রাজধানীর চকবাজারে রুইহাট্টা লেনে আটতলা ‘এনেক্স ফ্রেন্ডশিপ মার্কেট’ দখলের অভিযোগ উঠেছে ঢাকা-৭ আসনের সংসদ সদস্য হাজী মোহাম্মদ সেলিমের বিরুদ্ধে। মার্কেটটি ভেঙে ১৬তলা নতুন ভবন নির্মাণের প্রস্তাব করেছিলেন বহুল আলোচিত এই এমপি। জমির মালিকপক্ষ এতে সম্মত না হওয়ায় এক মাস ধরে মার্কেট বন্ধ করে রেখেছে সন্ত্রাসীরা। হুমকি দিয়ে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে ব্যবসায়ীদের। সর্বশেষ গত ২৭ ও ২৮ ডিসেম্বর হামলা চালিয়ে দোকানসহ আসবাবপত্র ভাঙচুর করা হয়েছে। কেটে ফেলা হয়েছে বিদ্যুতের লাইন। খুলে নেওয়া হয়েছে মিটার। এই প্রেক্ষাপটে দখল ঠেকানো ও জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে র্যাব মহাপরিচালক বরাবর লিখিত আবেদন করেছেন জমির মালিক। পাশাপাশি ঘটনার বর্ণনা দিয়ে চকবাজার থানায় সাধারণ ডায়েরিও করেছেন তিনি।
ভবন মালিকরা জানিয়েছেন, চকবাজারের তিন নং রুইহাট্টা লেনে দুই দশমিক ৫২ শতাংশ জমির ওপর ১৯৬৫ সালে একটি দ্বিতল ভবন এবং পরবর্তী সময়ে ‘এনেক্স ফ্রেন্ডশিপ মার্কেট’ নামে আটতলা ভবন নির্মাণ করা হয়। সর্বমোট দোকানের সংখ্যা ৬৩। ১৯৭৫ সালে ভবনের মালিকের মৃত্যুর পর তার চার সন্তান উত্তরসূরি হিসেবে মার্কেট পরিচালনা করে আসছেন। পরে দুই ভাইয়ের মৃত্যু হলে তাদের তিন সন্তান ও জীবিত দুই ভাই মিলে জমি ও মার্কেট পরিচালনা করছেন। সন্ত্রাসীদের অব্যাহত হুমকির মুখে এখন নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন তারা। সেইসঙ্গে চোখের সামনে তাদের মার্কেট ও জমি জবরদখল হয়ে যাওয়ায় ভীতসন্ত্রস্ত অবস্থায় বসবাস করছেন।
মালিক দুই ভাইয়ের একজন মাধব বণিক কালবেলাকে জানান, ‘নিজের জমি চোখের সামনে বল প্রয়োগ করে ছিনিয়ে নেওয়া হচ্ছে। অথচ প্রতিকার মিলছে না। এটা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছি না। পরিস্থিতি এখন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। আমরা আতঙ্কে রয়েছি।’
সরেজমিন ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা গেছে, ২১-২৪ সার্কুলার সড়কে হাজী সেলিমের মালিকানাধীন ‘মদিনা আশিক টাওয়ার’-এর পেছনে তিন নং রুইহাট্টা লেনে আটতলা ‘এনেক্স ফ্রেন্ডশিপ মার্কেট’। ভবনের নিরাপত্তা কর্মী থেকে শুরু করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাউকে সেখানে দেখা যায়নি। জনশূন্য ভবন। অন্ধকার ভবনে প্রবেশ করলেই নিচতলা থেকে অষ্টম তলা পর্যন্ত দেখা গেল ধ্বংসযজ্ঞের চিহ্ন। এই মার্কেট ঘেঁষে স্বল্প আয়তনের এক খণ্ড জমিতে আরেকটি ভবন নির্মাণ করছেন হাজী সেলিম।
স্থানীয় ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, দীর্ঘদিন ধরেই এনেক্স ফ্রেন্ডশিপ মার্কেটের দিকে দৃষ্টি দিয়েছেন স্থানীয় সংসদ সদস্য হাজী সেলিম। যে কোনো মূল্যে মার্কেটটি দখলে নিতে চান তিনি। ভাঙচুর, দূরে লোক বসিয়ে পাহারা দেওয়া, ভবন খালি করা সবকিছুই চূড়ান্ত দখল প্রক্রিয়ার অংশ বলছেন তারা।
ভবনের নিচতলায় কাঁটাতার ঝুলতে দেখা গেছে। ভিআইপি সেন্টার, অভি স্টোর, নাসিমা স্টোর, গরিবুল্লাহ জুয়েলারিসহ মার্কেটেরে সব দোকান এখন বন্ধ। নিচতলার একটি দোকানের আসবাবপত্রের কোনো চিহ্ন নেই। সবকিছু ভাঙাচোরা অবস্থায় পাওয়া গেছে।
এই প্রতিবেদক মার্কেটটিতে প্রবেশের পর অল্প সময়ের মধ্যেই সেখানে অপরিচিত বেশ কিছু লোক জড়ো হন। এখানে আসার কারণ সম্পর্কে নানাভাবে জেরা করেন তারা।
ভবনের দ্বিতীয় তলায় আল মদিনা সেন্টার, শাহীন সেন্টারসহ সবকটি দোকান বন্ধ পাওয়া গেছে। দরজা-জানালা ভাঙা, শাটার কাটা, গ্রিল খুলে চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা হয়েছে। তেমনি তৃতীয় তলার বিভিন্ন দোকানের শাটার কেটে ও খুলে নিয়ে গেছে সন্ত্রাসীরা।
ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, কয়েক দফা তাণ্ডব চালিয়ে সবকিছু ভাঙচুর করেছে সন্ত্রাসীরা। অনেকেই দোকানের মালপত্র লুট হওয়ারও অভিযোগ করেন। তবে আতঙ্কে কারও নাম বলতে চাননি তারা।
সন্ত্রাসীদের ভয়ে এক মাস ধরে বন্ধ থাকার কথা জানিয়ে মার্কেটের ম্যানেজার হরি গোপাল বণিক কালবেলা বলেন, ‘ব্যবসায়ীদের ভয়ভীতি দেখিয়ে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। দোকান ও গুদাম ভাঙচুর করা হয়েছে।’
৬৩টি গুদাম ও দোকানের ভাড়াটিয়ারা ভয়ে চলে যাওয়ার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আতঙ্কে এখন আমরাও এখানে আসতে পারছি না। কখন কী হয় জানি না।’
মার্কেট দখলের উদ্দেশ্যে এসব করা হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘দ্বিতীয় তলা থেকে ভবনের মিটার খুলে নিয়ে গেছে হাজী সেলিমের লোকজন। তিনবার এসে বিদ্যুতের তার কেটেছে। ফলে ভবনটিতে কোনো আলো নেই। সব মিলিয়ে মার্কেটটি এখন কার্যত মালিকপক্ষের হাতছাড়া হওয়ার অবস্থায় রয়েছে।’
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সহযোগিতা না করলে মালিক পক্ষের মার্কেটে ফিরে এসে সবকিছু সচল করা সম্ভব নয় বলেও জানান তিনি।
জানতে চাইলে স্থানীয় দোকান মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. আরিফুর রহমান কালবেলাকে বলেন, ‘মার্কেট ভাঙচুর ও দখলের বিষয়ে আমি কিছু বলতে পারব না। আমি ব্যবসায়ীদের সুবিধা-অসুবিধার বিষয়গুলো দেখি। তবে শুনেছি কোনো একটা ঝামেলার কারণে সব ব্যবসায়ী চলে গেছেন। বর্তমানে মার্কেটটি বন্ধ রয়েছে।’
গত ২৮ ডিসেম্বর মার্কেটের ভাড়াটিয়াদের উচ্ছেদের ঘটনায় ওইদিন চকবাজার মডেল থানায় সাধারণ ডায়েরি করেছেন ভবনের মালিক ভাস্কর জ্যোতি মাধব বণিক। জিডি নম্বর-১৩৭৬। এতে বলা হয়েছে, ‘এনেক্স ফ্রেন্ডশিপ মার্কেট, ১০নং গলি, ৩নং রুইহাট্টা লেন নামক স্থানে পৈতৃক সূত্রে মালিকানা পাওয়া ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ভোগদখলে আছি। ২৮ ডিসেম্বর বিকেল ৩টার সময় অজ্ঞাতপরিচয় চার-পাঁচ ব্যক্তি আমার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ভাড়াটিয়াদের উচ্ছেদের পাঁয়তারা করলে উল্লেখিত ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ভাড়াটিয়া এবং কর্মচারীরা প্রতিবাদ করেন। তখন দখলকারীরা গালাগালসহ তাদের ভয়ভীতি দেখায় ও হুমকি দেয়।’
বিষয়টি নিয়ে কথা বললেও নামপরিচয় প্রকাশে রাজি হননি চকবাজার থানার কোনো কর্মকর্তা। তারা জানান, জিডি করার পর পুলিশ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে। এ বিষয়ে ইতোমধ্যে আদালতে একটি প্রতিবেদনও জমা দেওয়া হয়েছে।
এদিকে ভবন দখলের বিস্তারিত তুলে ধরে ২৮ ডিসেম্বর র্যাবের মহাপরিচালক বরাবর লিখিত অভিযোগ করেছেন ভাস্কর জ্যোতি মাধব বণিক। অভিযোগে বলা হয়েছে, ‘চার বছর আগে থেকে বিভিন্ন লোক মারফত এমপি হাজী সেলিম এই মার্কেট ভেঙে সেখানে যৌথভাবে ১৬ তলা ভবন নির্মাণের প্রস্তাব দিয়ে আসছেন। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে হাজী সেলিমের মদিনা ডেভেলপমেন্ট লিমিটেডের (মদিনা গ্রুপের প্রতিষ্ঠান) ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার মো. সাইদ হোসেন মল্লিক আমাদের বাসায় এসে তার মালিকের পক্ষে সরাসরি তাদের সঙ্গে মার্কেটের জমিতে যৌথভাবে ১৬ তলা ভবন নির্মাণের প্রস্তাব দেন। তখন মল্লিকের মিলিয়ে দেওয়া ফোনে হাজী সেলিমও একই প্রস্তাব দেন। আমরা প্রস্তাবে রাজি না থাকার কথা তাদের জানিয়ে দিই। এরপর থেকে বিভিন্ন সময়ে হাজী সেলিম এমপির বরাতে বিভিন্ন লোক আমাদের ও মার্কেটের ব্যবসায়ীদের ফোনে ও সরাসরি হুমকি দিয়ে আসছে। ২০২০ সালের ১১ জুলাই সকাল ১০টার দিকে এমপির বরাতে কিছু লোক মার্কেট তালা দিয়ে ব্যবসায়ীদের প্রবেশে বাধা দেওয়ার কথা অভিযোগে উল্লেখ করা হয়েছে।
অভিযোগে আরও বলা হয়, ‘একপর্যায়ে মার্কেট খুলে দিলেও দ্রুত ভবন খালি করে দেওয়া না হলে আবারও তালাবদ্ধ করার হুমকি দেয় হাজী সেলিমের লোকজন। এরপর থেকে সাইদ হোসেন মল্লিক এবং আরও কিছু লোক হাজী সেলিমের বরাতে মার্কেটের ব্যবসায়ীদের ক্রমাগত হুমকি দিয়ে আসছে এবং এই মার্কেট ভেঙে ফেলার কথা বলা হচ্ছে। তাই ব্যবসায়ীদের দোকান খালি করে দ্রুত মালপত্র নিয়ে সরে যাওয়ার পরামর্শ দেয় তারা। বিভিন্ন সময় জ্যোতি মাধব বণিকের মোবাইল ফোনে মার্কেট ভেঙে ফেলার হুমকি দেওয়ার কথা অভিযোগে উল্লেখ রয়েছে।’
অভিযোগে বলা হয়, ‘গত ২৭ ডিসেম্বর সংসদ সদস্য হাজী সেলিমের পাঠানো সন্ত্রাসী বাহিনী মার্কেট ভবনের নিচতলার গেট ও দোকানের শাটার ভাঙচুর করেছে। ২৮ ডিসেম্বর রাতে আবারও মার্কেটের দোতলার দোকানের শাটার ভাঙচুর চালিয়ে জবরদখল করে নেওয়ার অভিযোগ করা হয়।’
পৈতৃক সূত্রে পাওয়া স্থাবর সম্পত্তি চোখের সামনে জবরদখল হয়ে যাচ্ছে দেখে আমরা ভীতসন্ত্রস্ত অবস্থার মধ্যে থাকার কথা উল্লেখ করে র্যাবের কাছে দেওয়া অভিযোগে আরও বলা হয়, ‘আমরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি এবং জীবননাশের আশঙ্কা করছি।’
নিরাপত্তা বিধানসহ এনেক্স ফ্রেন্ডশিপ মার্কেটটি জবরদখলের হাত থেকে জরুরি ভিত্তিতে রক্ষায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে র্যাবের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন জমির অন্যতম মালিক মাধব বণিক।
সংসদ সদস্য হাজী সেলিম অসুস্থ থাকায় মার্কেট দখলের এই অভিযোগ সম্পর্কে তার সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি। তার ব্যক্তিগত সহকারী বেলাল হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও ফোন ধরেননি। পরে হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ পাঠানো হলেও তাতে সাড়া মেলেনি।
জমি দখলের সঙ্গে জড়িত হিসেবে অভিযুক্ত সাইদ হোসেন মল্লিকের কাছে জানতে চাইলে তিনি কালবেলাকে বলেন, ‘আমি এ রকম কোনো ঘটনা শুনিনি।’
বিষয়টি সম্পর্কে একেবারেই কোনো কিছু জানা নেই দাবি করে তিনি বলেন, ‘আমি এই প্রথম আপনার মুখ থেকে এরকম একটি ঘটনার কথা শুনেছি। খবর নিয়ে দেখব প্রকৃত ঘটনা আসলে কী।’
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহযোগিতায় মার্কেটের দখল ফিরিয়ে দেওয়ার দাবি জানিয়ে অন্যতম মালিক আম্বর বণিক কালবেলাকে বলেন, ‘আমাদের জমি অন্য লোক জোরপূর্বক নিয়ে যাবে, এটা হতে পারে না। দেশে আইন আছে। আমরা আইনের আশ্রয় নিয়েছি। আশা করি, ন্যায়বিচার পাব।’