ইসরায়েলকে অবিলম্বে গাজার দক্ষিণাঞ্চলীয় রাফাহ শহরে সামরিক অভিযান বন্ধের নির্দেশ দিয়েছেন আন্তর্জাতিক বিচার আদালত (আইসিজে)। অব্যাহত হামলা নিয়ে আইসিজেতে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে দক্ষিণ আফ্রিকার করা অভিযোগের শুনানিতে গতকাল শুক্রবার আইসিজের বিচারকরা এ আদেশ দেন। পাশাপাশি গণহত্যার অভিযোগ তদন্তকারীদের সেখানে প্রবেশাধিকার নিশ্চিতের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এর আগে যুক্তরাষ্ট্রও ইসরায়েলকে রাফাহ অভিযানের ব্যাপারে সতর্ক করেছিল। এ ছাড়া পশ্চিমা বিশ্বও সেখানে হামলা চালাতে নিষেধ করেছিল। তবে সব সতর্কতা উপেক্ষা করে অভিযান চালায় তেলআবিব। এর পরই এলো আইসিজের এ নির্দেশনা। এখন স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন উঠছে, ইসরায়েল কি এই আদেশ মানবে?
ইসরায়েল এখন এ রায়ে কীভাবে সাড়া দেবে, সে ব্যাপারে তাদেরই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আইসিজের আদেশ মেনে চলার আইনি বাধ্যবাধকতা আছে এর সদস্য দেশগুলোর। তবে আদেশ কার্যকর করার কোনো ক্ষমতা আদালতের নেই। আদেশ প্রতিপালনে বাধ্য করার জন্য প্রয়োজনীয় জনবলও এই আদালতের নেই। তাই ইসরায়েল চাইলে বিচারকদের এ আদেশ সম্পূর্ণ উপেক্ষা করতে পারে। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, এবার আদেশ উপেক্ষা করা সহজ হবে না। কারণ, এর আগের আদেশের পর কিন্তু ইসরায়েল সেখানে ত্রাণ সহায়তা পৌঁছানোর পথ কিছুটা হলেও উন্মুক্ত করেছিল। এ ছাড়া এবার হামলা বন্ধ করে ইসরায়েলকে এক মাসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দেওয়ার আদেশও দিয়েছেন আদালত।
গতকাল শুক্রবার নেদারল্যান্ডসের দ্য হেগে অবস্থিত আইসিজের দেওয়া আদেশ ও রুলের বরাত দিয়ে বিবিসি ও আলজাজিরা এসব তথ্য জানিয়েছে। এ আদেশ ১৫ বিচারকের প্যানেলে ১৩-২ ভোটে গৃহীত হয়। শুধু উগান্ডা ও ইসরায়েলের বিচারকরা এর বিরোধিতা করেছেন।
আদেশ পড়ে শোনান আইসিজের প্রেসিডেন্ট নাওয়াফ সালাম। তিনি বলেন, গত মার্চে আদালত গাজার পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার আদেশ দিলেও এখন পর্যন্ত পরিস্থিতি ঠিক হয়নি এবং নতুন এ জরুরি আদেশ দেওয়া হলো। তিনি বলেন, ‘ইসরায়েল অবিলম্বে সামরিক হামলা বন্ধ করবে। রাফাহতে যে কোনো আক্রমণ গাজায় ফিলিস্তিনিদের ওপর প্রভাব ফেলবে এবং এটি গাজাবাসীর জীবনকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যেতে পারে।’
গাজায় মানবিক সহায়তা পৌঁছানোর জন্য মিশর ও গাজার মধ্যে রাফাহ ক্রসিং খুলে দেওয়ারও নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।
এ রায়ের পর ইসরায়েলের বিরোধীদলীয় নেতা ইয়ার লাপিদ আইসিজের নির্দেশকে ‘নৈতিক বিপর্যয়’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি এর নিন্দা জানান। পাশাপাশি রাফাহ অভিযানকে আত্মরক্ষার্থে চালানো হচ্ছে বলে দাবি করেন তিনি। আর রাফাহতে অভিযান চালিয়ে যাওয়ার কথা জানিয়েছেন দেশটির সংস্কৃতি ও ক্রীড়ামন্ত্রী মিকি জোহার। তিনি বলেন, হামাসের হাতে বন্দিরা ফিরে না আসা পর্যন্ত অভিযান অব্যাহত থাকবে। ইসরায়েলের অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মরিচ বলেছেন, তারা এ নির্দেশনার সঙ্গে একমত নন। তবে এ রায়কে স্বাগত জানিয়েছে গাজার সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাস। আইসিজের গতকালের নির্দেশনাকে স্বাগত জানিয়ে মামলা করা দেশ দক্ষিণ আফ্রিকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী নালেডি প্যান্ডোর বলেছেন, এটি গাজায় সংঘাত বন্ধের জন্য আইসিজের সুস্পষ্ট আহ্বান।
ফিলিস্তিনিদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে গাজায় এবং বিশেষ করে রাফাহতে ইসরায়েলের অভিযান বন্ধে আইসিজের কাছে জরুরি ব্যবস্থা চেয়ে গত সপ্তাহে আবেদন করে দক্ষিণ আফ্রিকা। দেশটি এর আগে আন্তর্জাতিক এ আদালতে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ এনে মামলা করেছিল। সেই বৃহত্তর মামলার অংশ হিসেবেই দেশটি পরে রাফাহ অভিযান বন্ধে এ জরুরি ব্যবস্থা চেয়েছে।
১৯৪৮ সালের গণহত্যা কনভেনশন লঙ্ঘন করা নিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার আনা অভিযোগের নিন্দা করেছে ইসরায়েল। তারা মামলা প্রত্যাহারের দাবিও জানায়। তবে আইসিজে ইসরায়েলের এ দাবি প্রত্যাখ্যান করেছে।
গত জানুয়ারিতে দক্ষিণ আফ্রিকার আবেদনের ভিত্তিতে আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার আদালতের এক আদেশে ইসরায়েলকে গণহত্যা বন্ধে পদক্ষেপ নিতে বলা হয়। তবে সামরিক অভিযান বন্ধের আদেশ দেওয়া হয়নি। এর পরই দক্ষিণ আফ্রিকা রাফাহতে অবস্থানরত ফিলিস্তিনিদের সুরক্ষায় সেখানে বাড়তি জরুরি ব্যবস্থা নেওয়ার আবেদন করে আদালতের কাছে।
এ ছাড়া দক্ষিণ আফ্রিকার পক্ষ থেকে আদালতের কাছে আরেকটি আদেশ চাওয়া হয়েছে, যাতে ইসরায়েল গাজায় জাতিসংঘ এবং মানবিক সহায়তা সরবরাহকারী সংস্থা, সাংবাদিক ও তদন্তকারীদের অবাধে প্রবেশাধিকার দেয় সে মর্মে। গতকালের আদেশে আদালত সেখানে অবাধে তদন্তকারীদের প্রবেশাধিকার দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন।
গত ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামলা চালায় হামাস। এর পরই গাজায় হামলা শুরু করে তারা। হামলায় গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাবমতে, এ পর্যন্ত ৩৫ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। এ হামলার মুখে প্রাণ বাঁচাতে রাফাহতে আশ্রয় নিয়েছিলেন গাজার বেশিরভাগ বাসিন্দা। তবে ৭ মে থেকে সেখানেও স্থল অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েল। জাতিসংঘের হিসাবে, এ অভিযানের মুখে ১৮ মে পর্যন্ত রাফাহ ছেড়ে পালিয়েছেন আট লাখ ফিলিস্তিনি।
তবে ইসরায়েল প্রতিবারই গাজায় গণহত্যার অভিযোগকে ভিত্তিহীন বলে দাবি করেছে। আদালতে ইসরায়েল যুক্তি দিয়েছে, আত্মরক্ষার্থে তারা গাজায় এ হামলা চালাচ্ছে এবং ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামলাকারী সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাস তাদের লক্ষ্যবস্তু।