বাংলাদেশ উদ্বেগজনক মাত্রার দূষণ এবং পরিবেশগত স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছে; যা তুলনামূলক বেশি ক্ষতি করছে দরিদ্র, পাঁচ বছরের কম শিশু, বয়স্ক এবং নারীদের। বিভিন্ন ধরনের পরিবেশদূষণের ফলে বছরে ২ লাখ ৭২ হাজার মানুষের অকালমৃত্যু হচ্ছে। শুধু বায়ুদূষণের ফলেই অকালমৃত্যুর হার ৫৫ শতাংশ। বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
গতকাল বৃহস্পতিবার কান্ট্রি এনভায়রনমেন্টাল অ্যানালাইসিস ২০২৩ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বিশ্বব্যাংক। প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ুমন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরী। বিশেষ অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ ও ভুটানের কান্ট্রি ডিরেক্টর আবদুলায়ে সেক।
বিশ্বব্যাংক বলছে, দূষণের কারণে ২০১৯ সালে দেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ১৭ দশমিক ৬ শতাংশ সমপরিমাণ অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছে। ঘরের এবং বাইরের বায়ুদূষণ স্বাস্থ্যের ওপর সবচেয়ে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। এই ক্ষতির পরিমাণ ২০১৯ সালের জিডিপির ৮ দশমিক ৩ শতাংশের সমান।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে সাবের হোসেন চৌধুরী বলেন, পরিবেশ দূষণের জন্য দায়ী উন্নত রাষ্ট্রগুলো। অথচ এতে ফল পেতে হয় আমাদের। আমরা যখন আমাদের উন্নয়ন সহযোগীদের সঙ্গে এ নিয়ে কথা বলি, তারা আমাদের ঋণ নিতে উৎসাহ দেয়। আমাদের দেশের জলবায়ু অর্থায়নের ৪০ শতাংশ ঋণ করতে হয়। আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্য এটি কঠিন।
তিনি বলেন, পুরো জাতির সুস্বাস্থ্য নির্ভর করে দেশের পানির মান ও পরিবেশের ওপর। আজকে (বৃহস্পতিবার) যে প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করা হয়েছে, এতে আমাদের জন্য সেলিব্রেট করার মতো কিছু নেই। বাংলাদেশের মতো দেশের অনেক চ্যালেঞ্জ। আমাদের বড় চ্যালেঞ্জই জলবায়ু পরিবর্তন।
সাবের হোসেন চৌধুরী বলেন, জলবায়ু খাতে আমাদের বাজেট বরাদ্দ ৩৭ হাজার কোটি টাকা। এ দেশের জলবায়ু পরিবর্তনের সমস্যা চিহ্নিত করা কঠিন। আমরা যেগুলো চিহ্নিত করি, সেগুলোর জন্য অর্থায়ন আনা খুব কঠিন।
বিশ্বব্যাংকের উদ্দেশে মন্ত্রী বলেন, অর্থায়ন আনা কতটা কঠিন, আমি একটি উদাহরণ দিই। ২০১৮ সালে আমরা পানির সরবরাহের প্রকল্পের জন্য সে সময়ে কান্ট্রি ডিরেক্টরের কাছে গিয়েছিলাম, অনুমোদন করতে ছয় বছর লেগেছে।
এ সময়ে পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ড. ফাহমিদা খানম বলেন, জলবায়ু সংকট মোকাবিলা আমরা একা করতে পারব না। আমাদের মন্ত্রণালয়ে মাত্র ১ হাজার ১৩৩ জন জনবল নিয়ে চলছে, সংকট মোকাবিলায় আমাদের আরও বেশি জনবল প্রয়োজন।
বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর আবদুলায়ে সেক বলেন, বাংলাদেশের জন্য পরিবেশের ঝুঁকি মোকাবিলা একই সঙ্গে উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক অগ্রাধিকার। আমরা পৃথিবীর নানা দেশে দেখেছি যে, পরিবেশের ক্ষতি করে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হলে তা টেকসই হতে পারে না। শক্তিশালী প্রবৃদ্ধির গতিপথ টেকসই রাখতে এবং শহর ও গ্রামাঞ্চলের মানুষের জীবনমানের উন্নতি করতে বাংলাদেশ কোনোভাবেই পরিবেশকে উপেক্ষা করতে পারবে না। উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার লক্ষ্য অর্জনে পরিবেশের ক্ষয় রোধ এবং জলবায়ু সহিষ্ণুতা নিশ্চিত করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
বিশ্বব্যাংক জানিয়েছে, পরিবেশ দূষণ শিশুদের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। সিসা বিষক্রিয়া শিশুদের মস্তিকের বিকাশে অপরিবর্তনীয় ক্ষতি করছে। এর ফলে বছরে প্রাক্কলিত আইকিউ ক্ষতি হচ্ছে প্রায় ২০ মিলিয়ন পয়েন্ট। গৃহস্থালিতে কঠিন জ্বালানির মাধ্যমে রান্না বায়ুদূষণের অন্যতম উৎস। এটি নারী ও শিশুদের বেশি ক্ষতি করছে। শিল্পের বর্জ্য এবং অনিয়ন্ত্রিত প্লাস্টিকসহ বিভিন্ন বর্জ্য এবং অন্যান্য উৎস থেকে আসা অপরিশোধিত ময়লাযুক্ত পানির কারণে বাংলাদেশের নদীগুলোর পানির গুণগত মানের মারাত্মক অবনতি ঘটেছে।
বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকদের পরামর্শ দিয়ে সংস্থাটি বলছে, বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে সময়মতো এবং জরুরি হস্তক্ষেপ, উন্নত পানি, স্যানিটেশন ও হাইজিন (ওয়াশ) এবং সিসা দূষণ নিয়ন্ত্রণ প্রতি বছর ১ লাখ ৩৩ হাজারের বেশি অকালমৃত্যু ঠেকাতে পারে। সবুজ বিদ্যুৎ উৎপাদনে বিনিয়োগ, রান্নায় সবুজ জ্বালানি ব্যবহার এবং শিল্পকারখানা থেকে দূষণ রোধে কঠোর নিয়ন্ত্রণ বায়ুদূষণ কমাতে পারে।
বিশ্বব্যাংকের সিনিয়র পরিবেশ বিশেষজ্ঞ এবং প্রতিবেদনটির সহ-প্রণেতা আনা লুইসা গোমেজ লিমা বলেন, সময়মতো এবং সঠিক নীতি ও কার্যক্রমের মাধ্যমে বাংলাদেশ পরিবেশ দূষণের ধারা পাল্টে ফেলতে পারে। পরিবেশ সুরক্ষা জোরদারে পদক্ষেপ এবং রান্নায় সবুজ জ্বালানির জন্য বিনিয়োগ ও অন্যান্য প্রণোদনা, সবুজ অর্থায়ন বাড়ানো, কার্যকর কার্বন মার্কেট প্রতিষ্ঠা এবং সচেতনতা বাড়ানো দূষণ কমাতে পারে এবং এর ফলে সবুজ প্রবৃদ্ধি অর্জন হতে পারে।
পরিবেশগত ব্যবস্থাপনার জন্য সুশাসন জোরদার ও প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বাড়াতে এই প্রতিবেদনে পরিবেশগত অগ্রাধিকারগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে, বিভিন্ন পদক্ষেপের মূল্যায়ন এবং প্রয়োজনীয় সুপারিশ করা হয়েছে। সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে অগ্রাধিকার নির্ধারণ, পরিবেশ নীতি পদ্ধতিগুলোর বৈচিত্র্যকরণ ও জোরদারকরণ, সাংগঠনিক কাঠামো এবং প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা জোরদারকরণ এবং সবুজ অর্থায়নের জন্য সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টির মাধ্যমে বাংলাদেশ এর পরিবেশকে রক্ষা করতে পারে।