জ্বর নিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে এসেছেন সাগর তালুকদার। গতকাল মঙ্গলবার সকালে লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে ডেঙ্গু পরীক্ষার অভিজ্ঞতা জানালেন লালবাগের এই ব্যক্তি। তিনি বলেন, তিন দিন ধরে প্রচণ্ড জ্বর, বমি আর সর্দিকাশি। বেসরকারি হাসপাতালে আস্থা নেই। তাই ভিড় জেনেও এখানে এসেছি। বহির্বিভাগে ডাক্তার দেখানোর পর তারা ডেঙ্গু টেস্ট করতে বলেছেন। পরীক্ষা করতে এসে মনে হয়েছে, রাজধানীজুড়েই যেন ডেঙ্গু রোগী। ডেঙ্গু শনাক্তকরণ পরীক্ষা (এনএস-১) করতে তার খরচ ১০০ টাকা। রোগীর চাপে দীর্ঘক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া আর কোনো অভিযোগ নেই তার।
ডেঙ্গু শনাক্তকরণ পরীক্ষার একই চিত্র মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ, মিটফোর্ড হাসপাতালসহ রাজধানীর সরকারি বিভিন্ন হাসপাতালে। মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ডেঙ্গু চিকিৎসায় পুরুষ, নারী ও শিশুদের জন্য তিনটি আলাদা ওয়ার্ডের ব্যবস্থা করেছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। হাসপাতালটির পরিচালক অধ্যাপক ডা. নিয়াতুজ্জামান বলেন, আমাদের হাসপাতালে ২৪ ঘণ্টাই ডেঙ্গু পরীক্ষা হয়। ১০০ টাকার বিনিময়ে যে কেউ পরীক্ষা করাতে পারেন। আমরা নির্দেশনা দিয়েছি যে, হাসপাতালে যে কোনো ভর্তির রোগী এলেই প্রথমে ডেঙ্গুর পরীক্ষা করানো, এরপর ইনডোরে প্রবেশের সুযোগ দেওয়া।
এদিকে দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত আরও সাতজনের মৃত্যু হয়েছে। ২৪ ঘণ্টার হিসাবে চলতি বছর এটিই সর্বোচ্চ মৃত্যুর রেকর্ড। শনাক্তের সংখ্যাও প্রথমবারের মতো হাজার ছাড়িয়েছে। এ সময়ে হাসপাতালেও ভর্তি হন সর্বোচ্চ ১ হাজার ৫৪ জন। এর মধ্যে ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি ৬২৮ জন, ঢাকার বাইরে ভর্তি ৪২৬ জন। গতকাল মঙ্গলবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম থেকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।
হাসপাতালগুলোয় সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, প্রচণ্ড জ্বর আর মাথাব্যথা নিয়ে ধানমন্ডি পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টারে এসেছেন হাজারীবাগের বাসিন্দা সিনথিয়া। এ সময় দেখা যায় আরও বেশ কয়েকজন এসব উপসর্গ নিয়ে হাসপাতালটিতে ভিড় করছেন। একই চিত্র ধানমন্ডি ইবনে সিনা হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার, ল্যাবএইড, স্কয়ার হাসপাতাল, ডা. আনোয়ার খান মডার্ন, গ্রিন লাইফসহ অন্যান্য বেসরকারি হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে। তবে এসব হাসপাতালে রোগী বাড়লেও সরকার নির্ধারিত ফির বেশি টাকা নেওয়ার তথ্য পাওয়া যায়নি।
ল্যাবএইড হাসপাতালের জনসংযোগ কর্মকর্তা চৌধুরী মেহের-ই-খোদা দীপ কালবেলাকে বলেন, ডেঙ্গু সন্দেহে নমুনা পরীক্ষার হারও বাড়ছে। হাসপাতালেও ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। আমাদের অবস্থান থেকে সর্বোচ্চ সেবা দেওয়ার চেষ্টা করছি। পাশাপাশি পরীক্ষা-নিরীক্ষার ক্ষেত্রে যে ফি নির্ধারণ করে দেওয়া আছে, সেটিই নিচ্ছি। সরকার নির্ধারিত ৩০০ টাকার মধ্যে এনএস-১ পরীক্ষা করছি। কেউ যদি সিবিসি পরীক্ষা করাতে চান, সেটির মূল্য আলাদা ৪০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।
কোন কোন উপসর্গ থাকলে বিলম্ব না করে অবশ্যই ডেঙ্গু টেস্ট করতে হবে—এমন প্রশ্নের জবাবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক ডা. বে-নজির আহমেদ কালবেলাকে বলেন, ডেঙ্গুর অন্যতম লক্ষণ হলো বমি। কারও দীর্ঘস্থায়ী বমি হলে, এমনকি সেটি ওষুধ খেয়েও না কমলে দ্রুত হাসপাতালে এসে ডেঙ্গু পরীক্ষা করতে হবে। এ ছাড়া উল্লেখযোগ্য কিছু উপসর্গ হলো ডায়রিয়া, পেটব্যথা, শরীরে পানি জমে যাওয়া, বুকে-পেটে পানি জমা, মস্তিষ্কের প্রদাহজনিত সমস্যা, খিঁচুনি ও অজ্ঞান হয়ে যাওয়া।
জানা গেছে, এনএস-১ অ্যান্টিজেন পরীক্ষার খরচ সরকারি হাসপাতালের জন্য ১০০ ও বেসরকারি হাসপাতালের জন্য ৩০০ টাকা নির্ধারণ করে দিয়েছে সরকার। যদিও ২০১৯ সালের ৩০ জুলাই বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোতে ডেঙ্গু পরীক্ষার ফি সর্বোচ্চ ৫০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছিল। তবে গত বছর ৭ নভেম্বর বিশেষ বিজ্ঞপ্তিতে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের মৌখিক নির্দেশনায় বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে ডেঙ্গু পরীক্ষার মূল্য ৩০০ টাকা পুনর্নির্ধারণ করা হয়।
এদিকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ডেঙ্গু আক্রান্ত ব্যক্তির রক্তে প্লাটিলেট কেন্দ্রীভূত (কনসেনট্রেশন) করার জন্য রাজধানীসহ সারা দেশের ১৯টি সরকারি হাসপাতালে যন্ত্রপাতি দেওয়া হয়েছে। হাসপাতালগুলো হলো ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব কার্ডিওভাস্কুলার ডিজিজ বাংলাদেশ (এনআইসিভিডি), ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব কিডনি ডিজিজ অ্যান্ড ইউরোলজি (নিকডো), ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্স অ্যান্ড হাসপাতাল (নিনস), বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ), চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ক্যান্সার রিসার্চ অ্যান্ড হাসপাতাল (এনআইসিআরএইচ), রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, দিনাজপুর এম আব্দুর রহিম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ, মিটফোর্ড হাসপাতাল, ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ফরিদপুর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও সিরাজগঞ্জ শহীদ এম মনসুর আলী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল।
স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল কাজী মো. রশীদ-উন-নবী বলেন, অনাকাঙ্ক্ষিত শারীরিক লক্ষণ দেখা দিলে এনএস-১ পরীক্ষাটি করে নিশ্চিত হওয়া উচিত যে এটি ডেঙ্গু নয়। আমাদের হাসপাতালে রোগী ভর্তি কিংবা শনাক্তকরণ পরীক্ষার সব ব্যবস্থা রয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বর্তমানে দেশের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে মোট ৩ হাজার ৩০৩ ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসাধীন। ঢাকার ৫৩ সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে বর্তমানে ২ হাজার ৩০৬ জন এবং অন্যান্য বিভাগের বিভিন্ন হাসপাতালে ৯৯৭ ডেঙ্গু রোগী ভর্তি রয়েছেন।
চলতি বছর এখন পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত ১৪ হাজার ৮৯৭ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন। আক্রান্তদের মধ্যে হাসপাতাল থেকে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন ১১ হাজার ৫১১ জন। এ বছর প্রাণঘাতী এই রোগে এ পর্যন্ত ৮৩ জনের মৃত্যু হয়েছে।
বগুড়ায় বৃদ্ধের মৃত্যু: বগুড়া ব্যুরো জানায়, ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাফিজার রহমান (৭৫) নামে এক বৃদ্ধ মারা গেছেন। তিনি নন্দীগ্রাম উপজেলার কুমিড়া গ্রামের বাসিন্দা। গতকাল সকালে বগুড়ার সরকারি মোহাম্মদ আলী হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়।
গত বুধবার হাফিজার রহমান জ্বরে আক্রান্ত হন। তিনি শনিবার বগুড়া শহরের একটি বেসরকারি ক্লিনিকে ভর্তি হন। এরপর কিছুটা সুস্থবোধ করায় রোববার বাড়ি ফিরে গেলেও সোমবার ফের জ্বর আক্রান্ত হন।
বগুড়ায় বর্তমানে চারজন ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসাধীন। এর মধ্যে মোহাম্মদ আলী হাসপাতালে তিনজন এবং শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ (শজিমেক) হাসপাতালে একজন রয়েছেন।
ভর্তির এক ঘণ্টা পরই রোগীর মৃত্যু: ময়মনসিংহ ব্যুরো জানায়, ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ (মমেক) হাসপাতালে ভর্তির এক ঘণ্টা পরই আসমা বেগম (৫০) নামে এক ডেঙ্গু রোগীর মৃত্যু হয়েছে। গতকাল দুপুরে ওই নারীর মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করে হাসপাতালের ডেঙ্গু ওয়ার্ডের ফোকাল পারসন ডা. ফরহাদ হোসেন হিরা।
ডা. হিরা আরও জানান, পুরান ঢাকা থেকে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে আসমা বেগম সোমবার বিকেল ৪টা ৪০ মিনিটে মমেক হাসপাতালে ভর্তি হন। এক ঘণ্টা পর বিকেল ৫টা ৪০ মিনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ওই নারীর মৃত্যু হয়।
মন্তব্য করুন