সংস্কার ও নির্বাচন ইস্যু ছাপিয়ে এবার বিতর্ক আর আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চট্টগ্রাম বন্দর। বন্দরের নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) ব্যবস্থাপনা বিদেশি কোম্পানিকে দেওয়া হবে কি হবে না, তা নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে বিতর্ক এখন তুঙ্গে। রাজনৈতিক দল থেকে সাধারণ মানুষ এ ধরনের সম্ভাব্য সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে প্রতিবাদ করছেন।
দেশের আমদানি ও রপ্তানির প্রধান গেটওয়ে চট্টগ্রাম বন্দর। আর এই বন্দরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো এনসিটি। দেশের মোট কনটেইনার পণ্য ওঠানামার ৫৫ শতাংশই হয় এনসিটি দিয়ে। পণ্য ওঠানামার সবচেয়ে আধুনিক সব যন্ত্রে সজ্জিত এই টার্মিনাল থেকে বছরে হাজার কোটি টাকার বেশি রাজস্ব আয় করে বন্দর কর্তৃপক্ষ।
শুধু চট্টগ্রাম বন্দরই নয়, দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে এনসিটি। এই টার্মিনাল আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিদেশি প্রতিষ্ঠানের হাতে ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারও সেই ধারাবাহিকতা এগিয়ে নিচ্ছে। বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম টার্মিনাল অপারেটর সংযুক্ত আরব আমিরাতের ডিপি ওয়ার্ল্ডকে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বের (পিপিপি) মাধ্যমে জিটুজি ভিত্তিতে টার্মিনালটি পরিচালনার ভার দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। এর বিরুদ্ধে অনেক দিন ধরে সরব বন্দরের শ্রমিক-কর্মচারীরা। আন্দোলন-বিক্ষোভও করছেন তারা। এ নিয়ে একইভাবে সোচ্চার হতে দেখা গেছে ডান-বামসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলকেও। চট্টগ্রাম বন্দরের বিভিন্ন টার্মিনাল পরিচালনার দায়িত্ব বিদেশি প্রতিষ্ঠানের হাতে তুলে দেওয়ার প্রতিবাদ জানিয়ে নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করেছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ, খেলাফত মজলিস, বাম গণতান্ত্রিক জোট, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ), গণসংহতি আন্দোলন ও ১২-দলীয় জোট। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানও বলেছেন, গৃহযুদ্ধকবলিত মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের জন্য ‘মানবিক করিডোর’ দেওয়া এবং চট্টগ্রাম বন্দরের কনটেইনার টার্মিনাল বিদেশি কোম্পানির হাতে দেওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া অন্তর্বর্তী সরকারের কাজ নয়। এই সিদ্ধান্ত নেবে জাতীয় সংসদ। শনিবার ঢাকার গুলশানে একটি হোটেলে আয়োজিত জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলনের (এনডিএম) অষ্টম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এ কথা বলেন তারেক রহমান।
তবে অন্তর্বর্তী সরকারের ভাষ্য, বাংলাদেশের অর্থনীতি বদলাতে হলে চট্টগ্রাম বন্দরই একমাত্র ভরসা। চট্টগ্রাম বন্দরকে সত্যিকার বন্দরে পরিণত করার কাজ চলছে। যারা বন্দরের ব্যবস্থাপনায় অভিজ্ঞ, পৃথিবীর সেরা যারা, তাদের দিয়ে এই কাজ করাতে হবে, যেভাবেই হোক। মানুষ যদি রাজি না হয়, জোরাজুরি নয়, রাজি করিয়েই করতে হবে।
বন্দর কর্তৃপক্ষও এ নিয়ে গত তিন-চার মাসে বেশ কয়েকবার গণমাধ্যমের মুখোমুখি হয়েছে। সাধারণ মানুষেরও বিষয়টি নিয়ে জানার বেশ কৌতূহল। বর্তমানে রাজনীতিতে মূল আলোচনা এখন চট্টগ্রাম বন্দর ঘিরেই।
গত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিদেশি অপারেটর দিয়ে এনসিটি পরিচালনার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছিল নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়। সংযুক্ত আরব আমিরাত ভিত্তিক বন্দর পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান ‘ডিপি ওয়ার্ল্ড’কে সামনে রেখে কার্যক্রম অনেকদূর এগিয়েও ছিল। এজন্য সরকারের পিপিপি কর্তৃপক্ষ ট্রানজেকশন অ্যাডভাইজর পর্যন্ত নিয়োগ করেছিল। তখন বন্দর ব্যবহারকারীদের অনেকেই এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সোচ্চার থাকলেও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের একক আধিপত্যের কারণে সেই প্রতিবাদ হালে পানি পায়নি। এই অবস্থায় এনসিটি ‘ডিপি ওয়ার্ল্ড’কে দিয়ে পরিচালনার কাজ এগোতে থাকে। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সেই উদ্যোগ যায় থেমে। তবে সম্প্রতি তা আবার আলোচনায় আসে নৌপরিবহন উপদেষ্টা এম সাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে ডিপি ওয়ার্ল্ডের শীর্ষ কর্মকর্তাদের বৈঠকের পর। এরপর আমিরাতের এই কোম্পানির প্রতিনিধিরা বন্দর পরিদর্শনে যাযন, বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যানের সঙ্গে দেখাও করেন।
গত ২০ এপ্রিল চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলন করে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী চট্টগ্রাম নগর শাখা। সেখানে মহানগর জামায়াতের আমির শাহজাহান চৌধুরী বলেন, ‘চট্টগ্রাম বন্দরের এনসিটি নিয়ে গভীর ষড়যন্ত্র চলছে। আমরা বিদেশি বিনিয়োগ চাই। দেশের উন্নয়নের জন্য বিদেশি বিনিয়োগ অপরিহার্য। কিন্তু সেই বিনিয়োগ হোক গ্রিন ফিল্ডে। যেমন দেশের বিভিন্ন স্থানে ইকোনমিক জোনগুলোতে বিদেশিরা এসে বিনিয়োগ করছে। কিন্তু আমাদের নিজস্ব অর্থায়নে তৈরিকৃত টার্মিনাল, যেখানে কোনো বিনিয়োগের দরকার নেই; কেন বিদেশিদের দেওয়া হবে তা বোধগম্য নয়।’
এই সংবাদ সম্মেলনের চার দিন পর চট্টগ্রাম বন্দরের শহীদ ফজলুর রহমান মুন্সি মিলনায়তনে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন চট্টগ্রাম বন্দর চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এস এম মনিরুজ্জামান। সেখানে তিনি জানান, চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজ থেকে কনটেইনার ওঠানো-নামানোর তিনটি টার্মিনাল নির্মাণ ও পরিচালনায় তিন বিদেশি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে এ বছরই চুক্তি হচ্ছে। প্রতিষ্ঠান তিনটি হলো ডেনমার্কের এপি-মুলার মায়েরস্ক, সিঙ্গাপুরের পিএসএ এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের ডিপি ওয়ার্ল্ড।
বন্দর চেয়ারম্যান বলেন, ‘বে-টার্মিনাল প্রকল্পের স্রোত প্রতিরোধক তৈরিতে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে চুক্তি হয়েছে। এ বছরের শেষে পিপিপির আওতায় প্রকল্পের দুটি টার্মিনাল নির্মাণ ও পরিচালনার চুক্তি হবে। এর মধ্যে কনটেইনার টার্মিনাল-১ সিঙ্গাপুরের পিএসএ এবং কনটেইনার টার্মিনাল-২ আমিরাতের ডিপি ওয়ার্ল্ডের সঙ্গে চুক্তির ব্যাপারে কাজ এগিয়ে চলছে। সবকিছু ঠিক থাকলে আগামী ২০৩১ সালে বে-টার্মিনাল চালু হবে বলে আশা করছি।’ তিনি আরও বলেন, ‘এই দুটি ছাড়াও পিপিপির ভিত্তিতে এ বছর লালদিয়ায় কনটেইনার টার্মিনাল নির্মাণ ও পরিচালনার চুক্তি হবে ডেনমার্কের এপি-মুলার মায়েরস্কের সঙ্গে। বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেরাই বিনিয়োগ করে টার্মিনাল নির্মাণ ও পরিচালনা করবে।’
গত ৩ মে বিকেলে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউস সম্মেলন কক্ষে এক সংবাদ সম্মেলন করেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম। তিনি বলেন, ‘বর্তমানে চট্টগ্রামের সব টার্মিনাল (লালদিয়া, বে-টার্মিনাল, পতেঙ্গা টার্মিনাল, মাতারবাড়ী) মিলিয়ে মোট কনটেইনার হ্যান্ডলিং সক্ষমতা প্রায় ১২ লাখ ৭০ হাজার টিইইউ। ২০৩০ সালের মধ্যে তা ছয় গুণ বাড়িয়ে ৭৮ লাখ ৬০ হাজারে উন্নীত করার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। চট্টগ্রাম ঘিরে পুরো অঞ্চলটাই বন্দরের জন্য উপযুক্ত। বন্দরের দক্ষতার সঙ্গে সংযুক্ত সড়কসহ সবকিছুরই সমন্বিত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের আশাও প্রকাশ করেন তিনি।
এরপর ৮ মে সকালে চট্টগ্রামের পতেঙ্গায় লালদিয়ার চর, বে-টার্মিনাল ও বন্দরের নিউমুরিং টার্মিনাল এলাকা পরিদর্শন করেন বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) নির্বাহী চেয়ারম্যান আশিক চৌধুরী। এ সময় তিনি বলেন, ‘পিপিপির আওতায় লালদিয়ার চরে নেদারল্যান্ডসভিত্তিক এপিএম টার্মিনালস কনটেইনার টার্মিনাল নির্মাণে ৬০ থেকে ৮০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করবে। সাগর উপকূলে বে-টার্মিনাল প্রকল্পে সিঙ্গাপুরের পিএসএ ইন্টারন্যাশনাল এবং আমিরাতের ডিপি ওয়ার্ল্ড ১ বিলিয়ন করে ২ বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে দুটি টার্মিনাল নির্মাণ করবে। বন্দরে পুরোদমে চালু থাকা নিউমুরিং টার্মিনালেও বিদেশি বিনিয়োগ হবে।’
আশিক চৌধুরী বলেন, ‘বাংলাদেশকে বৈশ্বিক উৎপাদনের অঞ্চল করতে হলে বন্দর-সুবিধা অনেক বাড়াতে হবে। বিদেশি বিনিয়োগ হলে বন্দরের দক্ষতা বাড়বে। এ জন্য দেশীয় স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে।’
এরপর ১৪ মে বুধবার সকাল ১০টার দিকে চট্টগ্রাম বন্দরে নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনালের (এনসিটি) ইয়ার্ড-৫ পরিদর্শন করেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এ সময় তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের অর্থনীতি বদলাতে হলে চট্টগ্রাম বন্দরই একমাত্র ভরসা। চট্টগ্রাম বন্দরকে সত্যিকার বন্দরে পরিণত করার কাজ চলছে। কাজেই আমরা বললাম, পৃথিবীর সেরা বন্দর ব্যবস্থাপক যারা আছে, তাদের ডাক। দেখলাম যে আগেই ডাকা হয়েছে; কিন্তু কাজটা হচ্ছে না। বারবার সবার কাছে আবেদন করছি, এটা তাড়াতাড়ি করে দাও। যতই দিন যাবে, এই হৃৎপিণ্ডকে আর ওইভাবে স্থাপন করতে পারব না। এটা পরিবর্তন না করে বাংলাদেশে অর্থনীতি পরিবর্তন সম্ভব নয়।’
এদিকে চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল বিদেশিদের হাতে ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে সপ্তাহব্যাপী কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন জাতীয়তাবাদী শ্রমিক দলের চট্টগ্রাম বন্দর শাখা। শনিবার এক বৈঠক থেকে এ কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। জাতীয়তাবাদী শ্রমিক দলের চট্টগ্রাম বন্দর শাখার সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুন কবির জানান, কর্মসূচি শুরু হবে আজ ১৯ মে থেকে। এদিন বাদ মাগরিব বন্দর এলাকায় মশাল মিছিল কর্মসূচি পালন করা হবে। ২৪ মে সকাল ১০টায় বন্দর বয়েজ স্কুলের সামনে বিক্ষোভ সমাবেশ ও মিছিল, পরদিন ২৫ মে সকাল ১০টায় বন্দর ভবনের সব ফটকে অবস্থান ধর্মঘট, ২৬ মে একই কর্মসূচি পালন করা হবে।
অন্যদিকে গতকাল রোববার সকাল ১০টা থেকে চট্টগ্রাম বন্দর ভবনের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করছে চট্টগ্রাম সুরক্ষা কমিটি। চট্টগ্রাম বন্দরের এনসিটি, পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল, বে-টার্মিনাল, লালদিয়ারচর বিদেশি কোম্পানিকে না দিয়ে দেশের কোম্পানিকে আন্তর্জাতিক মানের গড়ে তোলার দাবিতে এই অবস্থান কর্মসূচি পালন করছে তারা।
চট্টগ্রাম সুরক্ষা কমিটির আহ্বায়ক বিপ্লব পার্থ বলেন, এনসিটির মাধ্যমে চট্টগ্রাম বন্দরের ৬০ শতাংশ কার্যক্রম পরিচালনা হয়। আমরা বিদেশি বিনিয়োগের বিপক্ষে নই। তবে আমাদের যেটি লাভবান সেক্টর সেটি কেন বিদেশিদের হাতে তুলে দেব? আমাদের অনেক ক্ষেত্র রয়েছে, যেখানে বিনিয়োগ প্রয়োজন। সেখানে বিদেশি বিনিয়োগ হোক। তাহলে দেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াবে।
চট্টগ্রাম বন্দর পর্ষদের সাবেক সদস্য মো. জাফর আলম বলেন, নতুন অবকাঠামো নির্মাণ ও পরিচালনার জন্য বিদেশি বিনিয়োগ সবচেয়ে ভালো সিদ্ধান্ত। লালদিয়ার চর, বে-টার্মিনালে বিদেশি বিনিয়োগের যে প্রক্রিয়া চলছে, সেগুলো ভালো সিদ্ধান্তের উদাহরণ। কারণ, বন্দরের কোনো অবকাঠামো নেই সেখানে। তবে নিউমুরিং টার্মিনালের প্রেক্ষাপট পুরো ভিন্ন। এখানে যেহেতু বন্দরের সব অবকাঠামো আছে, টার্মিনালটিও ভালোভাবে চলছে। তাই এ টার্মিনাল দেশীয় প্রতিষ্ঠান দিয়েই চালানো উচিত।
মন্তব্য করুন