

স্বাস্থ্য খাতের ‘মাফিয়া ঠিকাদার’ খ্যাত মোতাজ্জেরুল হক মিঠুর নানা অনিয়ম-দুর্নীতির তথ্য সামনে আসে প্রায় এক যুগ আগে। বিষয়টি দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) পর্যন্ত গড়ায়। কিন্তু দুদকের প্রভাবশালী কিছু কর্মকর্তার সহায়তায় মিঠু হয়ে ওঠেন অপ্রতিরোধ্য। বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতিতে সম্পৃক্ততার তথ্য প্রকাশ্যে এলে দুদকের প্রভাবশালীরাই তার দায়মুক্তির ব্যবস্থা করতেন। এমনকি স্বাস্থ্য খাতের কাজ বাগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে কোনো সরকারি কর্মকর্তা বা ঠিকাদারকে প্রতিবন্ধকতা মনে করলেই তাকে প্রশাসন ব্যবহার করে হেনস্তার অভিযোগ রয়েছে বহুল বিতর্কিত এ ঠিকাদারের বিরুদ্ধে। সরকারি একটি সংস্থার তথ্যানুযায়ী, দুদককে কেন্দ্র করে মিঠুর গড়ে ওঠা সিন্ডিকেটের হোতা ছিলেন সংস্থাটির সাবেক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ, পরিচালক সৈয়দ ইকবাল হোসেন এবং তৎকালীন আরও এক পরিচালক ও এক উপপরিচালক। বিতর্কিত ঠিকাদার মিঠুর সঙ্গে তাদের সখ্য ছিল ওপেন সিক্রেট। চক্রটিকে কাজে লাগিয়ে মিঠু নিজের সব অপরাধ ‘বৈধ’ করে নিতেন। সেইসঙ্গে প্রতিপক্ষকে হয়রানি ও বেআইনিভাবে মামলার জালে ফেলে ঘায়েল করতেন। যদিও এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন অভিযুক্তরা।
সরকারি একটি সংস্থার প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০১৫ সালের ২৯ অক্টোবর থেকে প্রায় ছয় বছর দুদকের পরিচালক হিসেবে কাজ করেছেন সৈয়দ ইকবাল হোসেন। এ সময়ে মিঠুর সঙ্গে তার সখ্য গড়ে ওঠে। ইকবাল হোসেন ঠিকাদার মিঠু ও তার স্ত্রী নিশাত ফারজানা চৌধুরীর সম্পদ বিবরণী দুদকে দাখিলের সময় বৃদ্ধি করেন। এরপর তাদের দুজনের আর সম্পদ বিবরণী দাখিল করতে হয়নি। এক্ষেত্রে ইকবাল হোসেনের সঙ্গে ভূমিকা রাখেন দুদকের সাবেক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ ও এক উপপরিচালক। দুদকের তৎকালীন আরেক পরিচালক রাজধানীর বনানী ডিওএইচএসে মিঠুর স্ত্রীর নামে কেনা ফ্ল্যাটে কয়েক বছর ধরে থেকেছিলেন। তার স্ত্রীর দাখিল করা আয়কর রিটার্ন ফাইলে বসবাসের ঠিকানা হিসেবে ফ্ল্যাটটির কথা উল্লেখ করা হয়। বিষয়টি জানাজানি হলে এ কর্মকর্তা ওই ফ্ল্যাট ছেড়ে দেন। কালবেলার হাতে এ-সংক্রান্ত প্রমাণ রয়েছে। দুদকের তৎকালীন এক উপপরিচালক পরিচিত ছিলেন মিঠুর ডান হাত হিসেবে। এই দুদক কর্মকর্তার সঙ্গে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের ঘনিষ্ঠ শীর্ষ এক ব্যবসায়ীর ছিল সম্পর্ক। মিঠুর সঙ্গে ওই ব্যবসায়ীর সখ্যের পেছনেও ছিল এ দুদক কর্মকর্তার হাত। বেপরোয়া মিঠু নিজেকে আরও শক্তিশালী করতে দুদকের সাবেক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদের ভাই সাদিক মাহমুদকে নিজের ব্যবসায়িক পার্টনার করে নেন। ফলে নিজের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে গোটা দুদকের প্রভাব।
যেভাবে দেওয়া হতো দায়মুক্তি: দিনাজপুর মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে যন্ত্রপাতি মেরামতের জন্য ২০১৩-১৪ অর্থবছরে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে বরাদ্দ দেওয়া হয় ১ কোটি টাকা। ওই টাকা থেকে আগের অর্থবছরে ৭ হাজার ৫০০ টাকায় কেনা একটি বেবি স্ক্যানার মেশিনের তিনটি যন্ত্রাংশ মেরামত বাবদ বিল দেখানো হয় ৪ লাখ ১১ হাজার ৯০০ টাকা। ৫ লাখ ৯৪ হাজার টাকার একটি কার্ডিয়াক মনিটরের তিনটি যন্ত্রাংশ পরিবর্তনের বিল ৬ লাখ ৬৮ হাজার ৫০০ টাকা এবং ৬ লাখ ৫৯ হাজার টাকায় কেনা একটি ফটোথেরাপি মেশিনের দুটি যন্ত্রাংশ পরিবর্তনের বিল দেখানো হয় ৬ লাখ ৪০০ টাকা। এ ছাড়া ২২টি যন্ত্রপাতি মেরামত কিংবা পরিবর্তন না করেই বিল দেখানো হয় ৭৪ লাখ ৯৮ হাজার টাকা। এসব বিল তুলে নেয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ব্লেয়ার এভিয়েশন। এর মালিক মোকছেদুল ইসলাম। তিনি স্বাস্থ্য খাতে কেনাকাটার অধিকাংশ কাজ পাওয়া সম্প্রতি গ্রেপ্তার হওয়া আলোচিত ঠিকাদার মিঠুর বড় ভাই।
দুদকের তৎকালীন সহকারী পরিচালক আমিরুল ইসলাম তদন্ত করে এ দুর্নীতির তথ্য-প্রমাণ পান। এরপর তিনি ২০১৫ সালের ২৫ আগস্ট মোকছেদুল ইসলামসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে দিনাজপুর কোতোয়ালি থানায় মামলা করেন। আমিরুল ইসলামের অভিযোগপত্রে দেখা যায়, তদন্তকালে তিনি সরকারি যন্ত্রপাতি মেরামতকারী প্রতিষ্ঠান নিমিউ অ্যান্ড টিসির প্রকৌশলী আবুল হোসেনকে দিয়ে মেরামত করা যন্ত্রপাতি যাচাই-বাছাই করান। তার দেওয়া তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে যন্ত্রপাতি মেরামতে দুর্নীতির প্রমাণ মেলে। এর পরই আমিরুল ইসলাম মামলা করেন। তবে শেষ পর্যন্ত আমিরুল ইসলামের করা মামলাটি আর রাখেনি দুদক। ২০১৯ সালে দুর্নীতির মামলা থেকে অব্যাহতি পান মিঠুর ভাই মোকছেদুল।
আমিরুল ইসলামের মামলাটি পরে অধিকতর তদন্তের জন্য পরপর দুই উপপরিচালককে দায়িত্ব দেওয়া হয়। এর মধ্যে এক কর্মকর্তা দীর্ঘ ছয় বছর পর ২০১৯ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর একটি প্রতিবেদন জমা দেন। এতে তিনি মেরামতকাজে কোনো দুর্নীতি ও আসামিদের বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাতের ঘটনা প্রমাণ হয়নি বলে উল্লেখ করেন। তার প্রতিবেদনের শেষে লেখা হয়েছে, ‘অনিয়ম পরিলক্ষিত হলেও আত্মসাতের অসৎ উদ্দেশ্য/আত্মসাতের ঘটনা পরিলক্ষিত হয়নি।’ দিনাজপুরের ঘটনার অর্থবছরেই (২০১৩-১৪) রংপুর সিভিল সার্জন অফিসের আওতায় সাত উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যন্ত্রপাতি ক্রয়ের দরপত্র আহ্বান করা হয়। ওই দরপত্রে কাজ পায় মোকছেদুল ইসলামের আরেক প্রতিষ্ঠান কিউসোর্স। দরপত্রের কার্যাদেশ দেওয়া হয় ২০১৬ সালের ২৯ মে। পরদিন ৩০ মে সাত উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে জার্মানি, ব্রাজিল, কোরিয়া, ইউএসএ, তাইওয়ান, পোল্যান্ড, চীন ও জাপান—এই আটটি দেশের তৈরি যন্ত্রপাতি সরবরাহ দেখিয়ে মন্ত্রণালয় থেকে ২৪ কোটি ৮৮ লাখ ৯৯০ টাকা উত্তোলন করা হয়।
এ অনিয়মের তদন্তে গঠিত দুদকের সহকারী পরিচালক আমিরুল ইসলামের অনুসন্ধান প্রতিবেদনে বলা হয়, যন্ত্রপাতি সরবরাহ না করেই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে বিল প্রদান করা হয়েছে। কারণ, ২০১৬ সালের ২৯ মে কার্যাদেশ পাওয়ার পরদিন আটটি দেশের যন্ত্রপাতি আমদানি করে তা হাসপাতালে সরবরাহ করা সম্ভব নয়। এ ছাড়া তিনি অনুসন্ধানকালে সরবরাহকৃত যন্ত্রপাতির আমদানি-সংক্রান্ত কোনো রেকর্ডপত্রও পাননি বলে উল্লেখ করেন।
আমিরুল ইসলাম তদন্ত প্রতিবেদনে লিখেছেন, পরিদর্শনকালে অধিকাংশ মূল্যবান যন্ত্রপাতির গায়ে প্রস্তুতকারী দেশের খোদাই করা মনোগ্রাম পাওয়া যায়নি। পৃথক স্টিকারে প্রস্তুতকারী দেশের নাম যন্ত্রপাতির গায়ে আঠা দিয়ে লাগিয়ে রাখা হয়েছে। পাশাপাশি বাজারদরের চেয়ে ১০ থেকে ১২ গুণ মূল্যে যন্ত্রপাতি সরবরাহ করা হয়েছে বলে ধারণা করে পরিদর্শন দল। তদন্ত কর্মকর্তা আমিরুল ইসলাম বর্তমানে অবসরে। তিনি বলেন, ‘দিনাজপুর ও রংপুরের হাসপাতালগুলোয় যন্ত্রপাতি কেনাকাটা ও মেরামত-সংক্রান্ত বিষয়গুলোর তদন্ত ও অনুসন্ধানে দুর্নীতির প্রমাণ পাওয়া যায়। এর পরই আমাকে রংপুর থেকে রাজশাহী বদলি করা হয়। পরে জানতে পেরেছি, অধিকতর তদন্ত করে দুর্নীতির প্রমাণ পাওয়া যায়নি।’
আমিরুল ইসলাম বলেন, ‘দিনাজপুরে সাত হাজার ৫০০ টাকায় ক্রয় করা একটি বেবি স্ক্যানার মেশিনের তিনটি যন্ত্রাংশ মেরামত বাবদ চার লাখ ১১ হাজার ৯০০ টাকা বিল দেখানো হয়। তার প্রমাণসহ মামলা করেছিলাম। রংপুরে কার্যাদেশ পাওয়ার পরদিন কীভাবে জার্মানি, ব্রাজিল, কোরিয়া, ইউএসএ, তাইওয়ান, পোল্যান্ড, চীন ও জাপান থেকে যন্ত্রপাতি আনা সম্ভব? এটিরও প্রমাণসহ মামলার সুপারিশ করেছি। কিন্তু পরে এই দুর্নীতিও নাকি প্রমাণ হয়নি।’
এসব বিষয়ে বক্তব্য জানতে ঠিকাদার মোকছেদুল ইসলামের মোবাইল ফোনে কল করা হলে তা বন্ধ পাওয়া যায়।
দুদকের কাগজপত্র ঘেঁটে দেখা যায়, ২০১১-১২ অর্থবছরে মিঠুর বিরুদ্ধে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত ৫০ কোটি ১৫ লাখ ৫১ হাজার ২৩৪ টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ তদন্তে নামে দুদক। এজন্য ২০১৩ সালের ২ ডিসেম্বর মিঠু ও তার স্বজনের স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের হিসাব চেয়ে চিঠি দেওয়া হয়। চিঠি পাওয়ার সাত কর্মদিবসের মধ্যে তাকে দুদকে সম্পদের হিসাব জমা দিতে বলা হয়। কিন্তু ২০১৫ সালের ২৬ জানুয়ারি মিঠুর পক্ষে তার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান লেক্সিকোন মার্চেন্ডাইজের এক কর্মকর্তা দুদকের চিঠি গ্রহণ করেন। এ-সংক্রান্ত তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, হাইকোর্টের রিটের কারণে অনুসন্ধান কার্যক্রম স্থগিত থাকায় চিঠি পৌঁছাতে এ বিলম্ব হয়।
দুদক পরে মিঠু ও তার কর্মচারীর সাক্ষ্য গ্রহণ করে। এরপর জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ বিস্তারিত অনুসন্ধান করে দুর্নীতির প্রমাণ না পাওয়ার কথা উল্লেখ করে অনুসন্ধান কার্যক্রম সমাপ্ত ঘোষণা করা হয়। ২০১৭ সালের ১৯ ডিসেম্বর মিঠুকে অব্যাহতি দিয়ে মামলায় ‘চূড়ান্ত রিপোর্ট সত্য’ (এফআরটি) দাখিল করে দুদক। ২৮ ডিসেম্বর দুদকের তদন্ত কর্মকর্তা ওই এফআরটি আদালতে দাখিল করে মিঠুকে মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়ার আবেদন করেন। এর পর মিঠু মামলা থেকে অব্যাহতি পান। দুদকের এক কর্মকর্তা বলেন, সুনির্দিষ্ট অঙ্ক দিয়ে অবৈধ সম্পদের অনুসন্ধান শুরু করার পর যে প্রক্রিয়ায় আসামিকে অব্যাহিত দেওয়া হয়েছে, তা সন্দেহজনক।
এ ব্যাপারে বক্তব্য জানতে দুদকের সাবেক পরিচালক সৈয়দ ইকবাল হোসেনের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করেও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।
মন্তব্য করুন