নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের অভিযোগের শেষ নেই। নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের অভাব ও কম বেতন-ভাতাকে দুষছেন শিক্ষকরা। শিক্ষার্থীরা বলছে, অ্যাসাইনমেন্ট, প্রজেক্টসহ বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষকদের সহযোগিতা না পাওয়ায় তারা চাপ অনুভব করছে। অনেকেই বাধ্য হয়ে গুগল, ফেসবুক ও ইউটিউবের ওপর নির্ভর করছে। অন্যদিকে শিক্ষাক্রম বিষয়ে পর্যাপ্ত ধারণা না থাকায় উদ্বেগ কাজ করছে অভিভাবকদের মধ্যে। যে কারণে তারা শিক্ষার্থীদের কোচিং ও প্রাইভেট ব্যাচে দিচ্ছেন। ক্ষেত্রবিশেষে স্কুল শিক্ষকরাও কোচিং বা ব্যাচে পড়তে বাধ্য করছেন। তবে শিক্ষাক্রম বিষয়ে এসব অভিযোগ মানতে নারাজ বাস্তবায়ন কর্তৃপক্ষ।
গত বছর প্রথম, ষষ্ঠ এবং সপ্তম শ্রেণিতে নতুন পাঠ্যক্রম বাস্তবায়ন করা হয়েছে। চলতি বছর বাস্তবায়ন করা হচ্ছে দ্বিতীয়, তৃতীয়, অষ্টম ও নবম শ্রেণিতে। এরপর ২০২৫ সালে চতুর্থ, পঞ্চম ও দশম শ্রেণিতে, ২০২৬ সালে একাদশ শ্রেণিতে এবং ২০২৭ সালে দ্বাদশ শ্রেণিতে ধাপে ধাপে নতুন শিক্ষাক্রম চালু হওয়ার কথা রয়েছে। পরীক্ষামূলক এ সংস্করণ চলতি বছরই ট্রাই আউটের মাধ্যমে চূড়ান্ত হবে।
শিক্ষার্থীদের চাপ বেড়েছে, ডিভাইস আসক্তিও:
নতুন শিক্ষাক্রম বিষয়ে রাজধানী ও এর বাইরে অন্তত তিনটি জেলার শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলেছে কালবেলা। শহরের শিক্ষার্থীরা বলছে, নতুন শিক্ষাক্রমের কারণে তাদের বইয়ের বোঝা বেড়েছে। একক অ্যাসাইনমেন্ট, দলগত কাজ, প্রজেক্ট করতে হচ্ছে তাদের। এর পাশাপাশি বইয়ের ছক পূরণ করতে হচ্ছে। এসব কাজে শিক্ষকদের পর্যাপ্ত সহযোগিতা তারা পায় না। যে কারণে তারা প্রচুর চাপ অনুভব করছে বলে জানিয়েছে। অন্যদিকে গ্রামের শিক্ষার্থীরা বলছে, তারা উপকরণের অভাবে সব প্রজেক্ট করতে পারছে না।
শহরের শিক্ষার্থীরা বলছে, শিক্ষকরা সব পড়া বুঝিয়ে দেন না। ফলে বাধ্য হয়ে তারা গুগল, ফেসবুক ও ইউটিউবে পাঠ্যবইয়ের বিভিন্ন কনটেন্ট দেখে কপি করে। আবার কখনো শিক্ষকই গুগল থেকে তথ্য লিখে নিয়ে যেতে বলেন। এর ফলে তাদের মধ্যে ডিভাইস আসক্তি বেড়েছে বলে জানিয়েছেন অভিভাবকরা। শিক্ষার্থীদের অনেকেই আবার সেটি স্বীকারও করেছে। তারা এ-ও বলছে, হোমওয়ার্কের কাজ শেষ হওয়ার পর তারা মোবাইলে গেমস খেলে। অনেকে ফেসবুক ও ইউটিউবে রিলস দেখে। আবার কেউ সময় ব্যয় করে টিকটকে। এর ফলে অনেক শিক্ষার্থীর টিকটক অ্যাকাউন্টও রয়েছে। অন্যদিকে গ্রামের শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের অনেকেরই স্মার্টফোন নেই। এর ফলে এসব ক্ষেত্রে তারা ব্যতিক্রম।
রাজধানীর দনিয়ার ব্রাইট স্কুল অ্যান্ড কলেজের সপ্তম শ্রেণির এক ছাত্রী কালবেলাকে বলে, প্রতিদিন ক্লাসে ছয়টি বিষয়ের বই, এসব বিষয়ের জন্য ছয়টি খাতা, টিফিন, পানি ও অন্যান্য সামগ্রী নিয়ে যেতে হয়। আবার যেদিন বিজ্ঞানের ক্লাস থাকে, সেদিন বিজ্ঞান অনুসন্ধানী ও বিজ্ঞান অনুশীলন বই নিয়ে যেতে হয়। এ ছাড়া গণিত ও ইংরেজির ক্লাস প্রায়
প্রতিদিনই হয়। এর ফলে ব্যাগ অনেক ভারী হয়ে যায়। বইয়ের ছক পূরণের বিষয়ে সে বলে, নিয়মিত অ্যাসাইনমেন্ট ও প্রজেক্টের বাইরেও একটি বড় কাজ বইয়ের ছক পূরণ। অ্যাসাইনমেন্টের পাশাপাশি প্রায় প্রতিদিনই ছক পূরণ করতে দেওয়া হয়। এর মধ্যে কিছু ছক কীভাবে পূরণ করতে হবে, তা শিক্ষক বুঝিয়ে দেন, বাকিগুলো নিজের মতো করে পূরণ করতে হয়। সেক্ষেত্রে গুগল, ফেসবুক বা ইউটিউবের সাহায্য নিতে হয়।
এই শিক্ষার্থীর বড় বোন তাসলিম জাহান বলেন, স্কুল থেকে ফিরেই সে মোবাইল নিয়ে বসে। জিজ্ঞেস করলেই বলে, স্কুল থেকে দেওয়া হোমওয়ার্কের কাজ করছে। এরপর তার কাছ থেকে একপ্রকার জোর করেই মোবাইল নিতে হয়। স্কুলের হোমওয়ার্ক সে ইউটিউব দেখে করে। জিজ্ঞেস করলে কখনো বলে, স্যার এভাবে করে নিয়ে যেতে বলেছেন। আবার কখনো বলে, স্যার কিছু বুঝিয়ে দেননি। অন্যরাও একইভাবে লিখে নিয়ে যায়। আমি লিখে নিয়ে না গেলে স্যার চতুর্ভুজ দিয়ে দেবে।
কোচিংয়ের শিক্ষার্থী কমেছে, বেড়েছে প্রাইভেট ব্যাচে
নতুন শিক্ষাক্রমে মূল্যায়ন স্কুল শিক্ষকের হাতে থাকায় অনেক শিক্ষার্থীই কোচিংয়ের পরিবর্তে শিক্ষকের প্রাইভেট ব্যাচে বেশি ভর্তি হচ্ছে। এই তালিকায় গ্রামের স্কুলগুলোর শিক্ষকরা যেমন আছেন, রাজধানীর স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরাও রয়েছেন। তবে নতুন শিক্ষাক্রমের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কোর্স সাজিয়ে টেন মিনিট স্কুলের মতো অনলাইন স্কুলগুলোও শিক্ষার্থী বাড়াচ্ছে।
অভিভাবকদের উদ্বেগ কমেনি:
ভিকারুননিসা স্কুলের নবম শ্রেণির একজন শিক্ষার্থীর মা তহুরা আক্তার বলেন, ক্লাসের অধিকসংখ্যক শিশুর মধ্যে আমার সন্তানকে আলাদা করে শিক্ষক বোঝাতে পারেন না। আবার আমাদেরও এ পড়াশোনা বিষয়ে ধারণা কম। যে কারণে তার ভবিষ্যৎ নিয়ে এক ধরনের উদ্বেগ কাজ করে। সে কারণেই বাচ্চাকে প্রাইভেট ব্যাচে দিয়েছি।
শরীয়তপুরের সরকারি জাজিরা মোহর আলী হাই স্কুলের নবম শ্রেণির ছাত্রী উম্মে হাবিবার বাবা স্থানীয় মেম্বার নুর মোহাম্মদ মোল্লা কালবেলাকে বলেন, শিক্ষকরা ক্লাসে ভালো মতো কিছু বোঝান না। সে কারণে আমার মেয়েকে তিনটি প্রাইভেট পড়াতে হয়। শিক্ষকরা ভালো করে বুঝিয়ে পড়ালে প্রাইভেটে দিতে হতো না। খরচও কমে যেত।
প্রশিক্ষণ ও মূল্যায়ন বিষয়ে অভিযোগ রয়ে গেছে:
রাজধানীর ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ইংরেজি বিষয়ের একজন শিক্ষক কালবেলাকে বলেন, শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ অপর্যাপ্ত। এর জন্য ধারাবাহিক প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। পড়ার ধরন নিয়ে তিনি বলেন, শিক্ষার্থীদের একটি বাক্য থেকে ‘পার্ট অব স্পিচ’ বের করতে বলা হচ্ছে। কিন্তু ‘পার্ট অব স্পিচ’ কী, সেটি তাদের জানানো হচ্ছে না। শিক্ষার্থীদের পূর্ব অভিজ্ঞতাও নেই এ বিষয়ে। শিক্ষার্থীদের আগ থেকে বিষয়টি সম্পর্কে ভালো ধারণা থাকবে—এটিও ঠিক নয়। মূল্যায়নের ত্রুটির বিষয় তুলে ধরে তিনি বলেন, শিক্ষার্থীদের কোনো দলবদ্ধ বা একক কাজ ক্লাসরুমে মূল্যায়ন করতে হচ্ছে। বেশি সংখ্যক শিক্ষার্থী যেসব স্কুলে আছে, সেখানে এটি কষ্টসাধ্য। এ কারণে মূল্যায়ন পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনা দরকার। নম্বর থাকলে ভালো হয়। পাশাপাশি বাংলা ও ইংরেজির জন্য আলাদা ব্যাকরণ বই নিশ্চিত করা দরকার।
ফেনীর বালিগাঁও উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সিরাজুল ইসলাম বলেন, শিক্ষকদের বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষণ দেওয়া ও প্রশিক্ষণের সময় বাড়ানো উচিত। এ ছাড়া গ্রামে হতদরিদ্রদের বাচ্চারা পড়ে। নতুন শিক্ষাক্রমের বিভিন্ন উপকরণ তারা কিনতে পারে না। সরকার চাইলে এসব উপকরণের ব্যবস্থা করতে পারে। সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন শিক্ষক সংকট নিরসন।
তবে শিক্ষকদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে দাবি করে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) ডিসেমিনেশন অব নিউ কারিকুলাম স্কিম সেকেন্ডারি এডুকেশন ডেভেলপমেন্ট স্কিমের পরিচালক অধ্যাপক সৈয়দ মাহফুজ আলী কালবেলাকে বলেন, গত বছরের চেয়ে এবার প্রশিক্ষণের সময়সীমা বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু শিক্ষকদের মধ্যে অনেকেই প্রশিক্ষণ গ্রহণে আগ্রহী নন। কেউ আগ্রহী না হলে তাকে জোর করে প্রশিক্ষণ দেওয়া যায় না। তিনি বলেন, প্রশিক্ষণের জন্য শিক্ষক ও প্রশিক্ষকদের ভালো সম্মানী দেওয়া হচ্ছে। আর এটা কারিকুলাম ডিসেমিনেশন প্রশিক্ষণ। বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষণের বিষয়টি মাউশি দেখতে পারে।
প্রাথমিকে শিক্ষক প্রশিক্ষণে ঘাটতির অভিযোগ বেশি:
প্রাথমিক স্তরের শিক্ষকরা বলছেন, অনলাইন মুক্তপাঠে শিক্ষাক্রম বিষয়ে শুধু ধারণা দেওয়া হয়েছে। সেখানে বিস্তারিত কোনো ধারণা দেওয়া নেই। এ ছাড়া তিন দিনের সরাসরি প্রশিক্ষণও যথেষ্ট নয়। সেজন্য তারা কার্যকর প্রশিক্ষণের সময় বাড়ানোর দাবি জানিয়েছেন।
পাবনার ভাঙ্গুরা একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হোসনে আরা (ছদ্মনাম) কালবেলাকে বলেন, আমরা ঠিক সময়ে শিক্ষক সহায়িকা পাচ্ছি না। এর ফলে ধারাবাহিক মূল্যায়নে সমস্যা হচ্ছে। শিক্ষকদের প্রশিক্ষণেও ঘাটতি রয়ে গেছে। নতুন শিক্ষাক্রম বিষয়ে এখানকার বেশিরভাগ শিক্ষকেরও আগ্রহ দেখছি না। অনেক শিক্ষক শিক্ষাক্রম বুঝতেই পারছেন না। এর ফলে বাচ্চাদেরও ঘাটতি থেকে যাচ্ছে।
প্রশিক্ষণের ঘাটতির বিষয়টি মানতে নারাজ প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের উপপরিচালক (প্রশিক্ষণ বিভাগ) মো. মাহবুবুর রহমান বিল্লাহ। তিনি কালবেলাকে বলেন, এনসিটিবির শিক্ষাক্রম অনুযায়ীই প্রশিক্ষণ মডিউল ডিজাইন করা হয়েছে। সরাসরি তিন দিনের প্রশিক্ষণ ছাড়াও অনলাইনে মুক্তপাঠে প্রশিক্ষণ নেওয়ার সুযোগ রয়েছে। কাজেই প্রশিক্ষণ আমাদের কাছে পর্যাপ্ত মনে হয়েছে। অনেক শিক্ষক না জেনেই হয়তো এটা বলছেন।
কোনো পাঠ গ্রামের জন্য, কোনোটি শহরের জন্য কঠিন:
নতুন শিক্ষাক্রমের পাঠ্যবই এমনভাবে সাজানো হয়েছে, যেখানে কিছু বিষয় গ্রামের সঙ্গে সম্পৃক্ত আবার কিছু শহরের সঙ্গে। শিক্ষার্থীরা এগুলো আনন্দের সঙ্গেই শিখতে পারে। কিন্তু যখনই সরাসরি গিয়ে সেগুলোর বিষয়ে প্রতিবেদন লিখতে হয়, তখন বেশ সমস্যার সৃষ্টি হয়।
পাঠ্যবইগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, মাঠে খেলার আয়োজন, নিজ এলাকার প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য বর্ণনা, নিজ এলাকায় বেশি উৎপাদিত কৃষিপণ্যের তালিকা করা, বিভিন্ন ধরনের মাটির বৈশিষ্ট্য দেখানোর জন্য সব ধরনের মাটি সংগ্রহ করা, স্কুলের সামনে লাইন ধরে হিসাবের খেলা দেখানো, অতিথি পাখির বিষয়ে বিস্তারিত লেখা, উদ্ভিদের বিভিন্ন অংশ পর্যবেক্ষণের জন্য শ্রেণিকক্ষের বাইরে যাওয়া, বস্তুর ওপর বলের প্রভাব পর্যবেক্ষণের জন্য কাদামাটি সংগ্রহ, স্কুল ও বাসায় গাছ রোপণ, ইকোট্যুরিজম, গাছে বিভিন্ন ধরনের কলম তৈরি ইত্যাদি বিষয় একজন গ্রামের শিক্ষার্থীর জন্য জানা বা করা যতটা সহজ, শহুরে শিক্ষার্থীদের ঠিক ততটাই কঠিন। ক্ষেত্রবিশেষে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে এগুলো করা অনেকের জন্য অসম্ভবও বটে।
আবার ফুট ওভারব্রিজ ও জেব্রা ক্রসিং দিয়ে রাস্তা পারাপার, পদার্থের অবস্থার পরিবর্তন বোঝাতে বরফ, পানি, কড়াই, কেতলি ও চুলা সংগ্রহ, সূর্যের আলোর উজ্জ্বলতা এবং তাপ পর্যবেক্ষণের জন্য আতশি কাচ সংগ্রহ, ফার্মেসি থেকে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের তথ্য ইত্যাদি গ্রামের শিক্ষার্থীর জন্য বেশি কষ্টসাধ্য। অনেকের পক্ষে অসম্ভবও।
এদিকে পৃথিবীর মডেল, সৌরজগতের মডেল, মহাদেশ মডেল, সূর্যঘড়ি মডেল, চন্দ্র মডেল, সূর্য মডেল, কোষ বিভাজন মডেল, ভূমিকম্প মডেল, চুম্বক তৈরি, ফিল্ড ট্রিপ, ল্যাবরেটরি গঠন ইত্যাদি প্রজেক্ট তৈরিতে শহরের শিক্ষার্থীরা এগিয়ে রয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
তারা বলছেন, ডিজিটাল ডিভাইস, বিশেষ করে মোবাইল ও কম্পিউটারের ওপর ডিজিটাল প্রযুক্তি বিষয়ের বেশিরভাগ কাজ নির্ভর করে। যেমন জিমেইল অ্যাকাউন্ট তৈরি, গুগল ড্রাইভ, গুগল ফর্ম, গুগল শিট, ফ্যাক্ট চেকিং, স্প্রেডশিট, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অ্যাকাউন্ট, গ্রাফিক্স ডিজাইনের জন্য সফটওয়্যার ডাউনলোড ও ব্যবহার, ভিডিও এডিটিং সফটওয়্যার ডাউনলোড ও ব্যবহার করা, ইনফোগ্রাফ তৈরি, ওয়েবসাইট তৈরি, প্রোগ্রামিং, নেটওয়ার্কিং ইত্যাদি। এগুলো শহুরে শিক্ষার্থীদের জন্য জোগাড় করা সম্ভব হলেও গ্রামের অনেক শিক্ষার্থীর জন্য আকাশকুসুম স্বপ্ন। আবার অনেক স্কুলেই শিক্ষার্থীদের জন্য কম্পিউটার নেই। যার ফলে স্কুলেও এসব কাজ করার সুযোগ নেই।
ব্যয় বেড়েছে অভিভাবকদের, ঝরে পড়ার শঙ্কা:
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, স্কুলের নিয়মিত উপকরণের বাইরেও অনেক খরচ বেড়েছে। অ্যাসাইনমেন্ট ও প্রজেক্টের জন্য অফসেট কাগজ, রঙিন কাগজ, আর্ট কাগজ, বোর্ড কাগজ, পোস্টারের জন্য রঙিন কাগজ, গ্লিটার কাগজ, রঙিন কলম, রং পেন্সিল, পোস্টার রং, সাইন কলম, গ্লিটার কলম, ফ্লুইড, আঠা, স্কচটেপ, র্যাপিং পেপার, কর্কশিট ইত্যাদি বেশি লাগছে। এর বাইরেও রয়েছে এন্টিকাটার, কাচের গ্লাস, কাচের বোয়াম, আলপিন, থার্মোমিটার, বৈদ্যুতিক তার, মোমবাতি, দিয়াশলাই, ব্যাটারি, টর্চলাইটের বাল্ব, অ্যালুমিনিয়ামের প্লেট, কয়লার টুকরো, টেস্টটিউব, তার জালি বা উঁচু স্ট্যান্ড, মধু, ভোজ্যতেল, কিশমিশ, পিংপং বল, ইট, বালি, মাটি, অ্যালুমিনিয়াম ফয়েল ইত্যাদি।
শিক্ষা গবেষক এবং শিক্ষা ও শিশু রক্ষা আন্দোলনের আহ্বায়ক রাখাল রাহা কালবেলাকে বলেন, শিক্ষাক্রমের সমস্যার কারণে শিক্ষকরা পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ পায়নি। অল্পতে বুঝতে পারবে, সেই মানের শিক্ষক আমাদের রয়েছে কি না, তা-ও দেখতে হবে। শিক্ষকদের প্রশিক্ষণে ত্রুটি থাকায় শিক্ষার্থীদের ওপর চাপ বাড়ছে। তিনি বলেন, মূল্যায়ন পরিমাপকগুলোকেও স্কেল দিয়ে মাপা যাবে না। এগুলোর মাঝে পার্থক্য কতখানি, তা-ও জানা যাবে না। এই শিক্ষাক্রমে ব্যয় বাড়ায় গ্রামের দিকে ব্যাপক হারে ড্রপ আউটও হবে। আবার শহরে অনেক অভিভাবক বাচ্চাকে এরই মধ্যে ইংরেজি মাধ্যম বা কওমি মাদ্রাসায় দিচ্ছেন।
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) সদস্য (শিক্ষাক্রম) অধ্যাপক মো. মশিউজ্জামান কালবেলাকে বলেন, অভিভাবকরা বাচ্চাদের ভবিষ্যতের বিষয়ে উদ্বেগ জানিয়ে ভুল করছে। শহরের বাচ্চাদের চাপ বাড়ছে, এটি সত্যি। স্কুলের কারণেই এমনটি হচ্ছে। আমরা যা করতে মানা করেছি, স্কুলগুলো তাই করছে। এটি তাদের দোষ, শিক্ষাক্রমের ত্রুটি নয়। তার পরও বিভিন্ন অভিযোগের বিষয়ে ট্রাই আউটের সময় বিবেচনা করা হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কামরুল ইসলাম মামুন বলেন, দেশের শিক্ষাব্যবস্থার একটি মূলধারা থাকে। এর উদ্দেশ্যই হলো, এ ধারা পড়ে একজন শিক্ষার্থী বিজ্ঞানী, দার্শনিক, অর্থনীতিবিদ ইত্যাদি হবে। যারা এ ধারায় থাকতে পারবে না, তাদের জন্য শাখা ধারা রয়েছে। তাদের কারিগরি বিদ্যায় নিতে হবে। নতুন শিক্ষাক্রমে মূল ধারাকে দুর্বল করে দেওয়া হচ্ছে। এর ফলে কয়েক বছর পরে পদার্থ, জীববিজ্ঞান, গণিত পড়ার জন্য ভালো শিক্ষার্থী পাওয়া যাবে না। তাই শিক্ষাক্রমের মূলধারা ঠিক রাখতে হবে।
মূল্যায়ন বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক এস এম হাফিজুর রহমান বলেন, শিক্ষাক্রমের প্রত্যাশা অনুযায়ী বইপত্র, শিক্ষক গাইড, মূল্যায়ন গাইড তৈরি হয়েছে। এরপর দেওয়া হয়েছে প্রশিক্ষণ। এখন চলছে বাস্তবায়ন। এখনই বাস্তবায়নের সমস্যাগুলো বোঝা যাবে। সমস্যা কোথায়? শিক্ষাক্রমের প্রত্যাশায়, বইপত্রে, গাইডগুলোতে, মূল্যায়ন নির্দেশিকায় নাকি প্রশিক্ষণ প্রদানে। সংশ্লিষ্টদের মনোযোগ দিতে হবে মাঠ পর্যায় থেকে এ ধরনের ডাটা সংগ্রহে। বিশ্লেষণ করে ব্যবহার করতে হবে পরবর্তী সংশোধনে। অবহেলা করলে পরবর্তী প্রজন্ম অন্ধকারে পড়বে, বিনষ্ট হবে অনেক স্বপ্ন।