চট্টগ্রাম ব্যুরো
প্রকাশ : ০৮ মে ২০২৫, ১০:৫৩ পিএম
অনলাইন সংস্করণ

আদালতে আইনজীবীদের হট্টগোল, এজলাস ছাড়লেন বিচারক 

চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ আদালত। ছবি : সংগৃহীত
চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ আদালত। ছবি : সংগৃহীত

চট্টগ্রাম আদালতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ঘটনায় হওয়া একটি মামলায় সিবিএর ছয় নেতাকে জামিন নামঞ্জুরকে কেন্দ্র করে জামায়াত-বিএনপিপন্থি আইনজীবীদের দুপক্ষের মধ্যে হট্টগোল হয়েছে। এক পর্যায়ে বিচারকের দিকে ফাইল ছুড়ে মেরে ‘ভুয়া, ভুয়া’ স্লোগান দেওয়া হলে বিচারক এজলাস ত্যাগ করেন।

পরে আরেক আইনজীবীর মাধ্যমে আগামী সোমবার শুনানির আবেদন করা হলে আদালত তাও নামঞ্জুর করেন এবং আসামিদের কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন।

বৃহস্পতিবার (৮ মে) সকাল সাড়ে ১১টার দিকে চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ আদালতের বিচারক মোহাম্মদ হাসানুল ইসলামের আদালত শুনানি শেষে জামিন নামঞ্জুর করে আসামিদের কারাগারে পাঠানোর এ আদেশ দেন।

অন্যদিকে, আসামিদের হয়ে জামিন আবেদনে ওকালতনামা দিয়েছেন রাষ্ট্রপক্ষের এক ‘বিতর্কিত’ আইনজীবী। যিনি এর আগে অ্যাডভোকেট সাইফুল ইসলাম আলিফ হত্যা মামলার আসামিদের জামিন আবেদনে ওকালতনামা দিয়ে ‘নিন্দিত’ হয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, আসামিদের হয়ে জামিন শুনানিতেও অংশ নিয়েছিলেন অর্ধডজনেরও বেশি রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী। যা নৈতিকতা বিবর্জিত বলছেন আইনজ্ঞরা। এই আইনজীবীরা সবাই বিএনপিপন্থি হিসেবে পরিচিত।

জানা গেছে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় নগরের সিটি কলেজ এলাকায় আন্দোলনকারীদের ওপর হামলার অভিযোগে ২০২৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর ভুক্তভোগী মাশফিকুর রহমান শান্ত নামের এক শিক্ষার্থী সদরঘাট থানায় বিস্ফোরক এবং বিশেষ ক্ষমতা আইনের ধারায় মামলা দায়ের করেন। মামলায় মেঘনা পেট্রোলিয়াম শ্রমিক ইউনিয়নের (সিবিএ) সিবিএর ছয় নেতাসহ ১১৩ জনকে এজাহারনামীয় আসামি করা হয়।

মামলার আসামি হওয়া ওই ৬ জন হলেন— শ্রমিক লীগ নেতা ও মেঘনা পেট্রোলিয়াম শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি মো. আইয়ুব, সাধারণ সম্পাদক হামিদুর রহমান, সহ-সাধারণ সম্পাদক জহির উদ্দিন ওরফে আকবর, অর্থ সম্পাদক ইউসুফ আলী ও দপ্তর সম্পাদক বাবু রনি কর ও সদস্য রাজীব ধর।

আদালত সূত্র জানায়, আসামিরা গত ১৬ ফেব্রুয়ারি উচ্চ আদালতে আগাম জামিন আবেদন করলে আদালত ৮ সপ্তাহের আগাম জামিন মঞ্জুর করেন। পরবর্তীতে জামিনের মেয়াদ শেষের আগেই গত ১০ এপ্রিল নিম্ন আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিন আবেদন করেন আসামিরা। ওই জামিন আবেদনের ওকালতনামা দেন চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ আদালতের অতিরিক্ত সরকারি কৌঁসুলি নেজাম উদ্দিন। আজ সেই জামিন আবেদনের শুনানির দিন ধার্য ছিল।

আদালত সূত্র জানিয়েছে, বৃহস্পতিবার সকাল ১১টার দিকে এজলাস বসলে জামিন আবেদনের বিপক্ষে যুক্তি তুলে ধরেন বাদীপক্ষের আইনজীবীরা। শুনানির ১৫ মিনিট না যেতেই আসামিপক্ষের আইনজীবীরা হট্টগোল করতে থাকেন। এরপর আদালত জামিন না-মঞ্জুরের আদেশ দেন। আদালতের আদেশের পরপরই সাড়ে ১১টার দিকে আসামিপক্ষের আইনজীবীরা বিচারকের ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে যান।

এক পর্যায়ে বিচারককে উদ্দেশ করে ‘ভুয়া, ভুয়া’ স্লোগান এবং ‘জিয়ার সৈনিক, এক হও লড়াই করো’ স্লোগান দেওয়া হয়। বাদী-বিবাদী পক্ষের আইনজীবীদের বাগবিতণ্ডার মধ্যেই বিচারকের দিকে ফাইল ছুঁড়ে মারেন আসামিপক্ষের একজন আইনজীবী। এরপরই বিচারক এজলাস ত্যাগ করেন। পরে ভিন্ন আইনজীবীর ওকালতনামার মাধ্যমে ওই ৬ আসামির জামিন শুনানির দিন আগামী সোমবার ধার্যের আবেদন করা হয়। বেলা সাড়ে ১২টার দিকে বিচারক ফের এজলাসে আসেন। শেষমেষ ওই আবেদনটিও আদালত নামঞ্জুর করেন।

জানা গেছে, শুনানিতে বাদীপক্ষের আইনজীবী হিসেবে ছিলেন অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ সাইফুদ্দিন। কিন্তু তার পক্ষে শুনানি করেন জামায়াতে ইসলামী সমর্থিত বাংলাদেশ ল’ ইয়ার্স কাউন্সিলের নেতা অ্যাডভোকেট শামসুল আলম। এছাড়া বিএনপিপন্থি আইনজীবীদের একাংশও বাদীপক্ষের হয়ে শুনানিতে অংশ নিয়েছিলেন।

অন্যদিকে, আসামিপক্ষের আইনজীবীদের মধ্যে ছিলেন পিপি এস উ নুরুল ইসলাম, পিপি কামরুল হাসান সাজ্জাদ, পিপি শফিউল মোর্শেদ, পিপি আবুল কালাম আজাদ, পিপি রফিক আহমেদ, পিপি সেলিম উদ্দিন শাহীন, পিপি ফয়জুল আমিন, এপিপি দেলোয়ার হোসেন, এপিপি নেজাম উদ্দিন, এপিপি ইকবাল হোসেন এপিপি রশিদ বিন জাহেদ, এপিপি বেলাল হোসেন প্রমুখ। যারা সবাই বিএনপিপন্থি হিসেবে পরিচিত।

আসামিদের পক্ষে জামিন আবেদনে ওকালতনামা দিয়েছেন চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ আদালতের অতিরিক্ত সরকারি কৌঁসুলি নেজাম উদ্দিন। জামিন আবেদনে আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ মিথ্যা দাবি করেন তিনি। এছাড়া আসামিরা আওয়ামী রাজনীতির সঙ্গে নয় বরং বিএনপি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত বলেও দাবি তার।

এর আগেও গত বছরের ২ ডিসেম্বর আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফ হত্যার ঘটনায় হওয়া মামলার আসামি মো. নুরু এবং মো. দেলোয়ার হোসেনের পক্ষে জামিন আবেদনে ওকালতনামা দিয়েছেন নেজাম উদ্দিন। সেই ঘটনায় সাধারণ আইনজীবীদের তোপের মুখে পড়েছিলেন তিনি। তখন তাকে মহানগর পিপি কার্যালয়ে অবরুদ্ধ করে সাদা কাগজে পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর নেওয়া হয়। যদিও সেই পদত্যাগ পরবর্তীতে কার্যকর হয়নি।

বাদীপক্ষের আইনজীবী মোহাম্মদ সাইফুদ্দিন বলেন, ‘শুনানির সময়ে আসামিপক্ষের আইনজীবীরা খুবই উচ্চবাচ্য করেছেন, যেন আদালত আমাদের কথা শুনতে না পারেন। আমাদের কথা বলতে বাধা দিয়েছেন তারা। আসামি হামিদুর শ্রমিক লীগ নেতা। তিনি গত ১৭ বছর স্বৈরাচারের পক্ষে কাজ করেছেন। সেসব আমরা আদালতের কাছে তুলে ধরেছি। একপর্যায়ে আদালত জামিন নামঞ্জুর করলে তারা বিচারকের সঙ্গে চরম দুর্ব্যবহার করেন এবং ফাইল ছুঁড়ে মারেন। পরে বিচারক এজলাস ত্যাগ করেন।’

তিনি বলেন, ‘পরবর্তীতে আরেকজন আইনজীবীর ওকালতনামা দিয়ে বাদীর উপস্থিতিতে আগামী সোমবারে শুনানির আবেদন করেছেন তারা। প্রায় এক ঘণ্টা পর এজলাস বসলে আদালত সেই আবেদনও নামঞ্জুর করেন। রাষ্ট্রপক্ষে মহানগর পিপি যেভাবে জামিনের বিরোধিতা করার কথা, তিনি আজ সেইভাবে করেননি। হালকাভাবে দু-একটি কথা বলা বাদে বাকি সময় তিনি চুপই ছিলেন।’

ওকালতনামা প্রত্যাহার করেছেন দাবি করে আসামিপক্ষের আইনজীবী নেজাম উদ্দিন বলেন, ‘আজকে শুনানিতে আমি ছিলাম না। আমি ওকালতনামা দিয়েছিলাম, তবে প্রত্যাহার করে নিয়েছি। আমি আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদকের সাথেও কথা বলেছিলাম এ বিষয়ে।’

চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ আদালতের সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) মফিজুল হক ভূঁইয়া বলেন, ‘এজলাসে বাদানুবাদের বিষয় এবং বিচারকের এজলাস ত্যাগের বিষয়টি সত্য। তবে আমার কাছে জানতে চাওয়ার আগে বারের সভাপতি-সম্পাদককে আগে জিজ্ঞেস করেন। আমি তাদেরকে থাকার জন্য দাওয়াত করেছিলাম।’

চট্টগ্রাম আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ হাসান আলী চৌধুরী বলেন, ‘আমি এবং সভাপতি সাহেব দুজনেই এখন ঢাকায় আছি একটি কাজে। আমরা কেউ আজ শুনানিতে ছিলাম না। তবে হট্টগোলের বিষয়টি শুনেছি। যতটুকু জেনেছি, আসামিরা উচ্চ আদালতের আদেশ অনুযায়ী আত্মসমর্পণ করে জামিন আবেদন করেছেন। জজ সাহেব নাকি জামিন দেয়নি। জামিন না দিলে আসামিপক্ষ একটু রিয়্যাক্ট করে। অন্য কিছু নাই এখানে।’

রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী হয়ে আসামিপক্ষে জামিন চাওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘তিনি (নেজাম) আসলে এডিশনাল পিপি। সে হিসেবে তিনি আসামিপক্ষে থাকার কথা নয়। যাহোক, কীভাবে কী হল তা আমি জানি না ঢাকা থাকার কারণে। আমিও অন্যদের কাছ থেকে শুনেছি। আর এটা ভালো বলতে পারবেন মহানগর পিপি।’

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

শেখ হাসিনার পক্ষে শিক্ষার্থীদের স্লোগান, প্রধান শিক্ষককে শোকজ

স্বাস্থ্য পরামর্শ / মায়ের গর্ভেই থ্যালাসেমিয়া রোগ নির্ণয় পদ্ধতি

আ.লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক অবরোধ

মরদেহ দাফনের পাঁচদিন পর বাবা জানলেন সন্তান জীবিত

দেশজুড়ে ভারতের ২৪টি বিমানবন্দর বন্ধ ঘোষণা

সাবেক মেয়র আইভীকে আটকের খবরে বাড়ি ঘেরাও

পাকিস্তানের মিসাইল বৃষ্টি, অন্ধকার ভারত

ভারতের প্রত্যাঘাত ছিল অ-উত্তেজক ও সুনির্দিষ্ট : বিক্রম মিশ্রি

আ.লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে যমুনার সামনে অবস্থান

দৌলতপুরে অগ্নিকাণ্ডে দগ্ধ পরিবারের দায়িত্ব নিলেন বিএনপি নেতা বকুল

১০

সরকারি বাঙলা কলেজে দ্বিতীয় আন্তঃবিভাগ বিজ্ঞান মেলা অনুষ্ঠিত

১১

রাস্তায় নামার আহ্বান এনসিপি নেতাদের

১২

‘বিএনপি ক্ষমতায় গেলে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর উন্নয়নে পৃথক অধিদপ্তর করা হবে’

১৩

আ.লীগ মানেই পালানোর ইতিহাস : টুকু

১৪

সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ দেশত্যাগ করায় নিজ এলাকায় বিক্ষোভ

১৫

বাজার থেকে বাড়ি ফেরা হলো না চাচা-ভাতিজার

১৬

ভারতের দুটি রাফাল ভূপাতিত করা নিয়ে মুখ খুলল যুক্তরাষ্ট্র, চুপ দিল্লি

১৭

বিএনপি নেতার চাঁদা দাবির অডিও ভাইরাল

১৮

মোটরসাইকেল-অটোরিকশার সংঘর্ষে নিহত দুই শিক্ষার্থী

১৯

ববি ভিসির বিধি লঙ্ঘন ও অনিয়মের প্রতিবেদন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে

২০
X