ঢাকা সফরের চতুর্থ দিন গতকাল মঙ্গলবারও অত্যন্ত ব্যস্ত সময় পার করেছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) প্রাক-নির্বাচনী প্রতিনিধিদল। বৈঠক করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি), নির্বাচন পর্যবেক্ষক সংস্থা এবং অ্যাটর্নি জেনারেলের সঙ্গে। এসব বৈঠকে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সার্বিক প্রস্তুতি, নির্বাচনের পরিবেশ এবং নির্বাচনী নানা আইনকানুন সম্পর্কে জানতে চেয়েছেন প্রতিনিধিদলের সদস্যরা। তবে এসব বৈঠকে নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা সম্পর্কে কোনো ধরনের আলোচনা হয়নি বলে জানা গেছে। নির্বাচনে পর্যবেক্ষক পাঠানো হবে কি না সার্বিক পরিস্থিতি মূল্যায়নের পরই সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলে জানায় ইইউ প্রতিনিধিদল।
গতকাল সকালে আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনে ইসির সঙ্গে ঘণ্টাব্যাপী বৈঠক করে ইইউর প্রাক-নির্বাচনী প্রতিনিধিদল। বৈঠকে সিইসির নেতৃত্বে অন্য কমিশনাররাও অংশ নেন। বৈঠক শেষে সফররত প্রতিনিধিদলের প্রধান চেল্লেরি রিকার্ডো সাংবাদিকদের জানান, প্রাক-নির্বাচনী পরিস্থিতি মূল্যায়নের পর তারা সিদ্ধান্ত নেবেন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পর্যবেক্ষক পাঠাবেন কি না। তিনি বলেন, ‘আমরা বাংলাদেশ সরকারের আমন্ত্রণে দুই সপ্তাহের সফরে এসেছি। আমরা প্রাক-নির্বাচনী পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে আমাদের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে প্রতিবেদন পাঠাব। তার ভিত্তিতে আগামী নির্বাচনে ইউরোপীয় ইউনিয়ন পর্যবেক্ষক পাঠাবে কি না সিদ্ধান্ত হবে।’ তাদের এই সফর গণমাধ্যমে গুরুত্ব পাওয়ার মতো না হলেও গুরুত্ব দেওয়ায় ধন্যবাদ জানান তিনি। বাংলাদেশ সরকারকেও ধন্যবাদ জানান তিনি।
বৈঠকের বিষয়ে জানতে চাইলে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তিনি বলেন, ‘মিস্টার রিকার্ডো যেটা বলেছেন, ওটাই আমার বক্তব্য।’
বৈঠক সূত্র জানায়, বৈঠকের বেশিরভাগ সময় ধরে সিইসি নির্বাচনী আইন, বিধিবিধান সবকিছু তুলে ধরেন। এ সময় তিনি বলেন, ‘নির্বাচন যদি অংশগ্রহণমূলক হয় তবে সেটি খুব ভালো। তবে সেটি ইসির কোনো পার্ট নয়। এটি সম্পূর্ণভাবে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। আমরা নির্বাচনের স্বচ্ছতায় বিশ্বাস করি। এরই মধ্যে মিডিয়ার জন্য একটি গাইডলাইনও তৈরি করে দিয়েছি।’ এ সময় ইইউ প্রতিনিধিদল নির্বাচনী আইনি কাঠামো সম্পর্কে জানতে চায়। জবাবে সিইসি বলেন, ‘আমরা গতকাল (সোমবার) আরপিওর সংশোধনীর গেজেট হাতে পেয়েছি। সেখানে ইসির ক্ষমতা আরও বেড়েছে এবং সুদৃঢ় হয়েছে। নির্বাচনে প্রিসাইডিং অফিসারদের ক্ষমতা আরও বেড়েছে। এ ছাড়া সব ভোটারের ছবিসহ ডাটাবেজ রয়েছে এবং সেটি অত্যন্ত সুরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে।’
পরে অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ ইসির অবস্থান তুলে ধরে সাংবাদিকদের বলেন, ‘ইইউ যত খুশি নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষক পাঠাতে পারে, তাতে কোনো আপত্তি নেই কমিশনের। তবে বিদেশি পর্যবেক্ষকদের আবেদনগুলো সেপ্টেম্বরের মধ্যে এলে ভালো হয়। কারণ সেখানে স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ক্লিয়ারেন্সসহ আরও কিছু ফর্মালিটি দরকার হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘ইইউ প্রতিনিধিদল আগামী জাতীয় নির্বাচন নিয়ে বিভিন্ন বিষয়ে জানতে চেয়েছিল। আমাদের ভোটার, ভোটকেন্দ্র, পর্যবেক্ষক পাঠানোর বিষয় ও সিসি ক্যামেরা ইত্যাদি প্রসঙ্গে। তাদের যে জিজ্ঞাসা ছিল কমিশন তাদের সন্তুষ্ট করেছে।’
বৈঠকে নির্বাচন কমিশন বলেছে, ‘৯১১টি নির্বাচন হয়েছে, সেক্ষেত্রে তারা সন্তুষ্ট। পরিবেশ নিয়ে সন্তুষ্ট। তারা আরও বিস্তারিত আলোচনা করবে।’
বিএনপিসহ কয়েকটি দল নির্বাচনকালীন সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলনে রয়েছে। এ নিয়ে আলোচনা হয়েছে কি না জানতে চাইলে ইসির অতিরিক্ত সচিব বলেন, ‘নির্বাচনকালীন সরকার ইসির বিষয় নয়। এ নিয়ে (বৈঠকে) আলোচনা হয়নি। তারা রাজনৈতিক দলগুলোকে ভোটে আনার বিষয়েও আমাদের কাছে কিছু জানতে চায়নি।’ আরেক প্রশ্নে অশোক কুমার বলেন, ‘ইসির সক্ষমতা নিয়ে আমাদের কাছে সন্তুষ্ট বা অসন্তুষ্ট কিছুই প্রকাশ করেনি (ইউরোপীয় প্রতিনিধিরা)। নির্বাচনে সব দল অংশগ্রহণ করবে কি না তা নিয়েও জানতে চায়নি। তারা প্রধানত নির্বাচনী প্রস্তুতিটা কী তা জানতে চেয়েছে। কমিশন সুষ্ঠু নির্বাচন করতে সক্ষম কি না, সেসব বিষয়ে জানতে চেয়েছে।’
দুপুরে নির্বাচনী আইনসহ দেশের বিভিন্ন আইন নিয়ে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেলের সঙ্গে তার কার্যালয়ে বৈঠক করে ইইউর প্রতিনিধিদল। বৈঠকে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল এএম আমিন উদ্দিন, অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল এস এম মুনীর, শেখ মোহাম্মদ মোরশেদ ও মোহাম্মদ মেহেদী হাছান চৌধুরী। বৈঠকের সময় অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয়ের সামনে বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা গণতন্ত্র ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে ইংরেজি ভাষায় বিভিন্ন স্লোগান দেন। পরে অ্যাটর্নি জেনারেল সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘প্রতিনিধিরা নির্বাচনী আইন-সংক্রান্ত বিষয়ে কথা বলেছেন। নির্বাচনকালীন আরপিও, ফৌজদারি আইন ও দেওয়ানি আইন এবং নাগরিকদের অধিকারের যে আইনগুলো আছে তা সম্পর্কে জানতে চেয়েছেন। সাধারণভাবে বাংলাদেশের আইনগুলো সম্পর্কে জানতে চেয়েছেন তারা।’
এর আগে সকালে গুলশানে ইউরোপীয় ইউনিয়নের দূতাবাসে ঢাকায় সফররত প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বৈঠক করেন ইলেকশন মনিটরিং ফোরামের নেতারা। বৈঠকের পর ফোরামের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মোহাম্মদ আবেদ আলী সাংবাদিকদের বলেন, ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিষয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের কোনো আগ্রহ নেই। এ সম্পর্কে তারা একটি প্রশ্নও করেননি। সংবিধানে নেই এমন কোনো কথা বলেননি তারা। তত্ত্বাবধায়ক বিষয়ে কোনো কিছু তারা জানতে চাননি।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা তাদের সামনে সব নির্বাচনের বাস্তবিক চিত্র তুলে ধরেছি। তারা এ বিষয়ে আগে থেকেই অবগত আছেন। তাদের মধ্যে একজন প্রতিনিধিও আছেন, যিনি এর আগে নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করেছেন।’
এ সময় ফোরামের উপদেষ্টা ও সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) শাহাদাত হোসেন চৌধুরী, ডুয়েটের উপাচার্য অধ্যাপক ড. হাবিবুর রহমান ও বুয়েটের উপ-উপাচার্য ড. আব্দুল জব্বার খান উপস্থিত ছিলেন।
বাংলাদেশের আগামী জাতীয় নির্বাচন পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে ঢাকায় অবস্থান করছে ইইউ প্রাক-নির্বাচন পর্যবেক্ষক প্রতিনিধিদল। ইইউ প্রতিনিধিদলের নেতা চেল্লেরি রিকার্ডো এবং সদস্য মেরি-হেলেন অ্যান্ডারলিন রোববার ঢাকায় আসেন। ৮ থেকে ২৩ জুলাই এ সফরে মূলত নিবার্চন পর্যবেক্ষণ মিশনের কর্মপরিধি, পরিকল্পনা, বাজেট, লজিস্টিকস ও নিরাপত্তা ইত্যাদি বিষয় মূল্যায়ন করবে প্রতিনিধিদলটি। ইউরোপীয় জোটের পররাষ্ট্রবিষয়ক হাইরিপ্রেজেন্টেটিভ জোসেফ বোরেলের কাছে তারা তাদের প্রতিবেদন জমা দেবে। প্রতিবেদনের আলোকে বাংলাদেশের নির্বাচনে পর্যবেক্ষক পাঠানোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে ইইউ।
মন্তব্য করুন