ঢাকার সমাবেশ থেকে সরকার পতনের একদফা আন্দোলন ও নতুন কর্মসূচির ঘোষণা দিতে যাচ্ছে বিএনপি। এমন প্রেক্ষাপটে একদফা দাবির ভিত্তিতে ঢাকাকেন্দ্রিক সিরিজ কর্মসূচির কথা ভাবা হচ্ছে। কর্মসূচি চূড়ান্ত না হলেও আগামী শুক্রবার ঢাকাজুড়ে মানববন্ধন বা মানবপ্রাচীর অথবা বিক্ষোভের মধ্য দিয়ে একদফার আন্দোলনের সূচনা হতে পারে। আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) প্রতিনিধিদলের ঢাকা সফরের মধ্যে যুগপৎ আন্দোলন শুরুর চিন্তা বিএনপির। এর মধ্য দিয়ে ঈদুল ফিতরের পর ফের মাঠে গড়াবে তাদের আন্দোলন।
এদিকে ঢাকাজুড়ে মানববন্ধনের পর পর্যায়ক্রমে পদযাত্রা, অবস্থান ধর্মঘট, সমাবেশের মতো কর্মসূচি ঘুরেফিরে আসতে পারে। আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে আসবে ঘেরাওয়ের কর্মসূচি। এতদিন ধরে ঢাকার বাইরে কর্মসূচি হলেও একদফা আন্দোলনের মূল কেন্দ্রবিন্দু হবে রাজধানী ঢাকা। সব কর্মসূচি পালন হবে যুগপৎভাবে। বিএনপিসহ যুগপতের শরিকরা আগামীকাল বুধবার যার যার প্ল্যাটফর্ম থেকে একদফার আন্দোলন ও নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করবে। ওইদিন ‘রাষ্ট্র মেরামতের যৌথ রূপরেখাও’ ঘোষণা হতে পারে। বিএনপি ওইদিন নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে এ যাবৎকালের সর্ববৃহৎ সমাবেশ করে এই দুটি ঘোষণা দেবে। আর গণতন্ত্র মঞ্চ ওইদিন জাতীয় প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে ঘোষণা দেবে। গতকাল সোমবার বিকেলে রাজধানীর গুলশানে চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত গণতন্ত্র মঞ্চের সঙ্গে বিএনপির বৈঠকে এ ব্যাপারে প্রাথমিক সিদ্ধান্ত হয়। রাতে বিএনপির স্থায়ী কমিটির ভার্চুয়াল বৈঠকে কর্মসূচি নির্ধারণসহ সার্বিক ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হওয়ার কথা রয়েছে।
গণতন্ত্র মঞ্চ ছাড়াও গতকাল এলডিপি ও গণঅধিকার পরিষদের রেজা কিবরিয়া অংশের সঙ্গেও বৈঠক করেছে বিএনপি। এর আগে গত সপ্তাহে জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট, ১২-দলীয় জোট এবং গণফোরাম ও পিপলস পার্টির সঙ্গে বৈঠক করেছে বিএনপি। সেখানে জোটগুলোর কাছ থেকে যেমন কর্মসূচির প্রস্তাবনা নিয়েছে, তেমনি বিএনপি কী ধরনের কর্মসূচির কথা ভাবছে—তাও জানানো হয়েছে। বিএনপি সমাবেশ ও ঘেরাওয়ের মতো কর্মসূচির কথা ভাবছে বলে শরিকদের জানায়। তবে এসব বৈঠক থেকে ঢাকামুখী রোডমার্চ ও লংমার্চের মতো নিয়মতান্ত্রিক শান্তিপূর্ণ কর্মসূচির পাশাপাশি হরতাল, অবরোধ ও অসহযোগ আন্দোলনের ব্যাপারেও মত দেন জোট নেতারা। তবে বৈঠকে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর হরতালের প্রস্তাব নাকচ করে দিয়ে বলেছেন, এ ধরনের কর্মসূচির নেতিবাচক দিক বেশি। শুরুতে এই কর্মসূচি দেওয়া যাবে না।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গতকাল ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, সরকার পরিবর্তনে চলমান আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ের কর্মসূচি বুধবার ঘোষণা করা হবে। যুগপৎ আন্দোলনে থাকা সব দল যার যার অবস্থান থেকে একদফার আন্দোলনের ঘোষণা দেবে। ওইদিন আন্দোলনের নতুন মাত্রার কর্মসূচির ঘোষণা দেওয়া হবে।
গণতন্ত্র মঞ্চের শরিক ভাসানী অনুসারী পরিষদের আহ্বায়ক শেখ রফিকুল ইসলাম বাবলু গতকাল কালবেলাকে বলেন, ৩১ দফা কর্মসূচির ভিত্তিতে একদফার আন্দোলনে যাবে গণতন্ত্র মঞ্চ। ১২ জুলাই জাতীয় প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে এই কর্মসূচি জাতির সামনে তুলে ধরা হবে।
জানা গেছে, অহিংস পথেই চূড়ান্ত আন্দোলনের সূচনা করতে চাইছে বিএনপি। এর মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক মহলকে দলটি এই বার্তা দিতে চায় যে, তারা সহিংসতায় বিশ্বাস করে না। তাই হরতাল-অবরোধের মতো ধ্বংসাত্মক কর্মসূচিতে যাচ্ছে না বিএনপি। সতর্কতার সঙ্গে জনসম্পৃক্ত কর্মসূচির কথা ভাবছেন নীতিনির্ধারকরা। আর একদফা আন্দোলনের মূল ফোকাস হবে ঢাকা। এক্ষেত্রে আন্দোলনের প্রথম ধাপে মানববন্ধন, পদযাত্রা, সমাবেশ, বিক্ষোভ সমাবেশ, বিক্ষোভ মিছিল, অবস্থান ধর্মঘটের মতো কর্মসূচির কথা ভাবা হচ্ছে। এসব কর্মসূচিতে জনগণকে ব্যাপক হারে সম্পৃক্ত করাই হবে বিএনপির লক্ষ্য। তারপর চূড়ান্ত পর্যায়ে ঢাকামুখী লংমার্চ, রোডমার্চ, চলো চলো ঢাকা চলো, সচিবালয় ঘেরাও, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ঘেরাও, গণভবন ঘেরাও, নির্বাচন কমিশন ঘেরাও, ঢাকা ঘেরাওয়ের সঙ্গে ঢাকায় লাগাতার অবস্থানের কর্মসূচি আসতে পারে।
জানা গেছে, আগামী ১৭ জুলাই খুলনায় এবং ২২ জুলাই ঢাকায় তারুণ্যের সমাবেশের শেষ দুই কর্মসূচি পালন করবে যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল ও ছাত্রদল। তারুণ্যের সমাবেশের মধ্যে আগামী ১৪ জুলাই নোয়াখালীতে পদযাত্রার মাধ্যমে সাত জেলায় কৃষক-শ্রমিক-তাঁতি-মৎস্যজীবী ও জাসাসের যৌথ কর্মসূচি শুরু হচ্ছে। নোয়াখালীর পর ১৬ জুলাই চট্টগ্রাম, ১৯ জুলাই দিনাজপুর, ২৮ জুলাই রাজশাহী, ৫ আগস্ট যশোর, ১২ আগস্ট হবিগঞ্জ ও ১৯ আগস্ট বরিশালে পদযাত্রা। এসব মাথায় রেখেই কর্মসূচি চূড়ান্ত করা হবে।
এদিকে বাংলাদেশের নির্বাচনী পরিবেশ ও নির্বাচন-পূর্ব রাজনৈতিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) অনুসন্ধানী অগ্রগামী দল ঢাকায় এসেছে গত শনিবার। প্রতিনিধিদলটির আগামী ২৩ জুলাই পর্যন্ত ঢাকা সফরের কথা রয়েছে। ইইউ প্রতিনিধিদলের এই সফরকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিচ্ছে বিএনপি। দলটির উচ্চ পর্যায়ের নেতারা জানিয়েছেন, সরকার পতনের একদফার আন্দোলনের কর্মসূচি মাঠে রেখে তারা ইইউ প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বৈঠকে যাবেন। আগামী ১৫ জুলাই বিকেলে ঢাকার ইউরোপীয় ইউনিয়ন দূতাবাস কার্যালয়ে ইইউ প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বিএনপির বৈঠক হতে পারে বলে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছে। সেজন্য ওই বৈঠকের আগেই সমাবেশে বড় জমায়েত করে সরকার পতনের একদফার আন্দোলনের ঘোষণা দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। ইইউ প্রতিনিধিদলকে বিএনপি বার্তা দিতে চাইছে যে, তারা আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে এসেছে এবং তাদের অবস্থান ও দাবির প্রতি মানুষের সমর্থন রয়েছে। এ ছাড়া আগামী সপ্তাহে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের বেসামরিক নিরাপত্তা, গণতন্ত্র এবং মানবাধিকারবিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি উজরা জেয়ার নেতৃত্বে একটি শক্তিশালী প্রতিনিধিদলের ঢাকা সফরে আসার কথা রয়েছে। একদফা আন্দোলনের বার্তা দিতে তাদের সঙ্গেও বৈঠকে যেতে পারে বিএনপি।
সমাবেশ অনুষ্ঠানে পুলিশের সহযোগিতা চায় বিএনপি : আগামীকাল বুধবার ঢাকার নয়াপল্টনে সমাবেশ অনুষ্ঠানে পুলিশের সহযোগিতা চেয়েছে বিএনপি। গতকাল দুপুরে দলের চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্য আবুল খায়ের ভূঁইয়া ও প্রচার সম্পাদক শহিদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানী বেইলি রোডে ঢাকা মেট্রোপলিটন কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে এই সহযোগিতা চান। সাক্ষাতের পর আবুল খায়ের ভূঁইয়া সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা পুলিশ কমিশনারের কাছে দেখা করে আমাদের বুধবারের সমাবেশের বিষয়টি লিখিতভাবে অবহিত করেছি। আমরা সমাবেশ অনুষ্ঠানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহযোগিতা চেয়েছি।’ ডিএমপি কমিশনারের সঙ্গে সাক্ষাতের সময়ে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (অপরাধ) মহিদ উদ্দিন, অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) হারুনুর রশীদ, যুগ্ম কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার উপস্থিত ছিলেন। পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার (মিডিয়া) কে এন রায় নিয়তি জানান, বিএনপি প্রতিনিধিদলটি পুলিশ কমিশনারের সঙ্গে দেখা করে তাদের আবেদন দিয়ে গেছেন।
সর্ববৃহৎ সমাবেশ করতে চায় বিএনপি : ঢাকার সমাবেশ ঘিরে ব্যাপক শোডাউনের প্রস্তুতি নিচ্ছে বিএনপি। কারণ, দলীয় কার্যালয়ের সামনে এ যাবৎকালের সর্ববৃহৎ সমাবেশ থেকে একদফার ঘোষণা দিতে চায় দলটি। এ লক্ষ্যে এরই মধ্যে ঢাকা বিভাগের অন্তর্গত জেলাগুলোর সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক এবং বিগত জাতীয় নির্বাচনে ঢাকা বিভাগের অধীন প্রতিটি সংসদীয় আসনে ধানের শীষের প্রাথমিক মনোনয়ন পাওয়া প্রথম দুজন প্রার্থীকে নিয়ে বৈঠক করেছে বিএনপির হাইকমান্ড। সেখানে সংশ্লিষ্ট নেতাদের ঢাকার সমাবেশে সর্বোচ্চ লোকসমাগমের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া গত রোববার বিএনপির ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণের যৌথসভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। সেখানেও মহানগরের প্রতিটি থানাকে সমাবেশে সর্বোচ্চ উপস্থিতি ঘটানোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনকেও অনুরূপ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এদিকে গতকাল সোমবার নয়াপল্টনে প্রস্তুতি সভা করেছে ছাত্রদল, যবুদল, শ্রমিক দল, স্বেচ্ছাসেবেক দল, কৃষক দলসহ প্রায় সব অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা। সমাবেশ ঘিরে নয়াপল্টন বিএনপি কার্যালয় এখন জমজমাট ও সরগরম। এদিকে ঢাকায় বিএনপির একদফার সমাবেশে জনসম্পৃক্ততা বাড়াতে রাজধানীতে গত এক দশক পর মাইকিং করা হচ্ছে। মাইকিংয়ের মধ্য দিয়ে ঢাকাবাসীকে বুধবারের সমাবেশে অংশগ্রহণের আহ্বান জানানো হচ্ছে।
মন্তব্য করুন