আতাউর রহমান
প্রকাশ : ২৫ জুলাই ২০২৫, ১২:০০ এএম
আপডেট : ২৫ জুলাই ২০২৫, ০৭:২৪ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

ওয়েটিং রুম ৪০৯

সরেজমিন বার্ন ইনস্টিটিউট
ওয়েটিং রুম ৪০৯

রাজধানীর জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের চতুর্থতলার নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (আইসিইউ)। ঘড়ির কাঁটা তখন বৃহস্পতিবার দুপুর ২টা ছুঁইছুঁই। আইসিইউ থেকে বেরিয়ে এলেন ধবধবে সাদা অ্যাপ্রোন পরা একজন চিকিৎসক। জানতে চাইলেন মাহতাবের কেউ আছেন? বুঝতে আর বাকি রইল না কিছু। ততক্ষণে আইসিইউর অদূরে ৪০৯ নম্বর কক্ষ থেকে ভেসে আসছিল বুকফাটা আর্তনাদ আর আহাজারি।

আইসিইউর সামনের ৪০৯ নম্বর কক্ষটি পরিচিত ‘ওয়েটিং রুম’ হিসেবে, সেই সাইনবোর্ড রয়েছে সেখানে। এই কক্ষেই অপেক্ষা করেন আইসিইউতে চিকিৎসাধীন দগ্ধদের স্বজনরা, যেখানে একেকটি মুহূর্ত যেন বছরের সমান। ছোট্ট এই রুমটিতে আশা-নিরাশার দোলাচলে রাত-দিন সময়ের কোনো পার্থক্য নেই। জীবনের কঠিনতম এই সময়ে প্রতিটি শ্বাস হয়ে ওঠে এক একটা যুদ্ধ। সেখানে কোনো স্বজন আশায় থাকেন, এই বুঝি ভালো খবর বয়ে আনলেন চিকিৎসক-নার্স, আবার কোনো কোনো দুঃসংবাদে শুরু হয় কান্নার রোল।

গত সোমবার রাজধানীর দিয়াবাড়িতে যুদ্ধবিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় দগ্ধ হওয়া মাইলস্টোন স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষার্থী মিলিয়ে ৪৪ জন চিকিৎসাধীন জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটে, তাদের মধ্যে ৪০৯ নম্বর ওয়েটিং রুমের পাশের আইসিউইতে গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত ৬ জনের চিকিৎসা চলছিল। এর আগে দুপুর ২টা থেকে ৪টার মধ্যে দুই ঘণ্টায় দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যু ঘোষণা করেন চিকিৎসক।

গতকাল দুপুরে সেখানে গিয়ে দেখা যায়, একঝাঁক স্বজনের উৎকণ্ঠিত চেহারা। অনেকটা বদ্ধ কক্ষে গম্ভীর হয়ে প্রার্থনায় কেউ কেউ, কোনো কোনো স্বজন সেখান থেকে বেরিয়ে মলিন মুখে করিডোরের জানালা ধরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। আইসিইউ শয্যার পাশ থেকে চিকিৎসক বা নার্স বের হলেই উদগ্রীব হয়ে তাদের ঘিরে ধরছেন সেই স্বজনরা। অজানা শঙ্কায় দগ্ধ প্রিয়জনের শরীরের সর্বশেষ খবরটুকু জানতে ব্যাকুল তারা। ভেতর থেকে আসা কোনো কোনো তথ্যে অপেক্ষার প্রহর ফুরোয় কোনো স্বজনের, শুরু হয় কান্নার রোল। আবার কখনোবা রক্তের জন্য শুরু হয় ছোটাছুটি।

ওয়েটিং রুমের সামনে উৎকণ্ঠিত হয়ে বসে ছিল ফাহিম নামে এক কিশোর। প্রশ্ন না করলেও মলিন চেহারাই জানান দিচ্ছিল, তার ভেতরটার দুমড়েমুচড়ে যাচ্ছিল অজানা কোনো শঙ্কায়। আইসিইউর দরজা দেখিয়ে ফাহিম জানায়, সেদিনের বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় ছোট ভাই আব্দুল মুসাব্বির মাকিন দগ্ধ হয়ে ভেতরে চিকিৎসাধীন। মাইলস্টোন স্কুলের সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী মাকিন।

কথা বলার সময় সেই আইসিইউ থেকে এক চিকিৎসাকর্মী বের হতেই তার পিছু পিছু ছোটেন ফাহিম, সঙ্গে আরও কয়েক স্বজন। হাঁটতে হাঁটতেই কথা হলো মো. মহসিন নামে এক স্বজনের সঙ্গে। চোখের পানি মুছে জানালেন মাকিনের বাবা তিনি।

এই বাবা আইসিউর কাচে ঘেরা দরজা দেখিয়ে বললেন, ‘ভেতরে ছেলেটা কী করছে, জানি না। তবে আমার অন্তরের ভেতরটা শেষ হয়ে যাচ্ছে। সব স্বপ্ন শেষ হয়ে যাচ্ছে।’

মো. মহসিনের সঙ্গে কথা বলার সময় ওয়েটিং রুমে মেয়ের জন্য ডুকরে কাঁদছিলেন আরেক দগ্ধ শিক্ষার্থী মাহিয়ার মা আফরোজা বেগম। মাইলস্টোনের অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী ১৫ বছর বয়সী মাহিয়া।

মাহিয়ার অন্য এক স্বজন জানালেন, বছর পাঁচেক আগে মাহিয়ার বাবা মারা গেছেন। তিন বোনের মধ্যে দগ্ধ মাহিয়া মেজ। উত্তরা ১৮ নম্বর সেক্টরে নিজেদের ফ্ল্যাটে থাকে। মা আফরোজা নিজেই প্রতিদিন মেয়েকে স্কুলে দিয়ে আসতেন। এখন সেই মেয়ের সুস্থতার অপেক্ষায় কাঁদছেন মা।

দুপুরে মাহিয়ার স্বজনের সঙ্গে কথা বলার সময়ে কে জানত, ছোট্ট মেয়েটির পরিবারের জন্যও অপেক্ষা করছে চরম বিষাদের খবর! বিকেল সাড়ে ৪টায় বার্ন ইনস্টিটিউটের চিকিৎসক জানালেন, মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে মাহিয়াও চলে গেছে পরপারে।

জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের আবাসিক চিকিৎসক ডা. শাওন বিন রহমান জানান, মাহিয়ার শরীরের ৫০ শতাংশ দগ্ধ ছিল।

বার্ন ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন যারা : চিকিৎসকরা বলেছেন, বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় অগ্নিদগ্ধদের মধ্যে জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটে ৪৪ জন চিকিৎসা নিচ্ছেন। তাদের মধ্যে গতকাল বিকেল পর্যন্ত আইসিইউতে আটজন চিকিৎসা নিলেও এ দিন মাহতাব ও মাহিয়া নামে দুই শিক্ষার্থী মারা যায়। আইসিউতে এখন মাসুমা (৩২), আয়ান (১৪), জারিফ (১২), নাভিদ নেওয়াজ (১২), সায়মন (১৮) ও শিক্ষিকা মাহফুজা খাতুন (৪৫) চিকিৎসাধীন। পোস্ট অপারেটিভ ওয়ার্ডে তাসনিয়া (১০), আলবিনা (১০), নিলয় (১৩), তাসনুবা মাহবিন (১১), রাইসা (১১), শ্রেয়া (৯), ফারজানা ইয়াসমিন (৪৫), পায়েল (১২), শিক্ষিকা নিশি (২৮), নুসরাত (১২), তৌফিক (১৩), ইউসা (১১), জাকির (৫৫), সায়েবা (৯), মুনতাহা (১০), রুপি বড়ুয়া (১০), জায়ানা (১৩), শিক্ষক আশরাফুল ইসলাম (৩৭), শিক্ষিকা সুমাইয়া লরিন (৩০), লরিন কাব্য (১৩) ও কাফী আহমেদ (১০) নামে ২১ জন চিকিৎসাধীন। এ ছাড়া হাই ডিপেন্ডেন্সি ইউনিটে (এইচডিইউ) আরিয়ান আফিফ (১২), মাকিন (১৫), রোহান (১৪), রাইয়ান (১৪), আবিদুর রহমান (১০), সাইবা জাহান (১০), সামিয়া (৯), সায়রা (১০), তাসনিয়া (১৫), মেহেরিন (১১), আইমান (১০), সবুজা বেগম (৪০) ও হাফসা খান (১১) চিকিৎসাধীন। আয়ান খান (১২) ও কাজী আমজাদ সাঈদ (২০) নামে দুজন জরুরি বিভাগে চিকিৎসাধীন।

বার্ন ইনস্টিটিউটের এক চিকিৎসক জানান, দগ্ধদের চিকিৎসায় সর্বোচ্চ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। ইনস্টিটিউটের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের সঙ্গে জাপান ও ভারতের চিকিৎসক দলও গতকাল দগ্ধদের শারীরিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ করছেন।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

ডিএমপির ডিবিপ্রধান হলেন শফিকুল ইসলাম

জম্মু-কাশ্মীরে বৈষ্ণোদেবীর মন্দিরের পথে ভয়াবহ ধস, ৩০ জনের মৃত্যু

আত্মহত্যায় সাহায্যের অভিযোগে চ্যাটজিপিটির বিরুদ্ধে মামলা

স্বপ্ন ছোঁয়ার আগেই থেমে গেল অরণ্যের জীবন

সন্তানকে বাঁচাতে মেট্রোরেলের গেট ধরে মায়ের আহাজারি

এবার নতুন কর্মসূচির ঘোষণা প্রকৌশল শিক্ষার্থীদের

অভিনেত্রী মানেই পোশাক খুলে দাঁড়িয়ে পড়বে?

প্রীতির হ্যাটট্রিকে নেপালের বিপক্ষে আরেকটি জয় বাংলাদেশের

গ্রেপ্তার ডাকসুর ভিপি প্রার্থী জালালকে নিয়ে রাশেদের পোস্ট

রাজশাহীতে সিসিএসের বিভাগীয় ভোক্তা অধিকার সম্মেলন

১০

কৃষি জমি রক্ষায় দ্রুত আইন আসছে : কৃষি উপদেষ্টা

১১

টিসিবির চাল নিয়ে বাড়ি ফেরা হলো না বৃদ্ধের

১২

সরকারি কর্মচারীদের চিকিৎসায় অনুদান মঞ্জুরির হার পুনর্নির্ধারণ

১৩

প্রবল বৃষ্টিতে বিপর্যস্ত হিমাচল প্রদেশ, ২৪৫০ কোটি টাকার ক্ষতি

১৪

কবরের আজাব ও বার্ধক্যের দৈন্য থেকে মুক্তি পেতে যে দোয়া পড়বেন

১৫

ডুবন্ত বাঁধ নির্মাণ হলে হাওরে কৃষি উৎপাদনের ক্ষতি কমানো সম্ভব : রিজওয়ানা হাসান

১৬

আমড়া ভর্তা খেয়ে হাসপাতালে ৬ শিক্ষার্থী

১৭

সিইসির সঙ্গে মার্কিন রাষ্ট্রদূতের বৈঠক বৃহস্পতিবার

১৮

‘কাজী জাফরকে বাদ দিয়ে কেউ বাংলার ইতিহাস লিখতে পারবে না’

১৯

গণঅভ্যুত্থানে আহত শিক্ষার্থীদের তথ্য চেয়ে ‘জরুরি’ নির্দেশনা

২০
X