জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে যখন উত্তাপ বাড়ছে, ঠিক তখনই নতুন বিতর্কের জন্ম দিয়েছে একটি শব্দ—‘সেফ এক্সিট’ (নিরাপদ প্রস্থান)। জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামের অভিযোগের পর সারা দেশে এ নিয়ে নানা গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ে। নাহিদ দাবি করেছিলেন, অনেক উপদেষ্টা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন এবং নিজেদের সেফ এক্সিট নিয়ে ভাবছেন। এরপর এনসিপির আরেক নেতা সারজিস আলমও উপদেষ্টাদের সেফ এক্সিট নিয়ে কথা বলেন। এসব বক্তব্যে রাজনৈতিক অঙ্গনে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। কারা সেফ এক্সিট চান বা কেন সেফ এক্সিট প্রয়োজন, সে বিষয়ে এনসিপির কেউ পরিষ্কার করেননি। যদিও উপদেষ্টাদের অনেকের পক্ষ থেকে বিষয়টি পরিষ্কার করার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন। উপদেষ্টারা আরও বলেছেন, তাদের এমন প্রস্থানের প্রয়োজন নেই। তবে এ নিয়ে কৌতূহলের শেষ নেই—কার কেন দরকার ‘সেফ এক্সিট’, সেসব নিয়ে চলছে বিস্তর আলোচনা।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, কয়েকটি কারণে ‘সেফ এক্সিট’ শব্দটি হঠাৎ আলোচনায় এসেছে। এটি মূলত ক্ষমতাকেন্দ্রিক টানাপোড়েন ও পারস্পরিক অবিশ্বাস, আসন্ন নির্বাচনের আগে অবস্থান শক্ত করা, উপদেষ্টাদের মধ্যে দায়িত্ব ও মতবিরোধ, মিডিয়া ও জনমতের প্রভাব তৈরি করার কৌশল। তারা বলছেন, সেফ এক্সিট বিতর্ক পুরোটাই রাজনৈতিক; আগামী নির্বাচন ও রাজনীতির গতি-প্রকৃতিকে প্রভাবিত করতেই মূলত এই আলোচনা জোর পেয়েছে। অন্যদিকে নাহিদ ইসলাম এই সরকারেরই একজন সাবেক উপদেষ্টা। তার কাছ থেকে যখন এ ধরনের মন্তব্য আসে তখন সেটা নিঃসন্দেহে গুরুত্ব পায়।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. মোশাররফ হোসেন কালবেলাকে বলেন, “এ ধরনের অভিযোগ সাধারণত রাজনৈতিক অবিশ্বাস ও আস্থাহীনতার ইঙ্গিত দেয়। অনেক সময় এটি কৌশলগত বার্তা হিসেবেও ব্যবহার হয়—ভেতরের অবস্থান জানানোর বা চাপ সৃষ্টি করার জন্য। উপদেষ্টা বা নীতিনির্ধারকদের ‘সেফ এক্সিট’ প্রসঙ্গ তোলা মানে মূলত ভবিষ্যৎ ক্ষমতার সমীকরণে জায়গা দখলের লড়াই শুরু হওয়া। এটা সরাসরি নির্বাচনী মনস্তত্ত্বেও প্রভাব ফেলে।”
সম্প্রতি একটি বেসরকারি টেলিভিশনে দেওয়া সাক্ষাৎকারে নাহিদ ইসলাম বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টাদের অনেকেই বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে লিয়াজোঁ রেখেছে এবং তারা নিজেদের সেফ এক্সিটের কথাও ভাবছে। তার এ মন্তব্যেই মূলত বিতর্কের সূচনা। রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের মধ্যে নাহিদের মন্তব্য নিয়ে কথা বলছে। বিভিন্ন আলোচনা হচ্ছে সরকারের ভেতরেও। তবে সেফ এক্সিট প্রশ্ন তুললেও নাহিদ সুনির্দিষ্ট করে কোনো উপদেষ্টার নাম বলেননি।
সাক্ষাৎকারে নাহিদ ইসলাম আরও বলেছেন, রাজনৈতিক দলের নেতাদের এবং যারা উপদেষ্টা হয়েছেন, তাদের অনেককে বিশ্বাস করাটা আমাদের অবশ্যই ভুল হয়েছিল। আমাদের উচিত ছিল ছাত্রনেতৃত্বকেই শক্তিশালী করা, সরকারে গেলে সম্মিলিতভাবে যাওয়া।’ তিনি আরও যোগ করেন, ‘নাগরিক সমাজ বা রাজনৈতিক দলকে আমরা যে বিশ্বাসটা করেছিলাম, যে আস্থা রেখেছিলাম, সেই জায়গায় আসলে আমরা প্রতারিত হয়েছি।’ তিনি দাবি করেন, ‘অনেক উপদেষ্টা নিজেদের আখের গুছিয়েছেন অথবা গণঅভ্যুত্থানের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা (বিট্রে) করেছেন। যখন সময় আসবে, তখন আমরা এদের নামও উন্মুক্ত করব।’
নাহিদ ইসলামের বক্তব্যের পর একই ইস্যুতে আরও আক্রমণাত্মক মন্তব্য করেন এনসিপির উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম। তিনি বলেন, ‘কিছু উপদেষ্টার মধ্যে দেখা যাচ্ছে, তারা কোনোভাবে দায়সারা দায়িত্ব পালন করেন, নির্বাচনের মধ্য দিয়ে এক্সিট নিতে পারলেই হলো, দেশে থাকুক আর দেশের বাইরেই থাকুক। এ দায়সারা দায়িত্ব নেওয়ার জন্য অভ্যুত্থান-পরবর্তী একটি সরকার কাজ করতে পারে না। তারা এত শহীদ, রক্তের ওপরে দাঁড়িয়ে ওখানে (সরকারে) আছেন। তারা যদি এমনটা করে থাকেন, তাহলে দেশের মানুষের সামনে মুখ দেখাতে পারবেন না। যারা এ ধরনের চিন্তা করেন তাদের জন্য মৃত্যু ছাড়া কোনো সেফ এক্সিট নেই। পৃথিবীর যে প্রান্তে যাক বাংলাদেশের মানুষ তাদের ধরবে।’
পরে এ বিষয়ে কালবেলাকে সারজিস আলম বলেন, ‘সেফ এক্সিট বলতে দেশ ছেড়ে চলে যাওয়াকে বোঝানো হয়েছে ব্যাপারটা এমনও নয়। কিন্তু অভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশে যখন কিছু উপদেষ্টার কথায় গণহত্যাকারীদের বিচার ও মৌলিক সংস্কারের চেয়ে নির্বাচনকেন্দ্রিক আশ্বস্ত করার আলোচনা বেশি প্রাধান্য পায়, তখন আমাদের মনে হয়েছে কিছু উপদেষ্টা নির্বাচন দিয়ে হাঁফ ছেড়ে বাঁচতে চান। যেটা কোনোভাবেই কাম্য নয়।’
বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা সেফ এক্সিট বিতর্ক উড়িয়ে দিচ্ছেন না। বিভিন্ন কারণে এর বাস্তবতা দেখছেন তারা। এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক সারোয়ার তুষার কালবেলাকে বলেন, “অনেক উপদেষ্টা এমন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন, যাদের তারা ভবিষ্যতের সরকার হিসেবে ভাবছেন। বলা যায়, কেউ কেউ সেই সম্ভাব্য শক্তির সঙ্গে একধরনের সমঝোতা বা আত্মসমর্পণের অবস্থান নিয়েছেন। এর প্রভাব পড়ছে বর্তমান সরকারের নানা কার্যক্রমে। যে গণআন্দোলন বা অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব তাদের নেওয়ার কথা ছিল, সেখানে দেখা যাচ্ছে শিথিলতা, গাফিলতি এবং নানা ধরনের কমপ্রোমাইজ। কারণ তারা মনে করছেন, পরবর্তী সময়ে সরকারের কাছ থেকে ‘গ্রিন সিগন্যাল’ বা নিরাপদ অবস্থান নিশ্চিত করতে হবে। এসব কারণেই নাহিদ ইসলাম ‘সেফ এক্সিট’-এর প্রসঙ্গ তুলেছেন বলে আমরা মনে করি।”
দলটির সদস্য সচিব আখতার হোসেনও প্রায় একই ধরনের কথা বলেছেন। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের বিচার ও সংস্কার গণঅভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা। সেটি পালনের দায়িত্ব নিয়েও তা না করে কোনো কোনো উপদেষ্টা তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব থেকে পালিয়ে বাঁচতে চান। নাহিদ কিংবা সারজিস সে বিষয়টিই বলেছেন।
অন্তর্বর্তী সরকারের যেসব উপদেষ্টা রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রে ইন্ধন দিচ্ছেন, তাদের গাদ্দার উপদেষ্টা আখ্যায়িত করে এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামকে নাম প্রকাশ করার দাবি জানিয়েছেন গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান। তিনি বলেন, ‘যেদিন এনজিও ঘরানার উপদেষ্টারা শপথ নিয়েছেন, সেদিন থেকেই গণঅভ্যুত্থান ব্যর্থতার দিকে গেছে। কিন্তু আমরা চাই না সেই আন্দোলন ব্যর্থ হোক। নির্বাচন বানচালের মাধ্যমে যদি অভ্যুত্থান ভেস্তে যায়, তার দায় নাহিদ ইসলামকেও নিতে হবে।’
সেফ এক্সিট সংক্রান্ত বিতর্ক নিয়ে মন্তব্য করেছেন বিএনপির সহ-আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানাও। একটি টেলিভিশন টক শোতে অংশ নিয়ে তিনি রুমিন বলেন, উপদেষ্টারা অনেকেই এখন সেফ এক্সিট খুঁজছেন। তবে আমার মনে হয়, তাদের খুব বেশি কষ্ট করতে হবে না, কারণ ম্যাক্সিমাম উপদেষ্টাই ডুয়েল সিটিজেনশিপ নিয়ে চলছেন। ফলে তারা দেশের বাইরে অটোমেটিক্যালি চলে যেতে পারবেন।
এদিকে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টাদের সেফ এক্সিটের কথা ভাবা স্বাভাবিক, তবে এ বিষয়ে বিএনপির সঙ্গে কোনো আলাপ হয়নি বলে জানিয়েছেন দলটির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু।
নাহিদ ইসলাম একসময় ছিলেন সরকারের ভেতরের লোক। পরে সরকার থেকে বেরিয়ে এলেও ঘনিষ্ঠতা রয়েছে সরকারসংশ্লিষ্টদের সঙ্গে। তার কাছ থেকে যখন এ ধরনের মন্তব্য আসে তখন সেটা নিঃসন্দেহে গুরুত্ব পায়। তবে এই সেফ এক্সিট বিতর্কে বিব্রত হচ্ছেন উপদেষ্টারা। অনেকেই বলছেন, রাজনৈতিক স্বার্থেই তারা এই বিতর্কের বলি হচ্ছেন।
সরকারের দায়িত্বশীল একটি সূত্র কালবেলাকে নিশ্চিত করেছেন, সেফ এক্সিট বিতর্ক নিয়ে সরকারের মধ্যেও আলাপ আলোচনা হচ্ছে। কেন হঠাৎ এই বিতর্ক তোলা হয়েছে তার কারণও বের করার চেষ্টা করা হচ্ছে। তারা মনে করছেন, রাজনৈতিক দলটি আলোচনায় থাকার জন্যই মূলত সেফ এক্সিট বিতর্কটি শুরু করেছেন। সরকারের উপদেষ্টাদের মধ্যে এ ধরনের কোনো ইচ্ছা বা অভিপ্রায় নেই।
এদিকে অভিযোগ প্রকাশের পর একে একে মুখ খুলেছেন সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যরা। উপদেষ্টাদের কেউ কেউ কি সত্যিই সেফ এক্সিট খুঁজছেন—বুধবার সচিবালয়ে সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নে মুখোমুখি হয়েছিলেন পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। তিনি বলেছেন, ‘নাহিদ ইসলামের বক্তব্যটা স্পেসিফিক হলে হয়তো সরকারের পক্ষ থেকে কথা বলা যেত। এখানে তো সরকারের বক্তব্য দেওয়ার তো সুযোগ নেই।’
নিজের বিষয়ে বলতে গিয়ে রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘আমি কোনো সেফ এক্সিট খুঁজছি না। সারাজীবন এই দেশেই থাকব।’ একই কথা বলেছেন সড়ক ও সেতুবিষয়ক উপদেষ্টা মোহাম্মদ ফাওজুল কবির খান। বৃহস্পতিবার সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘৭২ বছর বয়সে সেফ এক্সিট ভাবার প্রশ্নই আসে না।’
অন্যদিকে গত বুধবার রাতে এক ফেসবুক পোস্টে এ বিষয়ে বিস্ফোরক মন্তব্য করেন স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ। ওই ফেসবুক পোস্টে আসিফ বলেন, ‘যাদের একাধিক দেশের পাসপোর্ট, নাগরিকত্ব নেয়া তারাই আবার অন্যদের সেফ এক্সিটের তালিকা করে।’ আসিফ আরও বলেন, ‘যারা ৫ আগস্ট পালিয়েছিল, তাদের সিমপ্যাথাইজাররা কষ্টে মরে যাচ্ছে। বারবার ফ্যাসিস্টদেরই পালাতে হবে। আমাদের জন্ম এদেশে মৃত্যুও এদেশের মাটিতেই হবে। ফ্যাসিস্ট, খুনিদের সঙ্গে লড়তে লড়তে আমার ভাইদের মতো শহীদি মৃত্যুই কামনা করি।’
সর্বশেষ গতকাল শনিবার রাজধানীর হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে ‘জাতীয় মানবাধিকার কমিশন অধ্যাদেশ, ২০২৫ (খসড়া)’ বিষয়ক জাতীয় পরামর্শ সভায় বক্তব্যে আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল বলেছেন, বর্তমানে অনেকেই সেফ এক্সিটের কথা আলোচনা করছেন। আসলে উপদেষ্টা হিসেবে সেফ এক্সিটের প্রয়োজন নেই। তবে এখনকার রাষ্ট্রব্যবস্থা থেকে এই জাতির সেফ এক্সিট হওয়া দরকার।
আইন উপদেষ্টা বলেন, গত ৫৫ বছর আমরা দুঃশাসন দেখেছি, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড দেখেছি, ব্যাংক লুট করে সাধারণ মানুষের আমানত নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, এটাও দেখেছি। এই ভয়াবহ অসুস্থ আত্মধ্বংসী রাষ্ট্র কাঠামো থেকে আমাদের সেফ এক্সিট প্রয়োজন।
মন্তব্য করুন