রাজন ভট্টাচার্য
প্রকাশ : ২২ জানুয়ারি ২০২৪, ০৩:৪৩ এএম
আপডেট : ২২ জানুয়ারি ২০২৪, ১২:০৭ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ

বুড়ো হয়ে গেছে হামজা-রুস্তম

উদ্ধারকারী জলযান
উদ্ধারকারী জাহাজ হামজা। পুরোনো ছবি
উদ্ধারকারী জাহাজ হামজা। পুরোনো ছবি

পদ্মায় দুর্ঘটনার পর এখনো ৫০ ফুট পানির নিচে ফেরি ‘রজনীগন্ধা’। গত ১৮ জানুয়ারি দুর্ঘটনার চার দিন পরও ফেরি উদ্ধার করতে না পারায় এ নিয়ে নানা আলোচনা চলছে। মূলত ২০০ টন ওজনের কোনো জলযান ডুবে গেলে দেশে উদ্ধারের কোনো ব্যবস্থা নেই। বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ-বিআইডব্লিউটিএ চারটি উদ্ধারকারী জলযানের মধ্যে দুটির মেয়াদ শেষ। বুড়ো হয়ে গেছে উদ্ধারকারী দুটি জলযান। অন্য দুটি জাহাজ সংগ্রহের সময় উদ্ধারের যে সক্ষমতার কথা বলা হয়েছিল, বাস্তবে তা নেই। ফলে ভারী জলযান উদ্ধারে ৫২ বছরেও সক্ষমতা অর্জন করতে পারেনি দেশ।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ পরিস্থিতিতে দেশের বাইরে থেকে আসা কিংবা দেশে চলাচলকারী বড় ধরনের নৌ-দুর্ঘটনা ঘটলে তা উদ্ধার না করেই সান্ত্বনা খুঁজতে হবে। সেইসঙ্গে উন্নত প্রযুক্তি সমৃদ্ধ উদ্ধারকারী নৌযান আমদানি করারও পরামর্শ দিয়েছেন তারা।

জানা গেছে, বিআইডব্লিউটিএর বহুল আলোচিত উদ্ধারকারী জাহাজ ‘হামজা’ ও ‘রুস্তম’ এখন বয়সের ভারে কাহিল প্রায়। এর মধ্যে হামজার বয়স ৬২। হাফসেঞ্চুরির পথে ৪২ পা রেখেছে রুস্তম। এই দুই জাহাজের উত্তোলন সক্ষমতা ১২০ টন। অর্থাৎ কেনার সময় দুই জাহাজের এমন সক্ষমতা ছিল। বর্তমানে তা কমে দাঁড়িয়েছে পাঁচ ভাগের তিন ভাগে।

নৌ-চলাচল অধ্যাদেশ ১৯৭৬ অনুযায়ী উদ্ধারকারী এই নৌযানের মেয়াদ ছিল ৩০ বছর। পরে বিধি সংশোধন করে ৪০ বছর করা হয়। এই হিসাবে এ দুটি উদ্ধারকারী যানের মেয়াদ অনেক আগেই শেষ হয়েছে। তবুও নৌপথে যে কোনো দুর্ঘটনায় রুস্তম ও হামজাকে সবার আগে ভূমিকা পালন করতে হয়। সাম্প্রতিক সময়ে একাধিক দুর্ঘটনায় দেখা গেছে, উদ্ধারকারী দুটি যান ডুবন্ত নৌযানটিকে টেনে তুলতে পারেনি। এ থেকেই প্রমাণিত—এই যানগুলোর সক্ষমতা আর আগের মতো নেই।

নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০১২ সালে ৩৫৪ কোটি টাকায় দক্ষিণ কোরিয়া থেকে উদ্ধারকারী জাহাজ ‘প্রত্যয়’ ও ‘নির্ভীক’ সংগ্রহ করে সরকার। এর সঙ্গে জাহাজ টেনে নিতে দুটি টাগ বোট ‘দূরন্ত’ ও ‘দুর্জয়’ কেনা হয়। ১২০ মেট্রিক টন করে দুটি জাহাজের উদ্ধার সক্ষমতা ২৪০ টন বলা হয় দক্ষিণ কোরিয়ার পক্ষ থেকে। এটি মূলত কাগজপত্রের হিসাব।

২০১৪ সালে পিনাক লঞ্চডুবির ঘটনায় উদ্ধারকারী যান প্রত্যয় ও নির্ভীক দিয়ে বারবার চেষ্টার পর নৌযানটি পানির নিচ থেকে উত্তোলন সম্ভব হয়নি। একদিকে টাগ বোটের ক্রেন ১৮০ ডিগ্রির বেশি আড়াআড়ি কাজ করেনি। অন্যদিকে এ দুটি নৌযানে যে সক্ষমতার কথা বলা হয়েছিল, তা না থাকার বিষয়টি তখনই চাউর হয়।

নৌ পরিবহন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দক্ষ জনবলের অভাবে উদ্ধারকারী দুটি নৌযান কেনায় প্রতারণার শিকার হয়েছে বাংলাদেশ। এ ব্যাপারে পরবর্তী সময়ে কোরিয়ান প্রতিষ্ঠানকে কোন জবাবদিহির মধ্যেও আনা সম্ভব হয়নি।

সর্বশেষ পদ্মায় ডুবে যাওয়া ফেরি রজনীগন্ধা উদ্ধারে হামজা-রুস্তম ও প্রত্যয় মিলে চেষ্টা করছে। তবুও পানির নিচ থেকে তোলে আনা সম্ভব হচ্ছে না। বিআইডব্লিউটিএর যুগ্ম পরিচালক এস এম আজগর আলী জানান, উদ্ধার কাজে অনুসন্ধানে গতি আনতে নারায়ণগঞ্জ থেকে ঝিনাই-১ নামে একটি জাহাজ ডাকা হয়েছে। জাহাজটিতে মাল্টিভিম ইকো সাইন্ডার রয়েছে। যার মাধ্যমে পানির নিচে কোনো বস্তু থাকলে সেটি শনাক্ত করা যাবে। এর মাধ্যমে নিখোঁজ ব্যক্তি ও ট্রাকের সন্ধান মিলবে আশা করি।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোনো নৌযান ডুবে গেলে এর ওজন দুই থেকে আড়াইগুণ পর্যন্ত হয়ে যায়। প্রথমে পানি ওঠে, তারপর উদ্ধারে বিলম্ব হলে দ্রুত পলি জমে ওজন বাড়ে। যে নদীতে পলি যত বেশি, সেখানে ডুবন্ত নৌযান উত্তোলন কঠিন হয়।

নৌ সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক আশীষ কুমার দে কালবেলাকে বলেন, ফেরিসহ যে কোনো নৌযান ডুবে গেলে পলি-পানিসহ মালপত্র থাকলে ওজন দ্বিগুণের বেশি ছাড়িয়ে যায়। বর্তমানে দেশে থাকা চারটি উদ্ধারকারী জাহাজের ২০০ টনের বেশি নৌযান উদ্ধারের সক্ষমতা নেই। এরচেয়ে বেশি ওজনের কোন নৌযান ডুবে গেলে বা দুর্ঘটনায় পতিত হলে, তা পানির নিচেই থেকে যাবে।

পদ্মায় ডুবে যাওয়া ফেরিটির ওজন শতটন হবে বলে জানা গেছে। ডুবে যাওয়ার পর এর ওজন ২০০ টন ছাড়িয়ে গেছে। ডুবে যাওয়া জায়গাটিতে গভীর পানি ও স্রোত থাকায় এই ফেরিটি উদ্ধারে অনিশ্চয়তা রয়ে গেছে। এদিকে ২০২২ সালের সর্বশেষ সরকারি হিসাব অনুযায়ী দেশে নিবন্ধিত নৌযানের সংখ্যা ১৬ হাজার ৯৮০। এর মধ্যে কমপক্ষে ৩০ হাজার বালু ও পণ্যবাহী নৌযান চলছে কোনোরকম নিবন্ধন ছাড়াই।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুর্ঘটনা গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. হাদিউজ্জামান নৌ দুর্ঘটনা কমাতে কার্যকরী পদক্ষেপের দিকে হাঁটার পরামর্শ দিয়ে তিনি কালবেলাকে বলেন, নৌপথের সড়কের মতো সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। এখানেও নিয়মের বালাই নেই। মোট নৌযানের অর্ধেকের বেশি অনিবন্ধিত জানিয়ে তিনি বলেন, এসব যানের চালকের প্রশিক্ষণ নেই। মাস্টার, সারেং থেকে শুরু করে একজন মেরিন ইঞ্জিনিয়ার থাকার কথা থাকলেও নেই। চালকের প্রশিক্ষণ, চালক ও যানের রেজিস্ট্রেশন, লাইসেন্স, ফিটনেস কিছুই নেই। নিয়ম অনুযায়ী পণ্যবাহী নৌযানের ক্ষেত্রে চার বছর ও যাত্রীবাহী নৌযানের ক্ষেত্রে দুই বছর পরপর ডকিং ইয়ার্ডে তুলে ফিটনেস দেওয়ার কথা; কিন্তু পানিতে থাকা নৌযান ফিটনেস পাচ্ছে না। অনিবন্ধিত নৌযানের তো ফিটনেস পাওয়ার সুযোগ নেই।

নৌ-দুর্ঘটনা কমাতে সব নৌযান নৌ শুমারিতে নিবন্ধনের পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, ১৯৭৪ সালের অর্ডিন্যান্স অনুযায়ী ২০ কিলোমিটারের বেশি পথে নৌযান চললে নিবন্ধন বাধ্যতামূলক। তা দেখার কেউ নেই। অথচ চারটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে নৌ সেক্টরের সঙ্গে যুক্ত। রাজনৈতিক ধারায় চলছে এই মন্ত্রণালয়।

নৌযানে জি পিএম প্রযুক্তি স্থাপনের পরামর্শ দিয়ে এই বিশেষজ্ঞ বলেন, এই প্রযুক্তির ফলে নৌযান দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা সম্ভব। ওভার লোড হলে ইঞ্জিন সয়ংক্রিয়ভাবে বন্ধ হয়ে যায়। ইমার্জেন্সি অ্যালার্ম বাজে। তেমন কোনো প্রযুক্তি আমাদের নৌযানগুলোতে নেই।

দুর্ঘটনায় পতিত হওয়ার পর জানমাল রক্ষায় প্রতিটি সেকেন্ড খুবই গুরুত্বপূর্ণ উল্লেখ করে তিনি বলেন, অথচ উদ্ধারকারী নৌযানের অভাবে অনেক ক্ষতি হয়। নৌ-পরিবহন সেক্টরে কোনো আইন না থাকাই প্রমাণ করে, এই সেক্টর অবহেলিত। বেপরোয়া সেক্টর। যেখানে প্রয়োজনীয় উদ্ধার সরঞ্জাম নেই। দুর্ঘটনা কবলিত নৌযান উদ্ধারকাজে প্রাতিষ্ঠানিক সফলতার ঘাটতি একটি বড় বিষয়।

বিআইডব্লিউটিএ চেয়ারম্যান কমডোর আরিফ আহমেদ মোস্তফার সঙ্গে যোগাযোগ করলেও মোবাইল ফোনে তাকে পাওয়া যায়নি।

বিআইডব্লিউটিএ নৌ-সংরক্ষণ ও পরিচালন বিভাগের পরিচালক মো. শাহজাহান এ ব্যাপারে তাৎক্ষণিক কোনো মন্তব্য দিতে রাজি হননি।

লঞ্চ মালিক সমিতির কেন্দ্রীয় সহসভাপতি সাইদুর রহমান রিন্টু কালবেলাকে বলেন, ‘সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তর দেশে সর্বোচ্চ চার হাজার টন ওজনের জাহাজ নির্মাণের অনুমতি দিচ্ছে। বিশেষ করে বরিশাল-ঢাকা নৌ-রুটে চলাচলকারী যাত্রীবাহী এক একটি জাহাজের ওজন তিন থেকে চার হাজার টন। আর আইডব্লিউটিএর উদ্ধারকারী জাহাজের উত্তোলন ক্ষমতা রয়েছে মাত্র আড়াইশ টন।’ যে কোনো ধরনের বিপদ মোকাবিলায় ক্ষমতাসম্পন্ন উদ্ধারকারী জাহাজ সংগ্রহের দাবি জানান এ ব্যবসায়ী নেতা।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

বালু-পাথর নিয়ে সিলেট জেলা প্রসাশনের নতুন নির্দেশনা

‘কুত্তার মতো পেটায়, এজন্য কি যুদ্ধ করেছিলাম’, আদালতে রিয়াদ

কুয়েট শিক্ষার্থীদের রেললাইন অবরোধ

ভোটকেন্দ্রে সেনাবাহিনী রাখা নিয়ে উমামার উদ্বেগ

বিনামূল্যে অতিরিক্ত ব্যাগেজ সুবিধা নিয়ে ‘বড় সুখবর’ দিল নভোএয়ার 

আমির হোসেন আমুর সহকারী আজাদ গ্রেপ্তার

বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের ভাষা এক হলে আমি কী করব : মমতা

একসঙ্গে ২২৫ কর পরিদর্শককে বদলি

আমাদের সময় বেশি দিন নাই : স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা

কুকুরের তাড়া খেয়ে ড্রেনে পড়ে স্কুল শিক্ষার্থীর মৃত্যু

১০

সুন্দরবনে মুক্তিপণের জন্য চার জেলেকে অপহরণ

১১

তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের খসড়া সংশোধনী অবিলম্বে পাসের দাবি

১২

বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্স চালকদের অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘট ঘোষণা

১৩

পিআর টিআর বুঝি না, আগের পদ্ধতিতে নির্বাচন হবে : বুলু

১৪

হাসিনা গেল, কিন্তু হাসিনার পুলিশ গেল না : ফাইয়াজ

১৫

‘নগদ’র জন্য বিনিয়োগকারী খুঁজছে বাংলাদেশ ব্যাংক

১৬

ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে ১৯ গরু ও ২ লাখ টাকা লুট

১৭

গাজার অসহায় মানুষের পাশে বাংলাদেশি ৪ তরুণ

১৮

আসামে ‘দেখামাত্র গুলির নির্দেশ’ দুর্গাপূজা পর্যন্ত বহাল

১৯

বরিশাল নার্সিং কলেজে চোখে কালো কাপড় বেঁধে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ

২০
X