হঠাৎ অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিয়ে মাতামাতিকে সন্দেহজনক বলে মন্তব্য করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, আসল কথা নির্বাচন বানচাল করা। একটা দেশ এত দ্রুত উন্নতি করেছে, সেটাই তাদের মাথাব্যথা। না হলে সুষ্ঠু ভোট, সুষ্ঠু ভোট বলে এত মাতামাতি কেন? তারা ভাঙা রেকর্ড বাজিয়েই যাচ্ছে। তাহলে এটাই বলতে হয়, সন্দেহ হয় রে! মানুষ যদি সেটা বোঝে। অবাধ ও সুষ্ঠু ভোট আমাকে শেখাতে হবে না। জিয়া, এরশাদ ও খালেদা জিয়া সবাই ভোটচোর। এ দেশের মানুষ জানে নৌকায় ভোট দিয়েই তারা স্বাধীনতা পেয়েছে। গতকাল শুক্রবার বিকেলে গণভবনে সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে অংশগ্রহণ এবং যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে সফর বিষয়ে জানাতে তিনি এ সংবাদ সম্মেলন করেন।
আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, যারা জানে নির্বাচন করে জনগণের ভোট পাবে না, তারা সব জায়গায় গিয়ে ধরনা দিয়ে বেড়াচ্ছে। কারণ তাদের তো কোটি কোটি টাকা। ক্ষমতায় থেকে এত বেশি টাকা মানি লন্ডারিং এবং এত বেশি টাকার মালিক হয়ে গেছে, অবাধে সে টাকা খরচ করে যাচ্ছে তারা। শেখ হাসিনা বলেন, আমি স্পষ্ট বলে এসেছি। কেন? ভোটের জন্য তো আমরা সংগ্রাম করলাম। রক্ত দিয়ে, আমার নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এদেশের মানুষের ভোটের অধিকার অর্জন করে দিয়েছি। আজকে আমাকে ভোটের অধিকার শেখাতে হবে না। তিনি বলেন, আমরা তো সেই আইয়ুব খানের আমল থেকে আন্দোলন করি, রাস্তায় থাকি। এমন নয় যে, নতুন এসেছি। স্কুলজীবন থেকেই রাস্তায় আন্দোলন সংগ্রাম করছি। আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে করেছি, ইয়াহিয়া খানের বিরুদ্ধে করেছি। জিয়া, এরশাদ ও খালেদা জিয়া সবাই তো ভোটচোর। আওয়ামী লীগ আসার পর আওয়ামী লীগের তো ভোট চুরি করা লাগে না। আওয়ামী লীগকে তো জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভোট দেয়। কাজের মধ্য দিয়ে আস্থা অর্জন করি আমরা। বিএনপির জন্মই অবৈধ, এমন মন্তব্য করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তাদের শিকড় নেই। এ দলের নেতারা যা বলে, তার সবই মিথ্যা। তাদের মিথ্যা কথায় কেউ কান দেবেন না।
জি-২০ সম্মেলন থেকে ‘প্রধানমন্ত্রী খালি হাতে ফিরেছেন’—বিএনপির এমন অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে সরকারপ্রধান বলেন, বিএনপির এ অভিযোগের কোনো উত্তর দিতে চাই না। আমি শুধু দেশবাসীকে বলতে চাই, বিএনপির নেতারা একটি মাইক হাতে কীভাবে মিথ্যা কথা বলে, সেটা সবাই জেনে নেন। মিথ্যা বলাটা তাদের অভ্যাস আর সব কিছুকে খাটো করে দেখার চেষ্টা—এই বিষয়ে যেন দেশবাসী সচেতন থাকে।
এ সময় প্রধানমন্ত্রী সুশীল সমাজের সমালোচনা করে বলেন, কিছু স্বনামধন্য অর্থনীতিবিদ থেকে শুরু করে অনেকে বললেন, মেগা প্রজেক্ট আমরা করেছি; কিন্তু দরিদ্রদের জন্য আমরা নাকি কিছু করিনি। এরকম বক্তব্য শুনলে মনে হয় তারা বাংলাদেশটাকে দেখেনি। তারা ঘরের ভেতরেই আছেন। আর শুধু টেলিভিশনটাই দেখেন। দিন দুনিয়া তাকিয়ে দেখে না। প্রধানমন্ত্রী এ সময় দারিদ্র্য বিমোচনসহ দেশের সার্বিক উন্নয়নে যেসব পদক্ষেপ নিয়েছেন, তার ফিরিস্তি তুলে ধরেন।
তত্ত্বাবধায়কের কথা কেউ বলেনি
যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা উপদেষ্টা জ্যাক সুলিভানের সঙ্গে বৈঠকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে কোনো কথা হয়েছে কি না, জনতে চাইলে এ নিয়ে কেউ কোনো কথা বলেনি বলে জানান প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে কেউ কোনো কথা বলেনি। আমার মনে পড়ে না, এ ধরনের কোনো কথা হয়নি। কেউ জিজ্ঞেসও করেনি। ২০০৭-এ তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে যে অভিজ্ঞতা, এরপর এটা কেউ চায়? এ ব্যবস্থা বিএনপিই ধ্বংস করেছে।
বিএনপির আন্দোলনের টাকা কোথা থেকে আসে, সেই উৎস খুঁজে বের করতে সাংবাদিকদের প্রতি আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, বিএনপি বলে তারা নাকি কথা বলতে পারছে না; কিন্তু তারা তো সভা সমাবেশ করেই যাচ্ছে। আমি কোনো বাধা দিচ্ছি না। কারণ, তাদের আন্দোলনের কারণে মানুষ তো কিছু টাকা পাচ্ছে। আন্দোলনের উছিলায় তাদের পকেটের দুর্নীতির টাকা সাধারণ মানুষ কিছুটা হলেও পাচ্ছে। তবে তারা এত টাকা কোথায় পায়, সে উৎস আপনারা বের করুন। শেখ হাসিনা আরও বলেন, তারা তো বারবার তারিখ দিয়েই যাচ্ছে। এই তারিখে ফেলে দেবে, ওই তারিখে ফেলে দেবে। তারা আন্দোলন করুক। জনগণের জানমালের কোনো ক্ষতি যদি করা হয়, তাহলে ছাড়ব না। বিএনপিকে উদ্দেশ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিদেশে সংসদের বাইরের কোনো দলকে বিরোধী দল বলা হয় না। সংসদে প্রতিনিধিত্ব থাকলেই বিরোধী দল। তাদের (বিএনপি) তো সংসদে একটি সিটও নেই। রাস্তায় যারা ঘেউ ঘেউ করে তারা বিরোধী দল নয়।
যুক্তরাষ্ট্রকে আগে নিজের দেশ সামলানো উচিত
ঢাকায় নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তাদের নিরাপত্তা উপদেষ্টাকেও আমি প্রশ্ন করেছি, আমাদের রাষ্ট্রদূতকে আপনারা কী নিরাপত্তা দেন। হলি আর্টিসানের হামলার পর কূটনীতিকদের নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছিল; কিন্তু এখন বাংলাদেশে আর সেই অবস্থা নেই। আমেরিকায় প্রতিদিনই হামলা হচ্ছে, গোলাগুলি হচ্ছে। তাদের আগে নিজেদের দেশ সামাল দেওয়া উচিত। তারা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর নিষেধাজ্ঞা দেবে আবার তাদের কাছেই নিরাপত্তা চাইবে, এটা কেমন কথা!
বেশি কথা বললে সব বন্ধ করে বসে থাকব
সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে সরকারের সমালোচকদের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাকে বেশি কথা বললে, সব বন্ধ করে বসে থাকব। দেখি কে দায়িত্ব নিতে রাজি হয়! সব রেডি করে দিয়েছি, এখন বসে বসে বড় বড় কথা বলে। আমি বাবা-মা সব হারিয়েছি। আমার হারানোর কিছু নেই। ১৫-১৬ বছর বয়স থেকে মিছিল করি। কত বছর হয়েছে রাজনীতির? একটা স্বপ্ন ছিল জাতির পিতার, সেটা করেছি, এখন তো কেউ না খেয়ে থাকে না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, যেসব আঁতেল, জ্ঞানীগুণী কথা বলেন, তারা কী জানেন, আমরা যখন ক্ষমতায় এসেছি, তখন রিজার্ভ কত ছিল? বাংলাদেশ কোথায় ছিল, কোথায় এনে দাঁড় করিয়েছি? যতটুকু রিজার্ভ প্রয়োজন, আমাদের আছে। আমাদের ভালো থাকা জরুরি, নাকি রিজার্ভটা দরকার বেশি? যদি বলে, তাহলে রিজার্ভ আগের জায়গায় এনে দিই? বিদ্যুৎকেন্দ্র-টেন্দ্র বন্ধ করে দিই। তিনি বলেন, আমি বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রীকে বলেছি, প্রতিদিন একটু করে লোডশেডিং দিতে। যাতে বিদ্যুৎ থাকার গুরুত্বটা বোঝে। বিদ্যুৎ ব্যবহার করছে সবাই। সুবিধাটা নিচ্ছে অর্থশালীরা। এজন্য নির্দেশনা দিয়েছি, যারা বেশি ব্যবহার করবে, তারা বেশি টাকা দেবে। সেভাবে স্লট ও মূল্য নির্ধারণ করতে।
মিডিয়া মালিকদের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সাংবাদিকরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আপনাদের সার্ভিস দেয়, তাদের সুযোগ-সুবিধার বিষয়টিও তো দেখতে হবে। আমরা তো ওয়েজবোর্ড দিয়েছি। বেসরকারি টেলিভিশনের মালিকদের দায়িত্ব ওয়েজবোর্ড কার্যকর করা। বেসরকারি টেলিভিশনের মালিকদের বলব, খালি টাকা কামালে হবে না, যারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আপনাদের সার্ভিস দেয়, তাদের সুযোগ সুবিধার বিষয়টিও দেখতে হবে।
আগামী নির্বাচনে মনোনয়নের ক্ষেত্রে দলীয় প্রার্থীদের কোন যোগ্যতা দেখা হবে—এমন প্রশ্নের জবাবে আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, জনগণের কাছে কার গ্রহণযোগ্যতা বেশি। মানুষের সঙ্গে কারা কাজ করেছে। কারা মানুষের আস্থা অর্জন করতে পেরেছে, মনোনয়নে আমরা সে বিষয়টি মাথায় রাখি। আগামী নির্বাচনেও সেটি দেখা হবে। আমি ৬ মাস পরপর জরিপ করি। যাদের অবস্থা খারাপ তাদের ডেকে সতর্ক করে দিই। আসন্ন দুর্গাপূজা উপলক্ষে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে কঠোর নজরদারির ব্যাপারে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে বলেও জানান প্রধানমন্ত্রী।