দেশে প্রথমবারের মতো ইসলামী শরিয়াহভিত্তিক পরিচালিত এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হচ্ছে প্রচলিত নিয়মে পরিচালিত দুর্দশাগ্রস্ত পদ্মা ব্যাংক। গত সোমবার বেসরকারি খাতের এ দুই ব্যাংকের মধ্যে সমঝোতা চুক্তি (এমওইউ) সইয়ের মধ্য দিয়ে মার্জারের আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হয়েছে। একীভূত কার্যক্রম শুরু হওয়ার পর আতঙ্ক বেড়েছে আমানতকারীদের। যার প্রভাবে পদ্মা ব্যাংকে টাকা তোলার হিড়িক শুরু হয়েছে। চুক্তি সই হওয়ার দিন ও পরদিন ব্যাংকটির বিভিন্ন শাখায় ভিড় করছেন আমানতকারীরা। তবে স্বল্প আমানতকারীদের টাকা দিয়ে দিলেও বড় গ্রাহকদের অর্থ দিতে এক থেকে দুই সপ্তাহ সময় নিচ্ছে পদ্মা ব্যাংক।
একীভূত কার্যক্রম শুরুর পর গতকাল মঙ্গলবার ছিল প্রথম কার্যদিবস। রাজধানীর মতিঝিল শাখায় সরেজমিন দেখা গেছে, সকাল থেকেই গ্রাহকদের আনাগোনা ছিল বেশ। স্বাভাবিক দিনের থেকে আমানতকারীদের ভিড় কিছুটা বেশি ছিল। স্বল্প অঙ্কের টাকা তাৎক্ষণিক দেওয়া হলেও বড় অঙ্কের জন্য সময় নিচ্ছে ব্যাংক কর্মকর্তারা।
টাকা তুলতে আসা শিমুল দম্পতি কালবেলাকে বলেন, আমাদের অল্প টাকা ছিল। সেগুলো তুলতে এসেছি। চেক দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের টাকা দিয়ে দিয়েছে। একই সময়ে আরেক গ্রাহক বলেন, পাঁচ লাখ টাকা তোলার জন্য এসেছিলাম। কিন্তু আমাকে দুদিন পরে আসতে বলেছে।
শুধু টাকা তুলতেই নয়, অনেকেই আসছেন খোঁজখবর নিতে। কাঞ্চন নামের এক গ্রাহক কালবেলাকে বলেন, দীর্ঘদিন ধরে পদ্মা ব্যাংকের সঙ্গে লেনদেন করছি। মার্জারের খবর শোনার পরে খোঁজ নিতে এসেছি। তারা আমাকে আশ্বস্ত করেছেন কোনো সমস্যা হবে না।
আরেক আমানতকারী বলেন, আমার আমানত ম্যাচিউর হয়েছে। কিন্তু আজকে টাকা দেয়নি। সপ্তাহখানেক পরে আসতে বলেছে। আরেক গ্রাহক বলেন, ব্যাংকে টাকা রাখলে আতঙ্ক তো কিছুটা থাকবেই। তবে যেহেতু এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে এক হয়ে যাচ্ছে—তাই সমস্যা নাও হতে পারে। এখন দেখা যাক কী হয়।
এদিকে হঠাৎ করেই টাকা তুলতে আসা আমানতকারীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় চাপ বেড়েছে কর্মকর্তাদের ওপর। তারা বিভিন্নভাবে বুঝিয়ে গ্রাহকদের আশ্বস্ত করার চেষ্টা করছেন। এ বিষয়ে মতিঝিল শাখাপ্রধান মনির হোসাইন কালবেলাকে বলেন, স্বাভাবিকের তুলনায় আমাদের টাকা তোলার চাপ অনেক বেড়েছে। অনেকে ডিপোজিট ম্যাচুরিটি আসার আগেই টাকা তুলতে চাচ্ছেন। মানুষের মাঝে একটা আতঙ্ক কাজ করছে—টাকা দেবে কি না বা পাবে কি না। এটা স্বাভাবিক। আমরা গ্রাহকদের বোঝাচ্ছি। অনেকে বুঝছে। অনেকে বুঝতে চাইছে না। তাদের টাকা দিয়ে দিচ্ছি। শুধু মতিঝিলই নয়। রাজধানীর আরও বেশ কয়েকটি শাখায় খোঁজ নিয়ে একই অবস্থার কথা জানা গেছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পদ্মা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা তারেক রিয়াজ খান কালবেলাকে বলেন, এ ধরনের মার্জার প্রক্রিয়া দেশে আগে হয়নি। তাই অনেকেই টাকা তুলে নিচ্ছে। তবে আতঙ্কিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। কারণ এক্সিম ব্যাংক অনেক শক্তিশালী। সুতরাং আমানতকারীদের ঝুঁকিতে পড়ার কোনো সম্ভবনা নেই।
তিনি আরও বলেন, পদ্মা ব্যাংকে তারল্য সংকট থাকার কারণে অনেক বেশি সুদে আমানত সংগ্রহ করা হয়েছে। কিন্তু এক্সিম ব্যাংকে আমানতে মুনাফা কিছুটা কম। এজন্য অনেকেই টাকা তুলে নিতে পারেন। তবে যাদের মেয়াদি আমানত রয়েছে, তাদের সুদের হার পরিবর্তনের কোনো সম্ভবনা নেই। তাই এখনই আমানত তুলে নেওয়ার কোনো কারণ দেখি না।
উল্লেখ্য, দেশে ২০১৩ সালে নতুন যে ৯টি ব্যাংক অনুমোদন পায়, তার একটি হলো পদ্মা ব্যাংক (সাবেক ফারমার্স)। শুরু থেকেই এটির কার্যক্রম প্রশ্নবিদ্ধ। যেমন, অনুমোদন পাওয়ার আগেই ব্যাংকটি অফিস খুলে লোকবল নিয়োগ দিতে শুরু করে। আবার সম্পর্কের ভিত্তিতে সরকারি প্রতিষ্ঠানের আমানত জমা নিয়ে অনিয়ম-দুর্নীতি শুরু করেন এর উদ্যোক্তারা। ফলে চার বছর না পেরোতেই সংকটে পড়ে ব্যাংকটি। পরিস্থিতির চরম অবনতি হওয়ায় ২০১৭ সালে পদ ছাড়তে বাধ্য হন এই ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর। ব্যাংকটির এমডি একেএম শামীমকেও অপসারণ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। তখন এই ব্যাংককে বাঁচাতে মূলধন সহায়তা দেয় সরকারি চার ব্যাংক ও ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি)। সেই সুবাদে ব্যাংকটির পরিচালনায় যুক্ত হন ওই চার ব্যাংক ও আইসিবির প্রতিনিধিরা। পদ্মা ব্যাংকের নতুন চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব নেন চৌধুরী নাফিজ সরাফাত।
২০১৯ সালের ২৯ জানুয়ারি দ্য ফারমার্স ব্যাংকের নাম বদলে রাখা হয় পদ্মা ব্যাংক। এখন এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হচ্ছে ব্যাংকটি। ফলে ব্যাংকের তালিকা থেকে বাদ পড়তে যাচ্ছে পদ্মা ব্যাংকের নাম। সাবেক ফারমার্স ব্যাংকে অনিয়মের পর জেলে আছেন নির্বাহী কমিটির তৎকালীন চেয়ারম্যান মাহবুবুল হক চিশতী ওরফে বাবুল চিশতী এবং তার ছেলে রাশেদুল হক চিশতী। গত বছরের অক্টোবরে ১৬০ কোটি টাকা আত্মসাতের মামলায় তাদের ১২ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড হয়।
অন্যদিকে এক্সিম ব্যাংকের কার্যক্রম শুরু হয় ১৯৯৯ সালে। এটি ইসলামী ধারার একটি ব্যাংক। ২০০৪ সালে এটি শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হয়। এরই মধ্যে দুর্দশাগ্রস্ত পদ্মা ব্যাংক একীভূত করতে পরিচালক পর্ষদের নেওয়া সিদ্ধান্তের বিষয়ে মূল্য সংবেদনশীল তথ্য (পিএসআই) প্রকাশ করেছে ব্যাংকটি।