পাকিস্তানে জাতীয় নির্বাচনের ফলে কোনো দলই একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। এতে জোট করে সরকার গঠনই একমাত্র পথ। এমনিতে দেরিতে নির্বাচনী ফল প্রকাশ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এখন ফল জানার পর সরকার গঠন নিয়ে দেখা দিয়েছে নতুন অনিশ্চয়তা। সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের পিটিআই সমর্থিত স্বতন্ত্ররা ১০১ আসন নিয়ে সবার থেকে এগিয়ে থাকলেও তাদের সরকার গঠন করা সুদূরপরাহত। প্রধান দুই দল এমন আসন পেয়েছে যে, তাদের অন্যদের সঙ্গে জোট করতেই হচ্ছে। এর পরও তিন দিনের মধ্যে জোট করে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনের সমর্থনের কথা কর্তৃপক্ষকে না জানাতে পারলে হস্তক্ষেপ করতে পারে সামরিক বাহিনী। সব মিলিয়ে এখন নানা সমীকরণের মুখে অর্থনৈতিকভাবে বিধ্বস্ত পাকিস্তান।
গত বৃহস্পতিবার পাকিস্তানে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশ সময় সন্ধ্যা ৬টায় শেষ হয় ভোট গ্রহণ। প্রায় ১২ ঘণ্টা পর শুক্রবার ভোর থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে ফল ঘোষণা শুরু করে পাকিস্তান নির্বাচন কমিশন (ইসিপি)। রোববার প্রকাশিত পূর্ণাঙ্গ ফলে পিটিআই সমর্থিত স্বতন্ত্ররা ১০১ আসন নিয়ে এগিয়ে থাকলেও সরকার গড়তে হলে তাদের অন্য কোনো দলে যোগ দিতে হবে। তাদের প্রতিপক্ষ নওয়াজ শরিফ নেতৃত্বাধীন পিএমএল-এন ৭৫ আসন নিয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে আছে। এ দুই দলের কোনোটিকে সরকার গঠন করতে হলে সমর্থন নিতে হবে পিপিপির। ৫৪ আসন নিয়ে সুবিধাজনক অবস্থায় থাকা পিপিপি এ সুযোগে দলটির চেয়ারম্যান বিলাওয়াল ভুট্টো জারদারিকে প্রধানমন্ত্রী বানানোর শর্ত দিয়েছে। এ ছাড়া এমকিউএম ১৭ আসনে জয়ী হয়েছে। আর অন্যান্য দল পেয়েছে ১৭টি আসন।
দেশটির জাতীয় পরিষদের ২৬৬ আসনের মধ্যে ২৬৫ আসনে (একটি স্থগিত) ভোট হয়েছে। একটি আসনে ফল স্থগিতের ঘোষণা দেয় নির্বাচন কমিশন। ফলে ২৬৪ আসনে ফল ঘোষণা করা হয়েছে। সরকার গঠনে প্রয়োজন হয় ১৩৪ আসন।
সরাসরি ভোট হওয়া এসব আসন ছাড়া আরও ৭০টি আসন রয়েছে সংরক্ষিত। এসব আসনের মধ্যে ৬০টি নারীদের ও ১০টি সংখ্যালঘুদের। সরাসরি ভোট হওয়া আসনে জয়ের অনুপাতে এগুলো পায় দলগুলো।
কমিশনের ঘোষিত ফলে দেখা যাচ্ছে, সবচেয়ে বেশি আসনে জয়ী হয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। তারা মূলত পিটিআইর সমর্থন নিয়ে জয় পেয়েছেন। এ নির্বাচনে ইমরান খানের দলটিকে দলীয়ভাবে নির্বাচনে অংশ নিতে দেওয়া হয়নি। তাদের নির্বাচনী প্রতীকও ব্যবহার করা হয়নি। এখন তাদের হয় কোনো দলে যোগ দিতে হবে বা নিজেরা জোট করে কমিশনকে জানাতে হবে। দেশটির সুপ্রিম কোর্টও তাদের তিন দিনের মধ্যে যে কোনো দলে যোগ দিয়ে কর্তৃপক্ষকে জানাতে নির্দেশ দিয়েছেন।
জয়ের দাবি করে কারাবন্দি ইমরান খান তার কর্মী-সমর্থকদের এই বিজয় উদযাপনের আহ্বান জানিয়েছেন। অতীত ছেড়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার কথা বলেছেন তিনি। তাই প্রশ্ন উঠেছে, স্বতন্ত্ররা পরবর্তী কেন্দ্রীয় সরকার গঠন করতে একত্রিত হতে পারেন কি না।
এদিকে নওয়াজ শরিফও নির্বাচনে জয় দাবি করেছেন। নিজের বিজয়ী বক্তৃতায় তিনি দাবি করেছেন, পিএমএল-এন সাধারণ নির্বাচনে কেন্দ্র ও পাঞ্জাবের একক বৃহত্তম দল হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। কৌশলগতভাবে নওয়াজ সঠিক কথাই বলেছেন। কারণ তিনি দাবি করেছেন, পিএমএল-এন নির্বাচনের পরে বৃহত্তম রাজনৈতিক দল হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এর কারণ হলো, পিটিআইকে দল হিসেবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে দেওয়া হয়নি।
পাকিস্তান ইনস্টিটিউট অব লেজিসলেটিভ ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড ট্রান্সপারেন্সির (পিআইএলডিএটি) সভাপতি আহমেদ বিলাল মেহবুব বলেছেন, পিএমএল-এন বা পিপিপির মতো বড় রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জোট গঠন না করে স্পষ্টতই পিটিআই সরকার গঠনের মতো অবস্থানে নেই। কারণ পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠতা দাবি করার মতো প্রয়োজনীয় সংখ্যক আসন তারা পায়নি।
এমনকি বাকি আসনগুলোর ফলও যদি কোনো একক দলের পক্ষে যায়, তার পরও তা সরকার গঠনের জন্য পর্যাপ্তসংখ্যক আসন হবে না। কারণ এখন পর্যন্ত স্বতন্ত্র প্রার্থীরা আসনের দিক থেকে এগিয়ে।
সংবিধানের নিয়ম অনুযায়ী, চূড়ান্ত ফল ঘোষণার তিন দিনের মধ্যে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের জানাতে হবে, তারা কোনো দলে যোগ দেবেন নাকি স্বতন্ত্র হিসেবেই থাকবেন। এমন অবস্থায় পিটিআই-অনুমোদিত স্বতন্ত্ররা তিন দিনের মধ্যে পিটিআইতে আবারও যোগ দিতে চাইলে কী হবে? আহমেদ বিলাল মেহবুব বলেছেন, এটা সম্ভব। তবে আছে নানা জটিলতা।
তবে তিনি বলেন, পিটিআই-সমর্থিত প্রার্থীরা কোনো দলে যোগ না দিলেও তারা জাতীয় পরিষদে বিরোধীদলীয় নেতার পদ পেতে পারেন। এর জন্য তাদের জাতীয় পরিষদের স্পিকারের কাছে একটি আবেদন জমা দিতে হবে যে, তারা তাদের মনোনীত কোনো একজন প্রার্থীকে সমর্থন করেন।
এদিকে পিপিপির চেয়ারম্যান বিলাওয়াল ভুট্টোকে প্রধানমন্ত্রী বানানোর শর্তে পিএমএল-এনের সঙ্গে পিপিপি সমঝোতায় রাজি আছে বলে জানিয়েছেন দেশটির সাবেক প্রেসিডেন্ট আসিফ আলি জারদারি। প্রধানমন্ত্রীর পদ ছাড়াও আরও কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় পিপিপিকে দেওয়া হলে শরিফের দলের সঙ্গে পিপিপি জোট সরকার গঠন করবে বলে জানিয়েছেন তিনি।
তাই সব সমীকরণ মিলিয়ে বলা যায়, পরবর্তী সরকার গঠন নির্ভর করছে পিপিপির সমর্থনের ওপর। এদিকে সরকার গঠনে জোর তৎপরতা শুরু করা পিএমএল-এনের সঙ্গে সমঝোতা করেছে এমকিউএম-পিও।
এদিন পিপিপির চেয়ারম্যানের লাহোরের বাসভবনে যায় পিএমএল-এনের প্রেসিডেন্ট শাহবাজ শরিফের নেতৃত্বাধীন একটি প্রতিনিধিদল। সেখানে দুপক্ষ দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন। ওই বৈঠকে ‘দেশকে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা রক্ষায়’ দুপক্ষের মধ্যে মতৈক্য হয়েছে বলে পিএমএল-এনের বিবৃতিতে জানানো হয়েছে। ওই বৈঠকের পিপিপির সহযোগিতা চেয়েছে পিএমএল-এন। জবাবে পিপিপি জানায়, আজ সোমবার তাদের প্রস্তাব নিয়ে পিপিপি আলোচনা করবে।
অন্যদিকে কমিশনকে চাপে রাখতে পিটিআই সমর্থিত প্রার্থীর হারা আসনে নির্বাচনে অভিযোগ তুলে মামলার পাশাপাশি মাঠে বিক্ষোভ-আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে দলটি। গতকাল তারা লাহোর, ইসলামাবাদসহ কয়েকটি শহরে বিক্ষোভ করেছে। এ সময় তাদের কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়।
ফল দেরির প্রতিবাদে চলা বিক্ষোভে গুলিতে ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক মুভমেন্টের (এনডিএম) দুই কর্মী নিহত হয়েছেন। দলের প্রধানসহ আহত হয়েছেন ১৫ জন। দেশটির খাইবার পাখতুনখাওয়া প্রদেশের উত্তর ওয়াজিরিস্তানে মমিরামশাহ ক্যান্টনমেন্টে বিক্ষোভ চলার সময় পুলিশ গুলি চালিয়েছে বলে অভিযোগ করেছে এনডিএম।
অর্থনৈতিকভাবে বিধ্বস্ত পাকিস্তানে দরকার ছিল একটি স্থিতিশীল সরকার। তবে নির্বাচনে কোনো দল একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পাওয়ায় বিভক্ত সরকার পেতে যাচ্ছে দেশটি। এতে আইএমএফের ঋণসহায়তা নিয়েও ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।
দেশের সংকট সমাধানে সবাইকে ঐক্য গঠনের আহ্বান জানানো হয়েছে সামরিক বাহিনীর পক্ষ থেকেও। সব কিছুর পরও রাজনৈতিক দলগুলো সরকার গঠন করতে না পারলে সেনাবাহিনী তাতে হস্তক্ষেপ করতে পারে। কারণ দেশটিতে সামরিক বাহিনী সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান। এর আগেও কয়েক দফায় তারা সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়েছে। সূত্র: বিবিসি, আলজাজিরা ও এক্সপ্রেস ট্রিবিউন।