আতাউর রহমান
প্রকাশ : ০৯ জুলাই ২০২৩, ১২:০০ এএম
আপডেট : ০৯ জুলাই ২০২৩, ০১:৫৯ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ

রোহিঙ্গা ক্যাম্পের অস্ত্রবাজি জাতীয় নিরাপত্তায় ঝুঁকি

গোলাগুলিতে প্রাণহানি বেড়েই চলেছে
রোহিঙ্গা ক্যাম্প। পুরনো ছবি
রোহিঙ্গা ক্যাম্প। পুরনো ছবি

কক্সবাজারের টেকনাফ ও উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোয় একের পর এক গোলাগুলিতে প্রাণহানির ঘটনা বেড়েই চলেছে। ক্যাম্পগুলোতে প্রতিনিয়ত অস্ত্রের এমন ঝনঝনানি জাতীয় নিরাপত্তা ঝুঁকিতে পড়বে বলেও মনে করছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা। দুপক্ষের গোলাগুলি আঞ্চলিক নিরাপত্তার হুমকিও তৈরি করছে বলে তারা মত দিয়েছেন।

সর্বশেষ গত শুক্রবার ভোরে উখিয়ার বালুখালী আশ্রয়শিবিরে (ক্যাম্প-৮ পশ্চিম) মিয়ানমারের সশস্ত্র গোষ্ঠী রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন (আরএসও) এবং মিয়ানমারের সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান স্যালভেশন আর্মির (আরসা) মধ্যে গোলাগুলিতে পাঁচ রোহিঙ্গা নিহত হন। ক্যাম্পের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন) বলছে, নিহত পাঁচজনই আরসার সন্ত্রাসী।

এর ৯ ঘণ্টা পর ১১ নম্বর ক্যাম্পে ছুরিকাঘাতে খুন হন ছানা উল্লাহ (৪৩) নামে আরেক রোহিঙ্গা যুবক। এর আগে গত বৃহস্পতিবার আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে (আইসিসি) সাক্ষ্য দিতে ইচ্ছুক রোহিঙ্গাদের ডেকে আনতে গিয়ে উখিয়ার লম্বাশিয়া ক্যাম্পে ছুরিকাঘাতে নিহত হন মো. এবাদুল্লাহ (২৭) নামে এক রোহিঙ্গা মাঝি (নেতা)।

হঠাৎ করে আরসা ও আরএসও গ্রুপের তৎপরতা বৃদ্ধির পর এমন খুনোখুনিতে ক্যাম্পজুড়ে সাধারণ রোহিঙ্গাদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে।

নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন, ক্যাম্পগুলোতে এ ধরনের গোলাগুলি স্থানীয়ভাবে নিরাপত্তা বিঘ্ন ঘটাচ্ছে। এটি চলতে থাকলে জাতীয় এবং আঞ্চলিক নিরাপত্তায়ও এর প্রভাব পড়বে। দ্রুত রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনই এ সমস্যার সমাধান বলেও তারা মনে করছেন। পাশাপাশি ক্যাম্পগুলোতে এমন অস্ত্র বা সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলো কীভাবে প্রবেশ করার সুযোগ পাচ্ছে, সে প্রশ্ন করছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা।

অবশ্য গত শুক্রবার ঢাকায় এক অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, মিয়ানমারের বিচ্ছিন্নতাবাদী জনগোষ্ঠী মাঝেমধ্যে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে ঢুকে হত্যার ঘটনা ঘটিয়ে যাচ্ছে। এসব বিছিন্নতাবাদী যাতে সীমান্তে অনুপ্রবেশ করতে না পারে, সেজন্য বর্ডার ফোর্সকে আরও শক্তিশালী করা হচ্ছে।

নিরাপত্তা জোরদারের পরও কীভাবে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অস্ত্র ঢুকছে—এমন প্রশ্নে মন্ত্রী বলেন, ‘মিয়ানমারের সঙ্গে কিছু সীমান্ত এলাকা অরক্ষিত রয়েছে। যেসব এলাকায় কোনো যাতায়াত নেই। নাফ নদের এমন কয়েকটি চরের মতো জায়গাও রয়েছে, যেখানে মিয়ানমার ও বাংলাদেশের নো-ম্যানস ল্যান্ড রয়েছে। সেখানে তারা অভয়ারণ্য তৈরি করেছে। সেখানে তারা অহরহ যাতায়াতও করছে। আমরা সে জায়গাগুলোর জন্য নিরাপত্তা বাড়াচ্ছি।’

রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে নিরাপত্তা ব্যবস্থার বিষয়ে নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের প্রেসিডেন্ট মেজর জেনারেল (অব.) আ না ম মুনীরুজ্জামান কালবেলাকে বলেন, যখনই কোনো দেশে দীর্ঘস্থায়ী এ ধরনের উদ্বাস্তু ক্যাম্প থাকে, তখনই সেখানকার মানুষ এ ধরনের নিরাপত্তাজনিত বিষয়গুলোতে জড়িয়ে যায়। ক্যাম্পগুলোতে নিরাপত্তা রক্ষায় সব ধরনের চেষ্টা করা হলেও বিভিন্ন গোষ্ঠী তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টায় থাকে এবং তা করেও। এভাবেই উদ্বাস্তু ক্যাম্পগুলোতে মাদক, গোলাবারুদ, অস্ত্র বা ক্ষুদ্রাস্ত্র চলে আসে।

ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের মধ্যে গোলাগুলির বিষয়ে এই নিরাপত্তা বিশ্লেষক বলেন, বর্তমানে দেখা যাচ্ছে, ক্যাম্পের ভেতরে বিভিন্ন গোষ্ঠী বিভক্ত হয়ে গেছে। বাইরের বা মিয়ানমারের কিছু গোষ্ঠী এভাবে যোগাযোগ করে রোহিঙ্গাদের বিভক্ত করেছে। সে কারণে ক্যাম্পে নিজেদের গ্রুপগুলোর সঙ্গে প্রায়ই গোলাগুলি ঘটছে, প্রাণহানি হচ্ছে। স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে গোলাগুলি হচ্ছে, মৃত্যু হচ্ছে।

ক্যাম্পে এ ধরনের গোলাগুলিতে বাইরের নিরাপত্তা কতটা বিঘ্ন হওয়ার শঙ্কা রয়েছে—জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটি ওই অঞ্চলে, ওই এলাকার (কক্সবাজার) মানুষের জন্য তো অবশ্যই নিরাপত্তা হুমকি। বরং জাতীয় নিরাপত্তার জন্য এটি একটি বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটি এভাবে চলতে থাকলে আঞ্চলিক নিরাপত্তার ওপরেও বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ হয়ে আসবে।

ক্যাম্পে গোলাগুলি ঠেকানোর বিষয়ে মেজর জেনারেল (অব.) মুনীরুজ্জামান বলেন, এ ধরনের ক্যাম্পে মাদক, অস্ত্র, গোলাবারুদ বা হানাহানি সম্পূর্ণভাবে পরিষ্কার করা যায় না। উদ্বাস্তু ক্যাম্পের বাসিন্দাদের ভেতরে যেহেতু কোনো আশা থাকে না, তারা সব জিনিসে জড়িত থাকার বিষয়ে প্রস্তুত থাকে।

নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) আবদুর রশীদ কালবেলাকে বলেন, ক্যাম্পগুলোতে রোহিঙ্গাদের গ্রুপগুলো অন্তর্কলহ আছে। এই কলহের জেরে তারা যে গোলাগুলি করছে, মৃত্যু ঘটাচ্ছে—তা বাংলাদেশের মাটিতে ঘটাচ্ছে। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ঠেকাতে বা তা ধীরগতিতে ফেলতে স্বার্থবাদী নানা গ্রুপ হয়তো এই কলহের পেছনে রয়েছে। ক্যাম্পের বিদ্রোহী গোষ্ঠী বা সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলো বাইরের উসকানিতেও সন্ত্রাসী কার্যকলাপ চালাতে পারে।

ক্যাম্পের ভেতর প্রতিনিয়ত এই গোলাগুলি, এ প্রাণহানি বড় চিন্তার কারণ উল্লেখ করে তিনি বলেন, এটি যদি ঠেকানো না যায়, তাহলে একটা সময়ে এই অস্ত্রের ব্যবহার ক্যাম্পের ভেতর সীমাবদ্ধ থাকবে না। এটি আমাদের অবশ্যই উদ্বিগ্ন করে। এটি ঠেকাতে না পারলে জাতীয় নিরাপত্তা বিঘ্নিত করবেই। তিনি বলেন, হয়তো এ ধরনের ক্যাম্পে নানা নিরাপত্তা সমস্যা থাকবে, স্বার্থবাদীরা সমস্যা তৈরি করে রাখার চেষ্টা করবে—এজন্য পুরোপুরিভাবে অস্ত্রের ঝনঝনানি থামানো সম্ভব নয়; কিন্তু এটির একমাত্র সমাধান রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন করে নিজ দেশে ফেরত পাঠানো।

রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোর নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা এপিবিএন সূত্র জানায়, গত পাঁচ বছরে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোয় ১৪৭ জন খুন হয়েছেন। তাদের বেশিরভাগই রোহিঙ্গা মাঝি (নেতা) ও স্বেচ্ছাসেবক। শুরুর দিকে এসব খুনে আরসার জড়িত থাকা নিয়ে ভিন্ন মত থাকলেও সম্প্রতি আরসা জড়িত বলে প্রমাণ মিলেছে। এ ছাড়া সাম্প্রতিক কয়েকটি ঘটনায় আরএসওর নামও এসেছে।

পাঁচ বছরে ১৪৭ নিহতের ঘটনার মধ্যে গত ছয় মাসে দুপক্ষের সংঘর্ষ ও গোলাগুলির ঘটনায় অন্তত ৫৬ জন নিহত হন। তাদের মধ্যে ১৭ জন রোহিঙ্গা মাঝি, ১১ জন আরসা সদস্য, একজন স্বেচ্ছাসেবক ও অন্যরা সাধারণ রোহিঙ্গা।

রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোর মধ্যে বেশিরভাগের নিরাপত্তার দায়িত্বে রয়েছে ৮ এপিবিএন। ওই ইউনিটের অধিনায়ক অতিরিক্ত ডিআইজি মো. আমির জাফর কালবেলাকে বলেন, ক্যাম্পগুলোর নিরাপত্তায় আমরা প্রতিনিয়ত অভিযান চালিয়ে যাচ্ছি। অস্ত্র ও অবৈধ মাদক উদ্ধারে যৌথ অভিযানের পাশাপাশি এসব অবৈধ অস্ত্র-মাদক যাতে ক্যাম্পগুলোতে ঢুকতে না পারে, সেজন্য গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে অভিযান ও নজরদারি চলে।

তিনি বলেন, এমনিতেই ক্যাম্পে নিরাপত্তা জোরদার থাকে। শুক্রবারের ঘটনার পর তা আরও জোরদার করা হয়েছে। পাশাপাশি সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তারে যৌথ অভিযান শুরু হয়েছে।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

ভোটের মাঠে ননদ-ভাবি মুখোমুখি

প্রত্যয়ের বিশেষ আয়োজন ‘মিনার মনসুর সকাল রোদ্দুর’

ঝিনাইদহের প্রথম এমবিবিএস চিকিৎসকের মৃত্যু

মৌলভীবাজারে ছাত্রদলের মিছিল থেকে আটক ২

বে গ্রুপে চাকরির সুযোগ, লাগবে স্নাতক ডিগ্রি

থানায় ঢুকে প্রার্থীর ওপর হামলার অভিযোগ তদন্তের নির্দেশ ইসির

উত্তপ্ত শহরে নারীদের বাসযোগ্য করে তুলতে কাজ করছি : হিট অফিসার

৪ জেলায় ৮০ কিমি বেগে ঝড়ের শঙ্কা 

দেয়াল ছাড়াই হাসপাতালের ফ্লোর, ১২তলা থেকে পড়ল রোগী

ফিলিস্তিনের ৫০ শিক্ষার্থীকে স্কলারশিপ দেবে আইআইইউসি

১০

রেলের ভাড়া বাড়ানো অযৌক্তিক ও অমানবিক : জি এম কাদের

১১

‘সংস্কৃতি ও ক্রীড়া ক্ষেত্র থেকে আমরা দূরে সরে যাচ্ছি’ 

১২

জয়পুরহাটে স্বস্তির বৃষ্টি

১৩

ভাঙ্গা-চন্দনা কমিউটার ট্রেনে যাত্রীপ্রতি অতিরিক্ত টোল, ভাড়া বাড়ায় অসন্তোষ

১৪

সেনাবাহিনী দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে : সেনাপ্রধান

১৫

আমলারা কীভাবে সন্তানদের জন্য আলাদা বিশ্ববিদ্যালয় দাবি করে?

১৬

পশ্চিমাঞ্চল রেলে ভয়াবহ শিডিউল বিপর্যয়, চরম ভোগান্তিতে যাত্রীরা

১৭

চাকরি দিচ্ছে বাংলালিংক, কর্মস্থল ঢাকা

১৮

যশের ছবি থেকে সরলেন কারিনা কাপুর (ভিডিও)

১৯

মিল্টন সমাদ্দার গ্রেপ্তারে মিরপুরে মিষ্টি বিতরণ 

২০
*/ ?>
X