আলী ইব্রাহিম
প্রকাশ : ২৯ মার্চ ২০২৪, ০২:৪৯ এএম
আপডেট : ২৯ মার্চ ২০২৪, ০৮:২৮ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

নিটল ভ্যাট ফাঁকি দিয়েছে ১২৪৫ কোটি টাকা

তথ্য গোপন
নিটল ভ্যাট ফাঁকি দিয়েছে ১২৪৫ কোটি টাকা

গাড়ি বিক্রির তথ্য গোপন করে সরকারের ১ হাজার ২৪৫ কোটি টাকা ভ্যাট ফাঁকি দিয়েছে নিটল মটরস লিমিটেড। ব্যবসার বিভিন্ন ধাপে তথ্য গোপন করে প্রতিষ্ঠানটি ছয় বছরে বিপুল পরিমাণ এই রাজস্ব ফাঁকি দিয়েছে। যশোর কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেটের সাম্প্রতিক নিরীক্ষায় বিষয়টি ধরা পড়েছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

সূত্র জানায়, নিটল মটরস দেশের বৃহৎ শিল্প গ্রুপ নিটল-নিলয়ের একটি প্রতিষ্ঠান। যশোরে এই প্রতিষ্ঠানের একটি কারখানা রয়েছে। এর মাধ্যমে ব্যবসার পরিধি বাড়লেও নিটলের কাছ থেকে বাড়তি কোনো রাজস্ব পায়নি সরকার। এ কারণে ভ্যাটের তথ্য যাচাই-বাছাইয়ের জন্য প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম নিরীক্ষার উদ্যোগ নেয় যশোর ভ্যাট কমিশনারেট। এতে বড় অঙ্কের ফাঁকির চিত্র বেরিয়ে আসে।

নিরীক্ষা প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, নিটল মটরস ২০১৩-১৪ থেকে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ১৩ হাজার ৭৩৪টি গাড়ির কেনাবেচার তথ্য গোপন করে ভ্যাট ফাঁকি দিয়েছে। এর মধ্যে ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ১ হাজার ৭৮৫টি গাড়ি, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ২১০৩টি, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৩ হাজার ২৭০টি, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৪ হাজার ২৪৬টি এবং ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ২ হাজার ৩৩০টি গাড়ির তথ্য গোপন করেছে। এই সময়ে তথ্য গোপন করা গাড়ির ভিত্তিমূ্ল্য ১ হাজার ৪৭৫ কোটি ৫৭ লাখ ৫ হাজার ৬৯৫ টাকা। এসব গাড়ি বিক্রির তথ্য গোপনের মাধ্যমে ২২১ কোটি টাকা ৩৩ লাখ ৫৫ হাজার ৮৪৫ টাকার ভ্যাট ফাঁকি দিয়েছে নিলট মটরস লিমিটেড। এ ছাড়া অডিট রিপোর্টে ভাড়ার ওপর আরোপিত ভ্যাটও কম দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। এর মধ্যে ২০১৩-১৪ থেকে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে শুধু ভাড়ার বিপরীতে ভ্যাট ফাঁকি দিয়েছে ৬৪ লাখ ৫০ হাজার ৩৬৭ টাকা। পাশাপাশি নিটল মটরসের আগস্ট ২০১৪ থেকে জুলাই ২০১৫ পর্যন্ত উৎসে ভ্যাট বাবদ ফাঁকি দিয়েছে ৩ কোটি ১৪ লাখ ১৭ হাজার ৩৬৮ টাকা।

এ ছাড়া নিটলের যৌথ মালিকানাধীন নীতা কোম্পানি লিমিটেডও পাঁচ অর্থবছরের ক্রয়-বিক্রয়ের তথ্য গোপন করেছে। যেসব গাড়ির মূল দাম ১ হাজার ২৫০ কোটি ৬৯ লাখ ৯৩ হাজার ৪৮৬ টাকা। এর বিপরীতে ভ্যাট ফাঁকি দেওয়া হয়েছে ১৮৭ কোটি ৬০ লাখ ৪৯ হাজার ২২ টাকা।

নিরীক্ষা প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, নিটল মটরস কেনাবেচার তথ্য গোপন করে ২০১৩-১৪ থেকে ২০১৭-১৮ সাল পর্যন্ত ভ্যাট পরিহার করেছে বা ফাঁকি দিয়েছে ১৮৭ কোটি ৬০ লাখ ৪৯ হাজার ২২ টাকা, স্থাপনার বিপরীতে ৩৫ লাখ ৭৩ হাজার ২২৯ টাকা এবং গাড়ি পরিচালন আয়ের তথ্য গোপনের মাধ্যমে ৬৯১ কোটি ১৩ লাখ ৪১ হাজার ৮৭১ টাকা। সব মিলে এই পাঁচ বছরের নিরীক্ষায় উঠে এসেছে ৮৭৯ কোটি ৯ লাখ ৬৪ হাজার ১২২ টাকা ভ্যাট না দেওয়ার তথ্য। ইতোমধ্যে এই অর্থ আদায়ে প্রতিষ্ঠানটির কাছে দাবিনামা সংবলিত নোটিশও পাঠিয়েছে যশোর ভ্যাট কমিশনারেট।

সূত্র আরও জানায়, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে নীতা কোম্পানি লিমিটেড কর্তৃক নিটল মটরসের কাছে বিক্রয় করা বাস, ট্রাক, পিকআপ হিসেবে মোট ৪ হাজার ১৯৯ ইউনিট মূসক রেজিস্টারে প্রদর্শন না করে ভ্যাট পরিহার বা ফাঁকি দেওয়ার প্রমাণ পেয়েছে যশোর ভ্যাট কমিশনারেটের নিরীক্ষা দল। বিক্রয় করা এসব পণ্যের মোট মূল্য ৫৫৪ কোটি ৫৬ লাখ ৭৭ হাজার ৭৬৭ টাকা। যার ওপর ১৫ শতাংশ প্রযোজ্য ভ্যাট বা মূসক হিসেবে আদায় যোগ্য ৮৩ কোটি ১৮ লাখ ৫১ হাজার ৬৬৫ টাকা।

ভ্যাট কমিশনারেটের প্রতিবেদন অনুযায়ী, নীতা কোম্পানির সরবরাহ করা যানবাহনের কিছু অংশ নগদ মূল্যে দেশের বিভিন্ন ক্রেতাকে সরবরাহ করার পাশাপাশি অন্য অংশ নিজস্ব সম্পত্তি হিসেবে অন্তর্ভুক্তকরণ এবং সেগুলো কোম্পানির অনুসৃত অপারেটিং লিজ রেন্টাল ইনকামে ব্যবহৃত হয়েছে। এ খাতে প্রাপ্ত ১ হাজার ৮৫৩ কোটি ৫৫ লাখ ৪৯ হাজার ৭৪৯ টাকা। কোম্পানির করা সি এ রিপোর্টে ‘ইনকাম ফ্রম অপারেটিং ভেহিক্যাল’ হিসেবে প্রদর্শিত হয়েছে। এ বিষয়ে প্রতিষ্ঠানটি লিখিত বক্তব্যে জানিয়েছে, অপারেটিং লিজ ও রেন্টাল আয়ের কার্যক্রম পরিচালনায় কোনো মূসক চালানপত্র প্রদান করা হয় না।

এ বিষয়ে নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘ইনকাম ফ্রম অপারেটিং ভেহিক্যাল’-এর আয়ের বিপরীতে খতিয়ান বই, পণ্য বা সেবা ক্রেতার তালিকা, ক্রেতার সহিত চুক্তিপত্র, অপারেটিং লিজ বা রেন্টাল ইনকামের নমুনা বিলের কপি দাখিল করার জন্য বারবার অনুরোধ করা হলেও নিটল মটরস কর্তৃপক্ষ কোনো দলিল দাখিল করেনি। যে কারণে ইনকাম ফ্রম অপারেটিং ভেহিক্যালস হিসেবে ১ হাজার ৮৫৩ কোটি ৫৫ লাখ ৪৯ হাজার ৭৪৯ টাকা। সি এ রিপোর্টে প্রদর্শিত আয়ের ওপর প্রযোজ্য ২৭৮ কোটি ৩ লাখ ৩২ হাজার ৪৬২ টাকার ভ্যাট বা মূসক পরিশোধিত হয়নি বা ফাঁকি দেওয়া হয়েছে। সি এ রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে অফিসের আসবাব, ইলেকট্রনিকস ও ইলেকট্রিক পণ্য, অডিট ফি, কার মেইনটেন্যান্স, প্রশাসনিক ব্যয়, বিজ্ঞাপন, নিরাপত্তা, সেলস প্রমোশন খরচসহ মোট ৩৭টি পণ্য ও সেবায় প্রদর্শিত মূল্য ধরা হয়েছে ২৫৫ কোটি ৪৪ লাখ ৭৫ হাজার ৭১০ টাকা। যার ওপর ৫-১৫ শতাংশ ভ্যাট আদায়যোগ্য। যেখানে ৩২ কোটি ১৪ লাখ ১৬ হাজার ৭৯৬ টাকার ভ্যাট প্রযোজ্য হলেও নিটল মটরস ২৭ কোটি ৪৯ লাখ ৩ হাজার ২৫১ টাকা পরিশোধ করেছে। অনাদায়ী বা ফাঁকি দেওয়া ভ্যাটের পরিমাণ ৪ কোটি ৬৫ লাখ ১৩ হাজার ৫৪৫ টাকা। এ ছাড়া শোরুম ভাড়ার পরিমাণ এবং দাখিলপত্রে প্রদর্শিত ভাড়ার ওপর ১৫ শতাংশ মূসক বা ভ্যাট প্রযোজ্য থাকলেও সার্বিক পর্যালোচনায় বকেয়া বা ফাঁকি দেওয়া ভ্যাটের পরিমাণ পাওয়া যায় ৫২ লাখ ৮৬ হাজার ৪৪০ টাকা। সবমিলিয়ে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে নিরীক্ষায় উদ্ঘাটিত রাজস্ব বা ভ্যাটবাবদ ৩৬৬ কোটি ৩৯ লাখ ৮৪ হাজার ১১২ টাকা নিটল মটরস লিমিটেডের কাছে আদায়যোগ্য হিসেবে চূড়ান্ত দাবিনামা জারি করেছে এনবিআর।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে নিটল-নিলয় গ্রুপের চেয়ারম্যান আব্দুল মাতলুব আহমদ কালবেলাকে বলেন, ‘আমরা সরকারের ভ্যাট-ট্যাক্স ঠিকমতো পরিশোধ করে ব্যবসা করে আসছি। এনবিআর আমাদের কর বাহাদুর উপাধি দিয়ে আসছে। নিটল মটরসের বিষয়টি এনবিআর অতিরিক্ত দাবি করছে। নিটল মটরসের কাছে এনবিআর এটা ডিমান্ড করছে, এটা ফাঁকি নয়।’

নিরীক্ষা প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা গেছে, নিটল মটরস বাস, ট্রাক, মাইক্রোবাস, পিকআপ যানবাহন সিবিইউ (কমপ্লিট বিল্ড ইউনিট) অবস্থায় আমদানি করে। ওই পণ্যের মূল্য ঘোষণা দিয়ে স্থানীয় বিক্রয়কেন্দ্র এবং দেশব্যাপী স্থাপিত শোরুমের মাধ্যমে মূসক পরিশোধ করে চালানপত্রের মাধ্যমে সরবরাহ করে। নিটল মটরস লিমিটেড যা চালানপত্রের মাধ্যমে সমুদয় উৎপাদিত পণ্য ক্রয় করে। নিরীক্ষায় নীতা কোম্পানি লিমিটেডের একই সময় বিক্রয় তথ্যের সঙ্গে নিটল মটরস লিমিটেডের ক্রয় হিসাবের তথ্যের মিল পাওয়া যায়নি। নীতা কোম্পানি লিমিটেড তাদের বিক্রয় করা পণ্যের কিছু অংশ নিটল মটরসের কাছে সরাসরি মূসক-১১ চালানপত্রের মাধ্যমে বিক্রয় করেছে এবং অবশিষ্ট পণ্যের বিক্রয় প্রদর্শন করা হয়েছে বিভিন্ন ব্যাংকের কাছে। এসব বিক্রয় চালানপত্র (মূসক-১১) বিভিন্ন ব্যাংকের কাছে প্রদর্শন করলেও সেখানে ঠিকানা হিসেবে নিটল মটরস লিমিটেডের নামই ব্যবহার করা হয়েছে। নিটল মটরসের নামে যতগুলো মূসক-১১ নীতা কোম্পানি ইস্যু করেছে, শুধু সেই পরিমাণ পণ্যই ক্রয় খাতায় লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। কিন্তু বিভিন্ন ব্যাংকের নামে চালান হিসাব করে (মূসক-১১) নিটল মটরসের হিসাবে প্রদর্শিত হয়েছে, সেই পরিমাণ পণ্য নিটল মটরসের ক্রয় রেজিস্টার বা বিক্রয় রেজিস্টারে লিপিবদ্ধ করা হয়নি। নিয়ম অনুযায়ী, ক্রয় রেজিস্টার ও বিক্রয় রেজিস্টারে লিপিবদ্ধ এবং চলতি হিসাবে সমন্বয়ের মাধ্যমে ভ্যাট বা কর পরিশোধিত হওয়ার কথা। কিন্তু ব্যাংকের নামে ক্রয় দেখানো হলেও সেটি প্রকৃতপক্ষে নিটল মটরস লিমিটেডের অনুকূলে সংগ্রহ করা হয়েছে। ব্যাংক ঋণের মাধ্যমে ভোক্তার কাছে পণ্যগুলো মূল্য সংযোজন ঘটিয়ে বিক্রি করা হয়েছে বলেও প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।

এ বিষয়ে যশোরের কাস্টমস এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনার মো. কামরুজ্জামানের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি। মোবাইল ফোনে খুদে বার্তা পাঠানো হলেও তিনি কোনো জবাব দেননি।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

‘কালি ও কলম তরুণ কবি ও লেখক পুরস্কার ২০২৩’ পেলেন চার তরুণ

সিলেটে হিটস্ট্রোকে রিকশাচালকের মৃত্যু

সিলেটে উন্মোচন হলো টি-টোয়েন্টি সিরিজের ট্রফি

সারা দেশে বিআরটিএ’র অভিযান / ৩৯৮ মামলা ও ৯ লাখ ৮৪ হাজার টাকা জরিমানা 

কাপ্তাই হ্রদের নাব্যতা সংকটে ৬ উপজেলায় লঞ্চ চলাচল বন্ধ

উপজেলা পরিষদ পৌর এলাকায়, তবুও ভোটারদের নিয়ে ধুম্রজাল

উপজেলা নির্বাচন / পছন্দের প্রার্থীকে ব্যারিস্টার সুমনের গ্রিন সিগন্যাল

গুচ্ছ পরীক্ষায় পাবিপ্রবিতে উপস্থিতি ৮৭.৬ শতাংশ

উপজেলা নির্বাচন সরকারের একটি ফাঁদ : প্রিন্স

বৃদ্ধাশ্রমের মধ্যেই ‘টর্চার সেল’ মিল্টন সমাদ্দারের

১০

বাস্কেটবল প্রশিক্ষণে আমেরিকা যাচ্ছে চাঁদপুরের ৩ শিক্ষার্থী

১১

সাইবার অপরাধ নিয়ন্ত্রণে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ অপরিহার্য: সিআইডি প্রধান

১২

‘দুর্নীতি আড়াল করতেই তথ্য সংগ্রহে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিষেধাজ্ঞা’

১৩

ছুরিকাঘাতে কিশোর গ্যাং নেতাকে হত্যা

১৪

প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে কাল ফিরছেন ২৩ নাবিক

১৫

ইমোতে বন্ধুত্বের ফাঁদ, বিবস্ত্র ভিডিও ধারণ করে ব্ল্যাকমেইল

১৬

সেনাপ্রধানের সঙ্গে বসবে পিটিআই, মুক্তি মিলবে ইমরান খানের?

১৭

তাপমাত্রা আরও বাড়ল চুয়াডাঙ্গায়

১৮

আকর্ষণীয় বেতনে ওয়াটারএইডে চাকরি, আবেদন করুন দ্রুত

১৯

১০২ পদে কর কমিশনারের কার্যালয়ে জনবল নিয়োগ

২০
*/ ?>
X