নেপালে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বন্ধের প্রতিবাদ ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে কাঠমান্ডুতে বিক্ষোভ করেছে তরুণ প্রজন্ম। কর্মসূচির একপর্যায়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বাধা উপেক্ষা করে দেশটির পার্লামেন্টে ঢুকে পড়ে ছাত্র-জনতা। জেন-জি নেতৃত্বাধীন এ আন্দোলনে পুলিশের নির্বিচার গুলিতে অন্তত ১৯ জন নিহত হয়েছেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দমনপীড়নে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে দেশজুড়ে। তাদের এ কর্মসূচিতে সংহতি জানিয়েছেন দেশটির প্রখ্যাত শিল্পী ও বিনোদনজগতের তারকারা। তরুণদের দাবিকে গণমানুষের দাবি আখ্যা দিয়ে সাধারণ মানুষও বিক্ষোভে অংশ নেন। চাপের মুখে দাবি মেনে নেওয়ার কথা ভাবছে সরকার।
নেপালের সংবাদমাধ্যম কাঠমান্ডু পোস্টের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বন্ধের প্রতিবাদ ও সরকারি দুর্নীতি বন্ধের দাবিতে শুরু হওয়া বিক্ষোভ রাজধানী কাঠমান্ডু ছাড়াও পোখরা, বুটওয়াল, বিরাটনগর, জনকপুর, হেতৌদা, নেপালগঞ্জ, ভৈরহাওয়া, ভরতপুর, ইটাহারি, দামাকসহ দেশটির বিভিন্ন শহরে ছড়িয়েছে।
স্থানীয় সংবাদমাধ্যমে বলা হয়েছে, রাজধানীর নিউ বানেশ্বরে প্রথম বিক্ষোভ শুরু হয়। পরে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়লে রাজধানীতে কারফিউ জারি করা হয়।
কাঠমান্ডুর সরকারি হাসপাতালগুলো ১৭ জনের মৃত্যুর তথ্য নিশ্চিত করেছে। এ ছাড়া ইটাহারির সুনসারিতে গুলিবিদ্ধ হয়ে দুজন নিহত হয়েছেন। সারা দেশের হাসপাতালগুলোতে কমপক্ষে ৩৪৭ জনের চিকিৎসা নেওয়ার তথ্য জানা গেছে।
খবরে বলা হয়েছে, বানেশ্বরে ফেডারেল পার্লামেন্ট ভবনের বাইরে বিক্ষোভকারীরা প্রথমে জড়ো হয়েছিলেন। সোমবার সকালের দিকে দেশটির হাজার হাজার বিক্ষোভকারী নিরাপত্তা বাহিনীর বাধা উপেক্ষা করে পার্লামেন্ট ভবনে ঢুকে পড়েন।
এ সময় বিক্ষোভকারীদের লক্ষ্য করে গুলি, টিয়ার গ্যাসের শেল, জলকামান ছুড়েছে নিরাপত্তা বাহিনী। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সেনাবাহিনীর সদস্যদের মোতায়েনের পাশাপাশি রাজধানীতে কারফিউ জারি করেছে দেশটির সরকার।
সোমবার সকাল ৯টা থেকে বিক্ষোভকারীরা কাঠমান্ডুর মৈতিঘর এলাকায় জড়ো হয়ে বিক্ষোভ শুরু করেন। দেশটিতে সরকারের দুর্নীতি ও নানা ধরনের অনিয়মের বিরুদ্ধে সম্প্রতি আন্দোলনকারীরা ‘নেপো কিড’ এবং ‘নেপো বেবিস’ নামে বিভিন্ন ধরনের হ্যাশট্যাগ ব্যবহার করে অনলাইনে পোস্ট করেন। সরকারবিরোধী এসব হ্যাশট্যাগ অনলাইনে ব্যাপক ট্রেন্ডে পরিণত হয়েছে।
দেশটির সরকার নিবন্ধনহীন ২৬টি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর এ ক্ষোভে ফেটে পড়েন আন্দোলনকারীরা। তারা অনলাইনের আন্দোলনকে সড়কে নেওয়ার ডাক দেন।
কাঠমান্ডু জেলা প্রশাসন কার্যালয়ের তথ্যানুযায়ী, ‘হামি নেপাল’ নামে একটি সংগঠন প্রশাসনের অনুমতি নিয়ে সোমবার বিক্ষোভ সমাবেশের আয়োজন করে। সংগঠনটির চেয়ারম্যান সুধান গুরুং বলেছেন, সরকারের কর্মকাণ্ড ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে এ বিক্ষোভের ডাক দেওয়া হয়েছে। সোমবার দেশজুড়ে এ কর্মসূচি পালন করা হয়।
আয়োজকরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিক্ষোভের বিভিন্ন রুট এবং নিরাপত্তা নির্দেশনা শেয়ার করছেন। তারা শিক্ষার্থীদের ইউনিফর্ম পরে বই হাতে নিয়ে বিক্ষোভে যোগ দেওয়ার আহ্বানও জানিয়েছেন।
সরকারি দুর্নীতি এবং সাম্প্রতিক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে জেন-জি প্রজন্মের বিক্ষোভকারীরা পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ার পর কাঠমান্ডু জেলা প্রশাসন কার্যালয় সেখানে কারফিউ জারি করেছে।
সোমবার সকালের দিকে বানেশ্বর জেলার কিছু নিষিদ্ধ এলাকায় প্রবেশ করলে সেখানে কারফিউ জারি করা হয়। পরে দেশটির রাষ্ট্রপতির বাসভবন শীতলনিবাস, উপরাষ্ট্রপতির বাসভবন লেইনচৌর, প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন বালুয়াটার এবং এর আশপাশের এলাকায় কারফিউ জারি করে কর্তৃপক্ষ।
নেপালের জাতীয় মানবাধিকার কমিশন এক বিবৃতিতে নিরাপত্তা বাহিনী ও বিক্ষোভকারীদের সংযত থাকার আহ্বান জানিয়েছে। কমিশন বলছে, সংবিধান ও আন্তর্জাতিক আইন শান্তিপূর্ণভাবে ভিন্নমত প্রকাশের অধিকার নিশ্চিত করে এবং সহিংসতা ও অতিরিক্ত বলপ্রয়োগের ঘটনা দুঃখজনক।
বিক্ষোভকারীদের বেশিরভাগই জেন-জির সদস্য। তারা মূলত দেশজুড়ে দুর্নীতির বিরুদ্ধে বিক্ষোভ শুরু করেন। তারা একে রাজনৈতিক নেতৃত্বের ব্যর্থতা দেখে। এতে দেশজুড়ে শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষ অংশ নেন।
বিক্ষোভ কর্মসূচি ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ায় কয়েকটি জেলায় কারফিউ জারি করে স্থানীয় প্রশাসন। যেসব এলাকায় সমাবেশ বিশাল হয়েছে, সেসব স্থানে কর্মসূচি ও চলাচল সীমিত করার নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে।
রাজধানীসহ সারা দেশে নিরাপত্তা বাহিনীর টহল বাড়ানো হয়েছে। সহিংসতার পর বর্তমানে হাসপাতালগুলোতে হতাহতের সংখ্যা বাড়ছে। চিকিৎসাকেন্দ্রগুলো জরুরি রক্তের চাহিদা বেড়েছে।
সরকারকে সতর্ক করছেন বিশ্লেষকরা: সোমবারের বিক্ষোভ ও সহিংসতার পর নেপালের প্রখ্যাত লেখক, চিকিৎসক, শিল্পী, সাবেক আমলারা জেন-জিদের দাবি মেনে নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। তারা সতর্ক করে বলেছেন, যেন তরুণদের দাবির অবমূল্যায়ন না করা হয়।
নেপালের ইনস্টিটিউট অব মেডিসিনের সাবেক ডিন ড. অরুন স্বামী বলেন, আজকের যুবকরা তাদের (সরকার) দাস নন। রাজা জ্ঞানেন্দ্রের (যাকে ২০০৮ সালে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করা হয়েছিল) মতো আচরণ বন্ধ করুণ। অবিলম্বে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ওপর থেকে বিধিনিষেধ তুলে নিন।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. অরুনা উপ্রেতি বলেন, এ সরকার জ্ঞানেন্দ্র শাহের পদাঙ্ক অনুসরণ করে যুবকদের বিরুদ্ধে অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ করেছে। লেখক খগেন্দ্র সাংরাউলা বলেছেন, সোমবারের ঘটনাগুলো বর্তমান সরকার ও ক্ষমতাসীন দলগুলোর আসল চেহারা উন্মোচিত করেছে। দেশটির সাধারণ মানুষের ভাষ্য, এ তরুণরা কোনো রাজনৈতিক দলের অন্ধ দাস নন।
বিক্ষোভে তারকাদের সমর্থন: অভিনেতা মদনকৃষ্ণ শ্রেষ্ঠ ও হরিবংশ আচার্য ফেসবুকে প্রকাশ্যে বিক্ষোভকারীদের প্রতি নিজেদের সমর্থন জানিয়েছেন। তারা তরুণদের নেতৃত্বাধীন আন্দোলনের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। গায়ক ও অভিনেতা প্রকাশ সাপুত দুই ভাই সুনীল ও শচীনকে বিক্ষোভে যোগ দিতে উৎসাহ দিয়েছেন। তিনি জানিয়েছেন, গত মাসে ইউটিউব থেকে আয় হওয়া অর্থ থেকে দুই ভাইয়ের প্রত্যেকের জন্য ২৫ হাজার রুপি করে পাঠিয়েছেন। এ অর্থ দিয়ে তাদের পানি সরবরাহ করতে ও শরীর আর্দ্র রাখার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
অভিনেতা ও পরিচালক নিশ্চল বসনেত টিকটকের মাধ্যমে বিক্ষোভকারীদের প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন এবং রাজনীতিবিদদের সমালোচনা করেছেন। অভিনেত্রী বর্ষা রাউত কাঠমান্ডুর বাইরে থাকলেও টিকটকের মাধ্যমে আন্দোলনকারীদের প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন। তিনি বিক্ষোভে অংশ নিতে অন্যদের উৎসাহিত করেছেন।
অভিনেতা আনমল কে সি, প্রদীপ খদকা, ভোলারাজ সাপকোটা, বর্ষা শিবাকোটি এবং সংগীতশিল্পী এলিনা চৌহান, রচনা রিমাল ও সমীক্ষা অধিকারীও আন্দোলনের প্রতি সংহতি জানিয়ে সবাইকে এতে অংশগ্রহণের আহ্বান জানিয়েছেন। অন্যান্য শিল্পীও প্রকাশ্যে বিক্ষোভকে সমর্থন জানিয়ে যাচ্ছেন।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের নিষেধাজ্ঞা তুলতে পারে নেপাল: নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডুতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং জেন-জি বিক্ষোভকারীদের সংঘর্ষে এ পর্যন্ত ১৯ জন নিহত হয়েছেন। বিক্ষোভ প্রশমনে এরই মধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোর ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলতে আলোচনা শুরু হয়েছে সরকারের মধ্যে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীরপদত্যাগ: বিক্ষোভাকারীদের ওপর নির্বিচারে গুলির ঘটনায় ব্যাপক সমালোচনার মুখে নেপালের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রমেশ লেখক পদত্যাগ করেছেন। গতকাল সন্ধ্যায় বালুওয়াতারে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে মন্ত্রিসভার বৈঠকে তিনি প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা ওলির কাছে পদত্যাগপত্র জমা দেন।
এর আগে নেপাল কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক গগণ থাপা ও বিশ্ব প্রকাশ শর্মা নৈতিকতার ভিত্তিতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করেন।
মন্তব্য করুন