হরতাল-অবরোধসহ ঘোষিত কর্মসূচি বাস্তবায়নে দৃশ্যত ঢিলেঢালা ভাব দেখা গেলেও রাজপথে থেকেই দাবি আদায় করতে চায় বিএনপি। ৭ জানুয়ারির নির্বাচন প্রতিহত করতে মিত্রদের সঙ্গে নিয়ে চলমান আন্দোলনকে ‘নতুন মাত্রায়’ নিয়ে যেতে চায় দলটি।
২৮ অক্টোবরের পর থেকে ‘ছন্নছাড়া’ নেতাকর্মীদের সংঘবদ্ধ করতে এরই মধ্যে দুজন কেন্দ্রীয় নেতাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তারা সারা দেশে প্রায় ৬০টি জেলায় দল ও অঙ্গসংগঠনের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে ভার্চুয়াল বৈঠক করে হাইকমান্ডের নির্দেশনা পৌঁছে দিয়েছেন। ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ বিএনপি এবং অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীদেরও একই বার্তা দেওয়া হচ্ছে বলে জানা গেছে।
বিএনপির দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে, নির্বাচন সামনে রেখে আন্দোলনকে চূড়ান্ত রূপ দিতে নানামুখী পরিকল্পনা করছে দলটির হাইকমান্ড। চূড়ান্ত আন্দোলন সফল করতে কেন্দ্র থেকে তৃণমূলে কঠোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। পদধারী নেতাদের পাশাপাশি বিএনপি নির্বাচনে গেলে মনোনয়ন প্রত্যাশা করেন—এমন ব্যক্তিদের ভূমিকা সম্পর্কেও খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে।
বৃহত্তর স্বার্থে মান-অভিমান ভুলে সবাইকে আরও বেশি ঐক্যবদ্ধ থেকে আন্দোলন সফল করার বার্তা দেওয়া হচ্ছে। সব মিলিয়ে যুগপৎ আন্দোলনের শরিক দল ও জোটগুলোকে নিয়ে সরকারকে একটি বড় ধাক্কা দিতে চায় বিএনপি।
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, ‘সুষ্ঠু নির্বাচনের কথা শুনলে সরকারের এমপি-মন্ত্রীরা আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। তারা রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলোকে বিরোধী রাজনীতিকদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করছে, যাতে কেউ সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবি না জানায়। তবে রাষ্ট্রীয় নির্যাতন-নিপীড়ন সত্ত্বেও বিএনপির নেতাকর্মীরা যেভাবে কর্মসূচি সফল করছেন তা বীরোচিত।’
গত ২৮ অক্টোবর নয়াপল্টনে মহাসমাবেশ ঘিরে সহিংস ঘটনার পর বেশ কয়েকজন শীর্ষ নেতাসহ বিএনপির বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। সেই অবস্থায় জমায়েতভিত্তিক কর্মসূচির পরিবর্তে আন্দোলনকে হরতাল-অবরোধের দিকে নিয়ে যায় দলটি। ২৯ অক্টোবর থেকে দফায় দফায় এ ধরনের কর্মসূচি অব্যাহত রেখেছে বিএনপি। যুগপৎ আন্দোলনের অংশ হিসেবে জামায়াতে ইসলামীসহ ৩৯টি রাজনৈতিক দলও এসব কর্মসূচি পালন করছে।
অন্যদিকে ঢাকাসহ সারা দেশে ব্যাপক ধরপাকড় শুরু হলে গ্রেপ্তার এড়াতে বিএনপির অধিকাংশ নেতা আত্মগোপনে চলে যান। দীর্ঘ দেড় মাসেও তারা প্রকাশ্যে আসতে না পারায় কর্মসূচিতে এর প্রভাব পড়েছে। শুরুর দিকে ঢাকাসহ সারা দেশে হরতাল-অবরোধের প্রভাব পড়লেও ধীরে ধীরে তা অনেকটাই কমে গেছে। এ অবস্থায় বিএনপির হাইকমান্ড সংকট উত্তরণে নতুন পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হতে চাইছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, যেসব নেতা ২৮ অক্টোবরের পর প্রকাশ্যে আসছেন না বা মোবাইল নম্বর পরিবর্তন করেছেন তাদের আবারও ঐক্যবদ্ধ করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান নিজেই বেশিরভাগ নেতার সঙ্গে যোগাযোগ করছেন। সেইসঙ্গে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী এবং সংশ্লিষ্ট বিভাগের সাংগঠনিক ও সহসাংগঠনিক সম্পাদকরা যোগাযোগ করছেন। এ ছাড়া বিএনপির সহ-দপ্তর সম্পাদক মো. মুনির হোসেন, তাইফুল ইসলাম টিপু, নির্বাহী কমিটির সদস্য তারিকুল আলম তেনজিং বিভিন্ন বিভাগের নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ ও সমন্বয় করছেন। এর মধ্যে বিভিন্ন বিভাগের কয়েকজন সাংগঠনিক ও সহসাংগঠনিক সম্পাদক গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে আছেন। ফলে কেন্দ্রীয় কমিটির একজন সম্পাদক এবং একটি অঙ্গসংগঠনের সভাপতিকে নতুনভাবে সমন্বয়কের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
দায়িত্বপ্রাপ্ত ওই দুই নেতা জানান, তারা দলের হাইকমান্ডের নির্দেশে কাজ শুরু করেছেন। যেসব বিভাগ বা জেলায় কর্মসূচি পালনে কিছুটা ঘাটতি আছে, সেগুলোকে প্রাধান্য দিয়ে সংশ্লিষ্ট নেতাদের বিভিন্ন দিকনির্দেশনামূলক বার্তা পৌঁছে দিচ্ছেন।
সংশ্লিষ্টরা জানান, দ্বাদশ জাতীয় সংসদের তপশিলের একেকটি পর্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কর্মসূচির কৌশল বদলাবে বিএনপি। ১৭ ডিসেম্বর মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার প্রক্রিয়া শেষ হলে পরদিন (১৮ ডিসেম্বর) থেকে নতুন কর্মসূচিতে যেতে পারে দলটি। সেক্ষেত্রে প্রথম সাত দিন প্রথম পর্যায় এবং তারপর থেকে ৭ জানুয়ারি নির্বাচনের দিন পর্যন্ত দুই পর্যায়ে কর্মসূচির রোডম্যাপ ঠিক করা হচ্ছে। এবারের আন্দোলনকে ‘ডু অর ডাই’ হিসেবে বিবেচনা করছেন বিএনপি ও তাদের মিত্ররা।
বিএনপির হাইকমান্ড মনে করছে, আন্দোলন সফল করতে জনমত পক্ষে রাখা, কূটনৈতিক তৎপরতা ও সাংগঠনিক সক্ষমতা বাড়ানোর পাশাপাশি শেষ পর্যায়ে সমমনা সব দলকে এক মঞ্চে নিয়ে আসতে হবে। তবে তৃণমূলের নেতাকর্মীরা বলছেন, শুধু নির্দেশনা দিলেই হবে না শীর্ষ নেতাদেরও মাঠে থাকতে হবে।
দিনাজপুর জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক বখতিয়ার আহমেদ কচি গতকাল কালবেলাকে জানান, ‘দায়িত্বপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় নেতারা এরই মধ্যে নতুন কর্মসূচির বিষয়ে নির্দেশনা দিয়েছেন। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশনায় চূড়ান্ত আন্দোলন সফল করার জন্য যা প্রয়োজন দিনাজপুর জেলা বিএনপি সর্বোচ্চ ভূমিকা রাখবে।’
ঝিনাইদহ জেলা বিএনপির সভাপতি এমএ মজিদ বলেন, ‘আন্দোলন সফলে কেন্দ্র থেকে নির্দেশনা পেয়েছি। শত নির্যাতনের পরও আমরা আগের মতোই মাঠে রয়েছি।’
নেত্রকোনা জেলা বিএনপির আহ্বায়ক অধ্যাপক ডা. আনোয়ারুল হক জানান, কেন্দ্রীয় নেতারা যোগাযোগ করে যেভাবে বার্তা দিচ্ছেন তারা সেভাবেই কর্মসূচি বাস্তবায়নের প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
সিরাজগঞ্জ জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক সাইদুর রহমান বাচ্চু বলেন, তার জেলায় সবাই মিলে কর্মসূচি পালন করছেন। তবে পুলিশি হয়রানি ও গ্রেপ্তারের কারণে কোথাও কোথাও কর্মসূচি পালনে বিঘ্ন ঘটছে। জেলায় ৪৬২ নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
বিএনপির নির্বাহী কমিটির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সহ-সম্পাদক ড. শাকিরুল ইসলাম খান শাকিল বলেন, ‘শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ বাড়ছে এবং সামনে আরও বাড়বে। দেশের জনগণ ও গণতান্ত্রিক বিশ্বের দাবিকে উপেক্ষা করে একতরফা নির্বাচনে দিকেই এগোচ্ছে সরকার। সবাই বুঝে গেছে, সরকার ফের পাতানো নির্বাচন করতে যাচ্ছে। যে কারণে সাধারণ মানুষের মধ্যে ভোট নিয়ে কোনো আগ্রহ নেই। তারা এবার ভোটকেন্দ্রে যাবে না।’
বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য মিজানুর রহমান ভূঁইয়া মিল্টন বলেন, ‘বাংলাদেশের যে সংকট এটা সবার সংকট। শুধু বিএনপির একার সংকট নয়। সেজন্যই সাধারণ মানুষ বিএনপির কর্মসূচিতে সমর্থন দিচ্ছে, সম্পৃক্ত হচ্ছে। হামলা-মামলা গ্রেপ্তারেও কেউ থেমে নেই। মিছিলের পেছনে যে অবহেলিত কর্মীগুলো স্থান পেত তারাই আজ মাঠে এবং সামনের সারিতে নেতৃত্ব দিচ্ছে।’