ঝিনাইদহ-৪ (কালীগঞ্জ) আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনার নিজের জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে তেমন ভাবতেন না। সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত তিনি ছুটে বেড়াতেন নির্বাচনী এলাকার গ্রামে গ্রামে। পুলিশ প্রটোকল ছাড়া মোটরসাইকেলে কখনো একা আবার কখনো অন্যের পেছনে বসে চলাচল করতেন। মানুষের সমস্যার কথা শুনে সমাধানের উদ্যোগ নিতেন। নির্বাচনী এলাকায় কোনো মানুষের মৃত্যুর খবর শুনলে জানাজায় হাজির হতেন তিনি। এভাবে সবার প্রিয় হয়ে উঠেছিলেন এই সংসদ সদস্য।
এমপি আনার সম্পর্কে এসব তথ্য জানান স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। সংসদ সদস্যের নিহতের খবরে স্বজন ও রাজনৈতিক সহকর্মীরা দিশেহারা হয়ে পড়েছেন।
সকালে নিহত আনারের বাড়ি ও তার নির্বাচনী এলাকায় এ মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে হাজার হাজার নেতাকর্মী ভিড় করতে থাকেন। তার নিজ বাসভবন ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ শহরের নিশ্চিন্তপুর এলাকার ভূষণ রোড সকাল ১১টার মধ্যে লোকে লোকারণ্য হয়ে যায়। দলীয় কার্যালয় ও বাড়ির সামনে শতশত মানুষ কান্নায় ভেঙে পড়েন। প্রিয় নেতার এই অকালমৃত্যু তারা কেউ মেনে নিতে পারছেন না বলে জানান।
ঘটনার খবর পেয়ে সংসদ সদস্যের বাড়িতে আসেন কালীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইসরাত জাহান, কালীগঞ্জ থানার ওসি মোহাম্মদ আবু আজিফসহ প্রশাসনের নানা স্তরের কর্মকর্তারা। পাশাপাশি রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা দলীয় কার্যালয়ে এসে হাজির হন।
এমপি আনারের রাজনৈতিক কার্যালয়ের সিঁড়িতে বসে বারবার বিলাপ করছিলেন, এমপি আনারের এক সহযোগী রুবেল হোসেন। তিনি জানান, ভারত যাওয়ার আগে তার সঙ্গে শেষ কথা হয়। এ সময় তিনি বলেছিলেন ‘চেকগুলো তুলে রাখো। গরিব মানুষের চেকগুলো তুলে রাখো। ফিরে এসে চেক সব একসঙ্গে বিতরণ করব। চলে গেল, এখন এভাবে কে গরিব মানুষ নিয়ে ভাববে। কে আর এভাবে কথা বলবে।
আহাজারি করছিলেন নিহত সংসদ সদস্যের আত্মীয় কালীগঞ্জ পৌরসভার সংরক্ষিত মহিলা কাউন্সিলর বিনা খাতুন। তিনি বলছিলেন, আমাদের সোনার জামাই কীভাবে চলে গেল। সে তো কারও ক্ষতি করেনি। তাকে কেন মেরে ফেলা হলো। আমরা এর বিচার চাই।
শোকার্ত স্থানীয় অনেকেই বলেন, এমনও হয়েছে এমপি এক দিনে ১০ জন মৃত ব্যক্তির বাড়িতে গিয়ে পরিবারের সঙ্গে দেখা করেছেন। এ পর্যন্ত তিনি ৫ হাজারের বেশি মৃত ব্যক্তির দোয়া অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছেন, যা দেশের একজন জনপ্রতিনিধি হিসেবে বিরল।
আওয়ামী লীগের উপজেলা শাখার যুগ্ম সম্পাদক ও সুন্দরপুর-দুর্গাপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. ওহিদুজ্জামান বলেন, সংসদ সদস্যের মৃত্যুতে গোটা কালীগঞ্জের মানুষ একজন প্রাণের নেতাকে হারাল। এমপির সঙ্গে কারও কোনো বিরোধ ছিল না, যা ছিল তা খুবই সামান্য; কিন্তু তার জনপ্রিয়তা ছিল অনেক। তার ধারণা, মূলত ব্যবসায়িক দ্বন্দ্বের কারণে তাকে হত্যা করা হয়েছে। তারা ভারত থেকে মরদেহ ফেরত পাওয়ার অপেক্ষায় আছেন। এরপর জানাজা শেষে পরবর্তী কর্মসূচির বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
কালীগঞ্জ পৌরসভার মেয়র ও পৌর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আশরাফুল আলম জানান, আনোয়ারুল আজিম এলাকায় জনপ্রিয় ছিলেন। এ কারণে একটি মহল চক্রান্ত করে এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। যথাযথ তদন্তের মাধ্যমে হত্যার কারণ ও হত্যাকারীদের আইনের আওতায় আনার দাবি জানান তিনি।
কালীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আইয়ুব হোসেন বলেন, আমরা একজন নেতাকে হারিয়ে বাকরুদ্ধ হয়ে গেছি, যা আমরা কিছুতেই মানতে পারছি না। এমপি আনারের মতো একজন রাজনীতিবিদকে হারিয়ে কালীগঞ্জবাসীর অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে।
কালীগঞ্জ উপজেলার পার-শ্রীরামপুর গ্রামের ইয়াকুব আলীর চার পুত্রের মধ্যে ছোট ছিলেন আনার। ছোটবেলা থেকেই ফুটবল খেলার প্রতি আগ্রহী ছিলেন। অল্প বয়সে তিনি এ অঞ্চলের একজন জনপ্রিয় খেলোয়াড় হয়ে ওঠেন। ১৯৮৬ সালে ব্যবসা আর ৮৮ সালে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন। তৎকালীন বিএনপি নেতা ও পরে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য আবদুল মান্নানের হাত ধরে রাজনীতিতে আসেন। ১৯৯২ সালে কালীগঞ্জ পৌরসভা গঠিত হলে আনার কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। ১৯৯৫ সালে আবদুল মান্নান বিএনপি ছেড়ে আওয়ামী লীগে যোগ দেন। তখন আনারও আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে যুক্ত হন। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে তারা দুজনই এলাকায় আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয় হন। ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় এলে আনার ভারতে চলে যান। সেখানে দীর্ঘদিন অবস্থানকালে তিনি ২০০৪ সালে কালীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। এরপর তিনি দেশে ফিরে আসেন।
২০০৯ সালের নির্বাচনে আবদুল মান্নান আওয়ামী লীগের মনোনয়ন নিয়ে সংসদ সদস্য এবং আনার দলের সমর্থনে কালীগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান থাকা অবস্থায় তার সঙ্গে আবদুল মান্নানের বিরোধ হয়। ২০১৪ সালে দলীয় মনোনয়ন নিয়ে ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন আনার। টানা তিনবার তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন।