ইসরায়েলের সঙ্গে ১২ দিনের যুদ্ধের পর ইরান যেন এক নতুন রূপে আবির্ভূত হয়েছে। এ যুদ্ধের প্রভাবে দেশটির সরকার ও জনগণের আচরণে পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে, যার প্রমাণ ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধবিরতির পর ইরানজুড়ে জাতীয় ঐক্যের এক বিরল প্রদর্শন। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, এই শান্তির আবরণ শিগগির গভীর সামাজিক অস্থিরতায় রূপ নিতে পারে। কেননা এই যুদ্ধ ইরানি সমাজ ব্যবস্থার গভীরে পরিবর্তন এনেছে। যুদ্ধ ইরানে কেবল সামরিক বা অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেই নয়, বরং সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিমণ্ডলেও এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে। ফলে সাড়ে তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে ইরানে কর্তৃত্ব বজায় রাখা দেশটির সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনিকে এখন নতুন এবং বহুমুখী চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হচ্ছে, যার অন্যতম হচ্ছে জনগণের আস্থা ও সামাজিক সংহতি ধরে রাখা।
যুদ্ধের পর বদলে গেছে ইরান: ইরান ইন্টারন্যাশনালের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে ইরানে যে বিরল জাতীয় ঐক্যের প্রদর্শন দেখা গেছে, তার জন্য দেশটির প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান জনগণের প্রশংসা করেছেন। তুলনামূলকভাবে মধ্যপন্থি নেতা হিসেবে পরিচিত পেজেশকিয়ান এমনকি রাজনৈতিক বন্দিদেরও তিনি প্রশংসা করেছেন। যুদ্ধকালীন সময়ে জনগণের সংযম ও ধৈর্যের জন্য তাদের ধন্যবাদ জানিয়ে তিনি বলেন, সরকার সাধারণ নাগরিকদের সুরক্ষা দিতে ব্যর্থ হলেও জনগণ রাস্তায় নামেনি, ক্ষোভ প্রকাশ করেনি।
তবে ইরান সমাজবিজ্ঞান সমিতির সভাপতি সাঈদ মোইদফার সতর্ক করে বলেছেন, ‘যদি সরকার জনগণের সঙ্গে দূরত্ব ঘোচাতে ব্যর্থ হয়, তাহলে যুদ্ধের অবসান শান্তি নয়, বরং নতুন সামাজিক সংকটের সূচনা হতে পারে।’
রাষ্ট্রায়ত্ত ও সংস্কারপন্থি গণমাধ্যমগুলো এই ঐক্যের আহ্বানকে প্রতিধ্বনিত করছে। দৈনিক ‘এতেমাদ’ ও ‘আরমান মেল্লি’ তাদের প্রথম পাতায় জাতীয় সংহতির প্রশংসা করেছে এবং বিশিষ্ট নাগরিকদের ঐক্যের বার্তা তুলে ধরেছে। তেহরান সিম্ফনি অর্কেস্ট্রা আজাদি মনুমেন্টের নিচে ‘ও ইরান’ নামে দেশাত্মবোধক সংগীত পরিবেশন করেছে, যা জনগণের মধ্যে ঐক্যের বার্তা ছড়িয়েছে।
এদিকে বিশ্লেষকদের মতে, যুদ্ধের বদলে যাওয়া ইরানের ইসলামিক মতাদর্শের ভাষা কিছুটা যেন সরে গেছে। এখন ‘ইসলামিক ইরান’-এর স্থলে ‘ইরান’ শব্দটির ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে। খামেনির সাম্প্রতিক ভাষণে ‘ইসলামিক ইরান’ শব্দযুগলটি মাত্র একবার ব্যবহৃত হয়েছে। এই পরিবর্তন সরকারের বক্তব্যে জাতীয় পরিচয়ের উপর নতুন গুরুত্ব আরোপের ইঙ্গিত দেয়।
তবে এই পরিবর্তনের পেছনে সরকারের এক ধরনের দায়বোধও লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সংস্কারপন্থি সমাজবিজ্ঞানী হামিদ রেজা জালাইপুর বলেন, ‘যুদ্ধ শেষে জনগণকে পুরস্কৃত করা সরকারের দায়িত্ব, যাতে জাতীয় ঐক্য আরও শক্তিশালী হয়।’ এমনকি কিছু রক্ষণশীল নেতাও এই সুরে কথা বলছেন। একজন সাবেক সম্পাদক বলেছেন, ‘এখন সরকারের পালা—জনগণের সহনশীলতার প্রতিদান দেওয়ার।’
খামেনির সামনে যত চ্যালেঞ্জ: ইসরায়েলের সঙ্গে ১২ দিনের যুদ্ধে শেষে ইরান এখন এক নতুন বাস্তবতার মুখোমুখি। এই পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনির সামনে রয়েছে একাধিক চ্যালেঞ্জ, যা দেশকে স্থিতিশীলতা, সংহতি ও উন্নয়নের পথে এগিয়ে নিতে পারে। বিশ্লেষকদের মতে, এসব চ্যালেঞ্জের মধ্যে রয়েছে—জাতীয় ঐক্য ও সংহতি দৃঢ় করা; ইরানের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য পুনর্জাগরণ; ভবিষ্যৎ নেতৃত্বের কাঠামো শক্তিশালীকরণ; সামাজিক সংলাপ ও পুনর্মিলন; অর্থনৈতিক পুনর্গঠন ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক জোরদার করা।
যুদ্ধোত্তর সময়েও ইরানি জনগণ যে ধৈর্য, সহনশীলতা ও সংহতির উদাহরণ স্থাপন করেছে, তা দেশবাসীর প্রতি সরকার ও নেতৃত্বের দায়িত্ব আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। এ সময়ে খামেনির সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে—এই সংহতিকে রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও রূপান্তর করা। প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান নিজেও বলেছেন, ‘জনগণ যেভাবে শান্তভাবে পরিস্থিতি মোকাবিলা করেছে, তা সরকারকে নতুনভাবে ভাবতে শেখাচ্ছে।’
এদিকে জাতীয় পরিচয়কে সামনে এনে ইরানের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে নতুনভাবে উপস্থাপন করা এখন খামেনির জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, তেহরান সিম্ফনি অর্কেস্ট্রার ‘ও ইরান’ পরিবেশনা, পত্রিকাগুলোর প্রথম পাতায় ঐক্যের বার্তা—সবকিছু মিলিয়ে সংস্কৃতি ও জাতীয়তাবাদের সমন্বিত বার্তা এসেছে। খামেনির সামনে সুযোগ রয়েছে এই সাংস্কৃতিক পুনর্জাগরণকে একটি শান্তিপূর্ণ এবং সহনশীল সমাজ নির্মাণের ভিত্তি হিসেবে ব্যবহার করার।
ভবিষ্যৎ নেতৃত্বের কাঠামো শক্তিশালী করাকেও এখন খামেনি নতুন চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা হচ্ছে। বিশ্লেষকদের মতে, বর্তমানে অনেকের নজর ইরানের ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব কাঠামোর দিকে। একজন অভিজ্ঞ ও স্থিতিশীল নেতা হিসেবে খামেনির সামনে সুযোগ রয়েছে, এই সময়কে কাজে লাগিয়ে একটি দৃঢ় ও জবাবদিহিমূলক নেতৃত্ব গড়ে তোলার, যেখানে জনগণের অংশগ্রহণ বাড়ানো যায় এবং শান্তিপূর্ণ উত্তরাধিকার নিশ্চিত হয়।
জাতীয় নিরাপত্তা কমিটির সদস্য বেনাম সাঈদি সরকারের বিরোধীদের সঙ্গে পুনর্মিলনের আহ্বান জানিয়েছেন। এটি স্পষ্টতই ইঙ্গিত দেয়, ইরানে এখন একটি উদার সংলাপের আবহ তৈরি হয়েছে। বিশ্লেষকদের মতে, খামেনির জন্য এটি একটি সুযোগ, তিনি এই পরিবেশকে আরও উৎসাহিত করে সামাজিক সম্প্রীতির ভিত্তি গড়ে তুলতে পারেন।
এদিকে যুদ্ধ ও নিষেধাজ্ঞার ফলে ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধার করা এখন জরুরি, যা খামেনির জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ হিসেবেই আবির্ভূত হয়েছে। বিশ্লেষকদের মতে, এতে প্রধান ভূমিকা রাখতে পারে সরকার, ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ও জনগণের মধ্যে বিশ্বাসভিত্তিক সম্পর্ক তৈরি করে একটি কার্যকর উন্নয়ন পরিকল্পনা। খামেনি এই পরিবর্তনের কেন্দ্রবিন্দুতে থেকে অর্থনীতির আধুনিকায়নে নির্দেশনা দিতে পারেন।
এসব ছাড়াও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক জোরদার করাকেও ইরানের সর্বোচ্চ নেতা খামেনির জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, যুদ্ধবিরতির পরে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে নতুন করে কূটনৈতিক সম্পর্ক গড়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। বোফ ক্যাফের এক কর্মচারীর মতো অনেকেই চান, বিশ্বসম্প্রদায়ের সঙ্গে সম্পর্ক আরও উন্মুক্ত হোক। খামেনির নেতৃত্বে ইরান যদি গঠনমূলক কূটনীতির পথে এগোয়, তবে তা দেশটির জন্য আরও স্থিতিশীল ভবিষ্যৎ এনে দিতে পারে।
এ ছাড়া ইরানের তরুণ প্রজন্ম এখন আরও স্বাধীনতা, কর্মসংস্থান ও বিশ্বে অংশগ্রহণের সুযোগ চাইছে। যুদ্ধোত্তর সময়ে এই প্রজন্মের আশা ও স্বপ্ন পূরণের জন্য পরিকল্পিত পদক্ষেপ নেওয়ার সুযোগ রয়েছে। খামেনি যদি যুবভিত্তিক উন্নয়ন পরিকল্পনা হাতে নেন, তাহলে তার নেতৃত্ব দেশের ভবিষ্যৎকে স্থিতিশীল ও উন্নয়নমুখী করতে পারে।
স্বাভাবিক জীবনে ফিরছে ইরানিরা: ইসরায়েলের সঙ্গে ১২ দিনের যুদ্ধের পর ইরানে ধীরে ধীরে স্বাভাবিক জীবনে ফিরছে মানুষ, তবে জনগণের মধ্যে গভীর উদ্বেগ রয়েছে। ইসরায়েলের হামলায় দেশটিতে ৬২৭ জন নিহত ও পাঁচ হাজারের বেশি মানুষ আহত হয়েছেন। তালেঘানি জেনারেল হাসপাতালের
প্রধান নার্স আশরাফ বার্ঘি বলেন, ‘আমরা ভয় পাচ্ছি, তারা আবার হামলা করতে পারে। এই যুদ্ধ শেষ হয়েছে বলে আমরা ভরসা করতে পারছি না।’ এমন পরিস্থিতিতে তেহরানের বাসিন্দারা তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন। মিনা নামে এক তরুণী বলেন, ‘আমরা ভালো জীবনের জন্য এত চেষ্টা করেছি; কিন্তু সামনে কী আছে জানি না।’ সূত্র: বিবিসি, আলজাজিরা ও ইরান ইন্টারন্যাশনাল।
মন্তব্য করুন