কয়েকদিন আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিয়েছেন আনাম হোসেন। ৬ মার্চ তার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা দেওয়ার কথা। লিপ ইয়ারে ২৯ ফেব্রুয়ারির স্মৃতি ধরে রাখতে বন্ধুদের সঙ্গে খেতে গিয়েছিলেন বেইলি রোডের ওই ভবনের এক রেস্টুরেন্টে। গতকাল শুক্রবার শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের বহির্বিভাগে চিকিৎসা শেষে বাসায় চলে যান। কথা হয় এই প্রতিবেদকের সঙ্গে।
আনাম হোসেন বলেন, তিন তলায় ছিলাম, হঠাৎ দেখি আগুন। বাঁচার জন্য ছাদে গেলাম। ছাদে অনেক মানুষের ভিড় দেখে ছয় তলায় চলে আসি। ওখানে একটি রেস্টুরেন্ট ছিল, সেখানে কিছু সময় অবস্থান করি। গোটা ভবন ধোঁয়ায় অন্ধকার ছিল। বিদ্যুৎও চলে গেছে। মোবাইলের আলো জ্বালিয়েও কিছু দেখা যায় না। ওই রেস্টুরেন্টের কিচেন-বারান্দার রেলিংয়ের মাঝে কিছুটা ফাঁকা জায়গা ছিল। সেখান থেকে বের হয়ে আমি ডিশের তার দিয়ে ঝুলে দুই তলা পর্যন্ত এসেছি। তখন দেখি তার শেষ। এদিকে আমার দুই হাত থেকে রক্ত পড়ছে। কোনো উপায় না দেখে পরে দুই
তলা থেকে লাফ দিই। ছয় তলায় রেস্টুরেন্টে ছোট ছোট বাচ্চা ছিল। আমার সামনে কয়েকটি বাচ্চাকে অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকতে দেখেছি। মানুষের ভিড়ের মধ্যে একজনকে এক বাচ্চার গলার ওপরে পাড়া দিতে দেখেছি। আমার কপাল ভালো আমি বেঁচে ফিরেছি। যারা মারা গেছেন, তাদের পরিবারের কী হবে।
মৃত্যুর মুখ থেকে সপরিবারে বেঁচে ফেরেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অধ্যাপক আহমেদ কামরুজ্জামান মজুমদারের বড় মেয়ের জন্মদিন ছিল ১ মার্চ। মেয়ের বায়না জন্মদিন একটি রেস্তোরাঁয় উদযাপন করবে। খাবার শেষে রাত ১২টা ১ মিনিটে সেখানেই কেক কেটে উদযাপন করার কথা। রাত সাড়ে ৯টায় দুই মেয়ে ও স্ত্রীকে নিয়ে তিনি গিয়েছিলেন ওই ভবনের পাঁচ তলার জেষ্টি রেস্টুরেন্টে। সবে খাবার অর্ডার দিয়েছেন। এর মধ্যেই পোড়া গন্ধ! এরপর সবকিছু ওলট-পালট হয়ে গেছে।
স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক এবং প্রতিষ্ঠানটির বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) চেয়ারম্যান অধ্যাপক আহমেদ কামরুজ্জামান মজুমদার গত রাতের ভয়াল বর্ণনা দিয়ে বলেন, খাবার অর্ডার করার পর কিছু একটা পোড়ার গন্ধ পাচ্ছিলাম। জানালার পাশে গিয়ে দেখি লোকজন জড়ো হয়ে রাস্তার উল্টা দিকের একটি ভবন দেখাচ্ছে। অনেকে সেদিক যাচ্ছে। একপর্যায়ে চিৎকার বেড়ে গেল। হঠাৎ জানালার পাশ থেকে ধোঁয়া উঠে আসছে। আগুন লেগেছে জানার পর সবাই মিলে নিচে নামার চেষ্টা করি। একতলা নিচে নামার পর আর নামতে পারিনি। ধোঁয়া আসছিল নিচ থেকে। দলবেঁধে লোকজন আসছিল ওপরের দিকে। তখন আমরা সবাই মিলে ছাদে যাই। সেখানে গিয়ে দেখি ছাদে আরও দুটি রেস্টুরেন্ট আর নামাজের স্থান। চারভাগের একভাগও খালি নেই। যত সময় যাচ্ছিল আগুনের ধোঁয়া তত ওপরের দিকে উঠছিল। একপর্যায়ে শুধু ধোঁয়া নয়, আগুনের লেলিহান শিখা তখন ছাদের দিকে আসছে। শুরু হয়েছে চিৎকার। চিৎকারে, আহাজারিতে তখন চারদিকে ভয়ানক পরিস্থিতি। অনেকেই তখন ছাদে নামাজে বসে যান, প্রার্থনা শুরু করেন বাঁচার আকুতিতে। একপর্যায়ে ছাদের রেস্টুরেন্টে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। তখন চিৎকার আরও বাড়ে।
আহমেদ কামরুজ্জামান বলেন, তখন আমার বড় মেয়েটি কাঁদতে কাঁদতে বলছিল, বাবা, আমার জন্মদিন কি মৃত্যুদিন হয়ে যাচ্ছে? আমরা সন্তানসহ সবাইকে প্যানিকড না হওয়ার জন্য বারবার বলতে থাকি। আগুনে যখন পুড়ে যাওয়ার মতো অবস্থা, তখন নিচ থেকে ফায়ার সার্ভিসের কথা শুনতে পান ছাদের লোকজন। তারা ক্রেনের দিকে চলে আসতে বলে। কিন্তু ফায়ার সার্ভিসের ক্রেন কোন দিকে, তা কেউ দেখতে পাচ্ছিলেন না। এমন সময় ফায়ার সার্ভিসের এক কর্মী ছাদে উঠে আসেন। তিনি সবাইকে আশ্বস্ত করতে থাকেন। ওই কর্মী একপর্যায়ে একটি হাতুড়ির মতো বস্তু নিয়ে ছাদের একটি রেস্টুরেন্টের দরজা ভেঙে ফেলেন। যাতে আগুন না আসে।
চারদিকের আগুনে এরই মধ্যে কয়েকজন অসুস্থ হয়ে সেখানে পড়ে যান। একপর্যায়ে ক্রেনের দেখা পান তারা। তখন রাত প্রায় ১২টা বেজে গেছে। প্রথম ক্রেনে চারটি শিশু ও নারী এবং অসুস্থ কয়েকজনকে তুলে দেওয়া হয়। প্রথমে ক্রেনে বেশি লোক নিলেও পরে চার-পাঁচজন করে নেওয়া হয়। ১০ থেকে ১২ দফায় সবাইকে নামানো হয়। ফায়ার সার্ভিস অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে আমাদের উদ্ধার করেছে।