক্স। ঠিকাদার নিয়োগের প্রক্রিয়ায় অনিয়ম হলেও প্রকল্প অনুমোদনে বিলম্বের অজুহাত দেখিয়ে সরকারি ক্রয়নীতি লঙ্ঘন করছে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের অধীন সংস্থাটি।
জানা গেছে, গত বছরের জানুয়ারিতে গ্যাস অনুসন্ধানে বাপেক্সের প্রস্তাবিত ‘২ডি সাইসমিক সার্ভে ওভার এক্সপ্লোরেশন ব্লক-৭ এবং ব্লক-৯’ শীর্ষক একটি প্রকল্প অনুমোদন দেয় সরকার। ৩০০ কোটি ৩৯ লাখ টাকা ব্যয়ের প্রকল্পটি ২৩ ডিসেম্বর জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় অনুমোদনের পর চলতি বছরের ১৩ জানুয়ারি প্রশাসনিক আদেশ জারি করে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ। প্রশাসনিক আদেশ জারির সাত দিন পর প্রকল্প বাস্তবায়নে চীনের ‘বিজিপি ইনক’ নামক একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কার্যাদেশ দেয় বাপেক্স। এই ঠিকাদার নিয়োগের বিষয়টি চূড়ান্ত করে রাখা হয়। আর প্রকল্প অনুমোদনের এক বছর আগে ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে আলোচ্য প্রকল্পের টেন্ডার আহ্বান করা হয়, যখন এই প্রকল্পের অস্তিত্বই ছিল না, তখন ঠিকাদার নিয়োগ এবং প্রকল্প অনুমোদনের সঙ্গে সঙ্গে মন্ত্রণালয়ের আদেশ উপেক্ষা করে কার্যাদেশ দেওয়ার বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগও বিষয়টি অবহিত হয়ে প্রকল্প অনুমোদনের আগে টেন্ডার কার্যক্রম করা যাবে না বলে অফিস আদেশ জারি করে। এরপরও আগেই ঠিক করে রাখা ঠিকাদারকে কার্যাদেশ দেওয়ার কারণ খুঁজতে গিয়ে জানা যায়, দেশের চার বিভাগে গ্যাস সন্ধানে ২০২৩ সালে দ্বিমাত্রিক (টুডি) সাইসমিক সার্ভে ওভার এক্সপ্লোরেশন ব্লক-সেভেন এবং ব্লক-নাইন প্রকল্পের সিদ্ধান্ত নেয় বাপেক্স বোর্ড। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী নেওয়া প্রকল্প অনুমোদনের জন্য উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) পাঠায় পরিকল্পনা কমিশনে।
বাপেক্সের প্রকল্প প্রস্তাব পাওয়ার পর যাচাই-বাছাই চলতে থাকে পরিকল্পনা কমিশনে। এরই মধ্যে প্রকল্পের টেন্ডার কার্যক্রম শুরু করে দেয় বাপেক্স। যদিও সরকারি ক্রয় নীতিমালা (পিপিআর) অনুযায়ী আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকল্প অনুমোদনের আগে টেন্ডার কার্যক্রমের কোনো সুযোগ নেই।
২০২৪ সালের ১০ জানুয়ারি পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে আহ্বান করা টেন্ডারে অংশ নেয় চারটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। মূল্যায়ন কমিটি প্রাথমিক তালিকায় রাখে তিনটিকে। দেশের টালমাটাল পরিস্থিতিতে গত ৩১ জুলাই বাপেক্স বোর্ড মিটিংয়ে চায়না প্রতিষ্ঠান বিজিপি ইন্টারন্যাশনালকে কারিগরি মূল্যায়নে প্রথম স্থানে রাখা হয় এবং পরের মাসে সেপ্টেম্বরে ৪৮৭তম বোর্ড সভায় বিজিপির সঙ্গে ক্রয় চুক্তির সিদ্ধান্ত অনুমোদন দেওয়া হয়। এভাবে প্রকল্প অনুমোদনের আগেই অনিয়মের মাধ্যমে টেন্ডার প্রক্রিয়া শেষ করে বাপেক্স।
জানা গেছে, প্রকল্প অনুমোদনের আগে গত ১১ সেপ্টেম্বর গ্যাস অনুসন্ধানে প্রস্তাবিত প্রকল্পে ব্যয় কমিয়ে ডিপিপি পুনর্গঠন করার নির্দেশনা দেয় জ্বালানি মন্ত্রণালয়। তবে মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনাকে গুরুত্ব না দিয়ে দুদিন পর ১৩ সেপ্টেম্বর টেন্ডারের আর্থিক কোটেশন অনুমোদন করে বাপেক্স এবং ঠিকাদার নিয়োগ করে ফেলায় ব্যয় না কমিয়ে তড়িঘড়ি করে ৩ অক্টোবর শুধু প্রকল্পের সময় বদলে দ্বিতীয় দফায় অনুমোদনের জন্য মন্ত্রণালয়ে পাঠায় পেট্রোবাংলা।
অভিযোগ রয়েছে, প্রকল্প অনুমোদনের আগেই নিজেদের ইচ্ছামতো তড়িঘড়ি করে ঠিকাদার নিয়োগ দিয়েছেন সাবেক জ্বালানি সচিব নুরুল আলম, বাপেক্স এমডি মোহাম্মদ শোয়েব এবং টেন্ডার প্রক্রিয়া মূল্যায়নের সদস্য সচিব ও প্রকল্প ব্যবস্থাপক শফিকুল ইসলাম।
এদিকে, বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পর টেন্ডারের সময় ও ঠিকাদার নিয়োগ নিয়ে দুদফা অফিস আদেশ দেয় জ্বালানি মন্ত্রণালয়। গত ৯ ডিসেম্বর অফিস আদেশে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকল্প অনুমোদনের আগে কোনো ধরনের ক্রয় কার্যক্রমের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। ওই আদেশে বলা হয়, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের আওতাধীন প্রস্তাবিত বিভিন্ন প্রকল্পের আনুষ্ঠানিক অনুমোদনের আগে ক্রয়-সংক্রান্ত কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়, যা বিধিসম্মত নয়। তাই প্রকল্প অনুমোদনের আগে ক্রয়-সংক্রান্ত কোনো কার্যক্রম গ্রহণ করা যাবে না। সেই আদেশ অমান্য করে চলতি বছরের ২০ জানুয়ারি আগেই ঠিক করে রাখা ঠিকাদারকে প্রকল্পের কার্যাদেশ দেওয়া হয়।
এমনকি প্রথম আদেশের পর চলতি বছরের ২৩ জানুয়ারি দেওয়া সংশোধিত অফিস আদেশে শুধু গ্যাস কূপ খনন ছাড়া অন্য ক্ষেত্রে আগের আদেশ বহাল থাকার কথা বলা হয়। অর্থাৎ গ্যাস অনুসন্ধান প্রকল্পের ক্ষেত্রে ডিপিপি অনুমোদনের আগে টেন্ডার কার্যক্রম গ্রহণে নিষেধাজ্ঞা রাখা হয়।
বাপেক্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহম্মদ শোয়েব কালবেলাকে বলেন, এই প্রকল্পের ক্ষেত্রে অনুমোদনের আগেই ঠিকাদার নিয়োগের বিষয়টি চূড়ান্ত ছিল। যেটি বাপেক্সের পরিচালনা পর্ষদে অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল। সেই হিসেবে একনেক কর্তৃক প্রকল্প অনুমোদনের পর কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের আদেশ অমান্য করা হয়েছে কি না—এমন প্রশ্নের জবাবে কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি তিনি। মো. শোয়েব বলেন, প্রকল্প অনুমোদনে অনেক ক্ষেত্রে বিলম্ব হয়। এ কারণে আগে থেকে দেখছি আমাদের (বাপেক্সে) যেসব প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়েছে, সেগুলো অনুমোদনের আগেই টেন্ডার কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে। সেই ধারাবাহিকতায় এই প্রকল্পের ক্ষেত্রেও অনুমোদনের আগেই টেন্ডার কার্যক্রম সম্পন্ন করে ঠিকাদার নিয়োগের বিষয়টি চূড়ান্ত করা হয়েছে।
জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের সচিব মোহম্মদ সাইফুল ইসলাম কালবেলাকে বলেন, প্রকল্প অনুমোদনের আগে কোনোভাবেই টেন্ডার কার্যক্রম গ্রহণের সুযোগ নেই। যেহেতু প্রকল্পের আনুষ্ঠানিক অনুমোদন বিলম্ব হয়, সেজন্য জাতীয় স্বার্থে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস উৎপাদন ও জ্বালানি সরবরাহের লক্ষ্যে শুধু গ্যাস কূপ খননের ক্ষেত্রে টেন্ডার কার্যক্রম এগিয়ে রাখার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। তবে কূপ খননের বাইরে অন্য কোনো প্রকল্পে এটা করার সুযোগ নেই। বাপেক্সের এই প্রকল্পের ক্ষেত্রে কী হয়েছে, সেটা আমার জানা নেই। যদি কোনো অনিয়ম হয়ে থাকে, তাহলে অবশ্যই বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে।
পরিকল্পনা কমিশনের সাবেক সচিব মামুন আল রশীদ কালবেলাকে বলেন, প্রকল্প অনুমোদনের আগে ঠিকাদার নিয়োগ তো দূরের কথা, টেন্ডার আহ্বান করারও সুযোগ নেই। তবে প্রকল্প অনুমোদনের আগে শুধু টেন্ডার ডকুমেন্ট এবং কারিগরি স্পেসিফিকেশন তৈরি করে রাখা যেতে পারে। যাতে প্রকল্প অনুমোদনের পরপরই টেন্ডার আহ্বান করা যায়। তিনি বলেন, তারা যেটা করেছে সেটা পুরোপুরি অনিয়ম, সম্পূর্ণভাবে সরকারের ক্রয়-সংক্রান্ত নীতিমালা (পিপিআর) পরিপন্থি। পিপিআর অনুযায়ী এটা করার কোনো সুযোগ নেই। এ বিষয়ে বাপেক্সের বক্তব্য অগ্রহণযোগ্য এবং ভিত্তিহীন। কোন কোন ক্ষেত্রে এমন সুযোগ দিতে হবে, সেটা পিপিআরে বলা আছে, সুতরাং তারা কোনোমতে এর ব্যতিক্রম করতে পারবে না। কারণ, তাদের জন্য কোনো জায়গায় এমন বিধান রাখা হয়নি। এরপরও তারা যেটা করেছে, সেটার পেছনে অসৎ উদ্দেশ্য থাকতে পারে। এগুলো এখনই রুখতে হবে। এগুলো স্বজনপ্রীতি এবং কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্টের ক্ষেত্র প্রস্তুত করে।
মন্তব্য করুন