দোকানে ছিল অন্তত ১০ কোটি টাকার স্বর্ণালংকার। কিন্তু নিরাপত্তা ব্যবস্থা বলতে শুধু ভেতরে স্থাপন করা ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা (সিসি ক্যামেরা), আর বাইরের শাটারে লাগানো কয়েকটি তালা। যেগুলো ভেঙে অনায়াসেই প্রায় ৫০০ ভরি স্বর্ণ চুরি করে নিয়ে গেছে দুই চোর। গত বুধবার রাত ৩টার দিকে রাজধানীর মালিবাগের ফরচুন শপিংমলের দ্বিতীয় তলার একটি জুয়েলারির দোকানে ঘটেছে চাঞ্চল্যকর এই চুরির ঘটনা। এর আগে গত ৫ অক্টোবর রাতে রাজধানী ঢাকারই যাত্রাবাড়ী চৌরাস্তা-সংলগ্ন রায়হান সুপার মার্কেটের একটি জুয়েলারি দোকান থেকে চুরি যায় আরও ১২৫ ভরি স্বর্ণ। আর এমন চুরির জন্য মার্কেটগুলোর নামমাত্র নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে দায়ী করছেন ভুক্তভোগী ব্যবসায়ীরা।
মালিবাগের ফরচুন শপিংমলের শম্পা জুয়েলার্সে সবশেষ চুরির ঘটনা ঘটেছে। তদন্ত সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তা এবং মার্কেটটি পরিচালনা সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিপণিবিতানটির বিভিন্ন স্থানে সিসি ক্যামেরা বসানো থাকলেও সচল ছিল না তার অনেকগুলো। এ ছাড়া ক্যামেরাগুলো মনিটর করার জন্য দক্ষ কেউ ছিলেন না। এমন একজনকে দায়িত্বে রাখা হয়েছিল, যিনি এই মনিটরিংয়ের বিষয়ে ততটা ভালো জানেন না। এর বাইরে পালা করে চারজন নিরাপত্তারক্ষী মার্কেটের বাইরের নিরাপত্তায় দায়িত্ব পালন করেন। তাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে বোরকা পরিহিত দুজন মার্কেটে ঢুকে শম্পা জুয়েলার্স থেকে চুরি করে নিয়ে যায় বিপুল পরিমাণ স্বর্ণালংকার।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) রমনা বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মো. মাসুদ আলম বলেন, ‘বাইরে নিরাপত্তারক্ষী থাকার পরও কীভাবে তারা (দুজন চোর) ভেতরে প্রবেশ করেছে এবং বেরিয়ে গেছে, তা আমরা খতিয়ে দেখছি। ফুটেজে দেখা যাওয়া দুজনই বোরকা পরা ছিল এবং তাদের মুখ ঢাকা ছিল। যে কারণে তাদের চেহারা বোঝা যাচ্ছে না। আমরা তাদের শনাক্ত করার চেষ্টা করছি।’
শম্পা জুয়েলার্সের মালিক অচিন্ত্য কুমার বিশ্বাস জানান, বুধবার রাত ৯টার দিকে তিনি ও তার কর্মচারীরা দোকান বন্ধ করে বাসায় চলে যান। সকালে মার্কেটের নিরাপত্তাকর্মীরা খবর দিলে এসে দেখেন তার দোকানে চুরি হয়েছে। তিনি দাবি করেন, দুই চোর তার দোকানের তালা ভেঙে ৪০০ ভরি নিজস্ব স্বর্ণালংকার এবং ১০০ ভরি বন্ধকি স্বর্ণ নিয়ে গেছে। এ ছাড়া ক্যাশবাক্সে থাকা ৪০ হাজার টাকাও নিয়ে গেছে চোরেরা।
অচিন্ত্য কুমার বলেন, ‘আমার সব শেষ হয়ে গেছে। তিল তিল করে এই পর্যন্ত আসছিলাম। এক রাতে আমার সব নিয়ে গেল। দারোয়ানরা (মার্কেটের নিরাপত্তারক্ষীরা) এই চুরির সঙ্গে জড়িত থাকতে পারে।’
এর আগে গত ৫ অক্টোবর রাতে যাত্রাবাড়ী চৌরাস্তাসংলগ্ন রায়হান সুপার মার্কেটের দ্বিতীয় তলায় ‘লিলি গোল্ড হাউস’ নামে একটি স্বর্ণের দোকানে চুরি হয়। দোকানের পাশের একটি দেয়াল ভেঙে চোররা প্রায় ১২৫ ভরি স্বর্ণালংকার ও আড়াই লাখ টাকা নিয়ে যায় বলে অভিযোগ করেন দোকান মালিক জাবির হোসেন। তার ভাষ্য অনুযায়ী, ৫ অক্টোবর রাত ৯টা থেকে ৬ অক্টোবর সকাল ১০টার মধ্যে কোনো এক সময়ে চোররা পাশের ৩ নম্বর দোকানের দেয়াল ভেঙে ২ নম্বর দোকানে প্রবেশ করে। তারা দোকানের ভল্টে থাকা ১২৫ ভরি স্বর্ণালংকার এবং ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা নিয়ে যায়।
জাবির হোসেন বলেন, ‘দোকানে থাকা সিসিটিভি ক্যামেরার ডিভাইসটিও নিয়ে গেছে চোররা। দোকানঘেঁষা পাশের দোকানটি দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ ছিল, যেটি ব্যবহার করে এ চুরির ঘটনা ঘটানো হয়েছে।’
এর আগেও রাজধানীর বিভিন্ন মার্কেটের তালা ভেঙে স্বর্ণের দোকানে চুরি হয়েছে। এ ধরনের ঘটনাগুলোর তদন্তে সম্পৃক্ত থানা পুলিশ এবং গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অন্য মালপত্র বা বস্তুর চেয়ে পরিমাণে তুলনামূলক অনেক কম এবং দাম আকাশছোঁয়া হওয়ায় চোররা মার্কেটে মার্কেটে ঘুরে জুয়েলারির দোকান টার্গেট হিসেবে নির্ধারণ করে। এরপর টার্গেট করা দোকানটি পর্যবেক্ষণে রাখা হয়। মালিক ও কর্মচারীদের গতিবিধি নজরদারির পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট মার্কেটের নিরাপত্তা ব্যবস্থা কীভাবে ভেদ করে এতে প্রবেশ করা যায়, তার একটা ছক আঁকে। তারপর একটা দিন, সময় ঠিক করে চোর চক্রের সদস্যরা সব নিয়ে পালায়।
ডিবি রমনা বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘মার্কেটগুলোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা আপডেট (হালনাগাদ) করা জরুরি। আগে আমরা বলতাম শুধু সিসি ক্যামেরা স্থাপন করতে। কিন্তু এখন শুধু ক্যামেরা স্থাপন করলেই হবে না, ক্যামেরাগুলো মনিটর করার ব্যবস্থা রাখতে হবে। একই সঙ্গে এখন ডিজিটাল সিকিউরিটি লক এবং সেন্সরড ক্যামেরা এসেছে, যার মাধ্যমে চোর তালা ভাঙার চেষ্টা করলে বা দোকান বন্ধের সময় কেউ আশপাশে চলাচল করলে বার্তা চলে যাবে মালিকের কাছে। এর পাশাপাশি উচ্চ শব্দে বেজে ওঠে সাইরেন, যাতে নিরাপত্তারক্ষী এবং মালিক উভয়েই সতর্ক হয়, চোররাও তখন পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। এর ফলে চুরির পর চোরের পিছু পিছু না দৌড়ে আগেই প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়।’
মার্কেটগুলোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও জোরদারের তাগিদ দিয়েছেন বাংলাদেশ জুয়েলার্স অ্যাসোসিয়েশনের নির্বাহী কমিটির সদস্য দেওয়ান আমিনুল ইসলামও। তিনি বলেন, ‘মার্কেটগুলোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা ঢেলে সাজানো প্রয়োজন। একের পর এক চুরির ঘটনায় ব্যবসায়ীরা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। কেউ কেউ সব হারিয়ে পথে বসছেন।’
মন্তব্য করুন