আঙুল উঁচিয়ে কথা বলছেন একজন। পেছনে কর্মীরা। তারা সবাই মিলে আয়েশি ভঙ্গিতে বোঝাচ্ছেন ‘ছাত্রলীগের বাইরে সব নিয়োগ ক্যানসেল’। এ সময় কেউ কেউ চাপছিলেন মোবাইল। কিছু সময় পরপর কথা বলতে বলতে উত্তেজিত হয়ে পড়ছেন তাদেরই দু-একজন। এ দৃশ্য কোনো অ্যাকশন মুভির নয়। দেশের স্বনামধন্য বিদ্যাপীঠ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে (চবি)। এভাবেই রেজিস্ট্রার (ভারপ্রাপ্ত) এম নূর আহমদকে শাসাতে দেখা গেছে। এ-সংক্রান্ত একটি ভিডিও কালবেলার হাতে এসেছে।
ছাত্রী হেনস্তা থেকে শুরু করে শাটল চালককে অপহরণ কিংবা ক্যাম্পাসে মারামারি, ভাঙচুর—চবিতে যেখানেই নানা অপকর্মের ঘটনা ঘটে, সেখানেই উঠে আসে ছাত্রলীগের নাম। এবার সংগঠনটির নেতাকর্মীরা একেবারে ফিল্মি স্টাইলে শাসিয়েছেন চবি রেজিস্ট্রার (ভারপ্রাপ্ত) কে এম নূর আহমদকে। এ সময় ইয়াহিয়া টিপু নামের এক চবি কর্মচারীকে মারধরের অভিযোগ ওঠে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে।
গতকাল বুধবার নতুন উপাচার্য অধ্যাপক মো. আবু তাহের দায়িত্ব গ্রহণ করার পরপর দুপুর দেড়টার দিকে চবি ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা ইয়াহিয়া টিপুকে মারধর করে রেজিস্ট্রার অফিসে আটকে রাখেন। ইয়াহিয়া টিপু ৫৫০ টাকা দৈনিক মজুরিতে চবির মনোবিজ্ঞান বিভাগে কম্পিউটার ল্যাব সহকারী হিসেবে কর্মরত আছেন। তাকে নিয়োগ দিয়েছিলেন সদ্য বিদায়ী উপাচার্য অধ্যাপক শিরীণ আখতার। গতকাল ইয়াহিয়া টিপু রেজিস্ট্রার কার্যালয়ে যোগ দিতে এসেছিলেন। রেজিস্ট্রার কার্যালয়ে টিপুকে মারধরের পাশাপাশি রেজিস্ট্রার এম নূর আহমদকে ছাত্রলীগের বাইরে সব নিয়োগ ক্যানসেল করতে চাপ সৃষ্টি করেন নেতাকর্মীরা।
ইয়াহিয়া টিপু অভিযোগ করে বলেন, ‘আমার চাকরি এপ্রুভ হইছে। তাই তারা আমাকে মারছে। আমার গালে মারছে। আমি এমনিতেই বসা ছিলাম। আমি জয়েন করতে আসছিলাম রেজিস্ট্রার অফিসে। আমাকে জিজ্ঞেস করছে আমি ছাত্রলীগ করি কি না। বললাম, না। তখন তারা আমাকে মারধর করে।’
চবিতে কর্মচারীকে মারধর করেই ক্ষান্ত হননি চবি ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। এ সময় ছাত্রলীগ কর্মীদের বাইরে সব নিয়োগ বাতিল করতে রেজিস্ট্রারকে প্রথমে শাসাতে থাকেন শাখা ছাত্রলীগের উপগ্রুপ বিজয়ের একাংশের নেতা ওয়াহিদুল ইসলাম। তিনি রেজিস্ট্রারের দিকে আঙুল উঁচিয়ে বলতে থাকেন, ‘ও (টিপু) এখনো পেছনে বসে আছে। ও ছাত্রলীগ করে না। তবুও ওরে চাকরি দিয়েছেন। ওর কাছ থেকে ৫ লাখ টাকা ঘুষ খাইছে ভিসি ম্যাম।’
এরপর ওই নিয়োগ নিয়ে রেজিস্ট্রারকে শাসাতে থাকেন একই গ্রুপের আরেক নেতা শাখা ছাত্রলীগের সাবেক আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক মোরশেদুল আলম রিফাত। এ সময় তিনি বলতে থাকেন, ‘ছাত্রলীগের বাইরের এগুলা ক্যানসেল। ও (টিপু) ছাত্রলীগ কর্মী না। ছাত্রলীগের বাইরে নিয়োগের কোনো অধিকার নেই। ছাত্রলীগের বাইরে যেগুলা, ওইগুলা ক্যানসেল। ছাত্রলীগের পোলাপাইনের চাকরি লওয়ার অধিকার আছে। বাইরের পোলাপাইনের কী অধিকার? ছাত্রলীগের বাইরে সব ক্যানসেল।’
এ সময় উপস্থিত বাকি ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরাও রেজিস্ট্রারকে শাসাতে থাকেন। আর উপাচার্যকে এসব নিয়োগের ব্যাপারে বলার জন্য তাদের পক্ষে রেজিস্ট্রারকে বোঝাতে থাকেন বিশ্ববিদ্যালয় কর্মচারী ইউনিয়নের সভাপতি মো. সুমন মামুন ও সাধারণ সম্পাদক মো. মনসুর আলী। এ সময় শাখা ছাত্রলীগের মধ্যে আরও উপস্থিত ছিলেন শাখা ছাত্রলীগের উপগ্রুপ একাকারের নেতা মইনুল ইসলাম রাসেল, ভার্সিটি এক্সপ্রেসের (ভিএক্স) আল আমিন শান্ত, রায়হান ও আশিব তানিম। এ ছাড়া রেজিস্ট্রার অফিসে উপস্থিত ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রক্টর নাজেমুল আলম মুরাদ, মোহাম্মদ রোকন উদ্দিন, আব্দুল মান্নান ও শঙ্কর বড়ুয়া।
বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার (ভারপ্রাপ্ত) কে এক নূর আহমদ বলেন, ‘আমার অফিসে এসে তারা এরকম আচরণ করেছে। এটা আমার জন্য অপমানজনক। আমি তো তাদের নিয়োগ দিতে পারব না। নিয়োগ দেবেন ভিসি। তবুও তারা আমার এখানে এসে অসৌজন্যমূলক আচরণ করেছে।’
ঘটনার সময় উপস্থিত চবি শাখা ছাত্রলীগের (একাংশ) একাকার গ্রুপের নেতা মইনুল ইসলাম রাসেল কালবেলাকে বলেন, ‘টাকা নিয়ে যদি অবৈধ নিয়োগ দেওয়া হয়, তাহলে এগুলো অবশ্যই বাতিল করা দরকার। তাদের সুপারিশ যারা করেছে, এগুলোও দেখতে হবে। আমাদের কাছে প্রমাণ আছে যে সে (ইয়াহিয়া টিপু) ঘুষ দিয়েছে। কে বা কারা তাকে নিয়োগে সাহায্য করেছে, তার প্রমাণও আছে। এই কয়দিনে যতগুলো নিয়োগ হয়েছে, এর মধ্যেও এরকম টাকার ব্যাপার রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারী যারা জড়িত, তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।’ তবে রেজিস্ট্রারের রুমে ডুকে হুমকি দেওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এসব ছোটখাটো ঘটনা তো ঘটেই। এমন ঘটনা নিয়মিতই হচ্ছে।’
সদ্য নিয়োগ পাওয়া ইয়াহিয়া টিপুকে মারধরের বিষয়ে চবি শাখা ছাত্রলীগের সাবেক আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক মোরশেদুল আলম রিফাত বলেন, ‘আমরা কেউ তার ওপর হাত তুলিনি। তার বিরুদ্ধে নিয়োগ বাণিজ্যের অভিযোগ পেয়ে তাকে আটক করি। পরে সে পালিয়ে যায়। যেহেতু এখানে নিয়োগ বাণিজ্য হচ্ছে, আমরা সেখানে প্রতিবাদ করেছি।’