দেশের ১১৯টি উপজেলার ৯৩৪টি ইউনিয়নে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির চিহ্ন রেখে গেছে ঘূর্ণিঝড় রিমাল। ভয়াবহ এ প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিধ্বস্ত হয়েছে ১ লাখ ৭৩ হাজার ৮৬৬টি ঘরবাড়ি। দেশের ১৯ জেলায় তাণ্ডব চালিয়ে যাওয়া রিমালে ৪৫ লাখ ৯৯ হাজার ৪৬৪ জন মানুষ সরাসরি আক্রান্ত হয়েছে। প্রাথমিকভাবে স্থানীয় জেলা প্রশাসনের তথ্যানুসারে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় ক্ষয়ক্ষতির এ তালিকা তৈরি করেছে। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাতেও বড় বিপর্যয় ঘটিয়েছে রিমাল। এ দুটি খাতে প্রায় ৭৫০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে। তবে ক্ষতির পরিমাণ আরও বাড়তে পারে। ক্ষয়ক্ষতির চূড়ান্ত পরিমাণ জানিয়ে আগামী রোববার সংবাদ সম্মেলন করবে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়।
" ৪৫ লাখ ৯৯ হাজার ৪৬৪ মানুষ সরাসরি আক্রান্ত মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাতে প্রায় ৭৫০ কোটি টাকার ক্ষতি বুধবার পর্যন্ত ৬ কোটি ৮৫ লাখ টাকা বরাদ্দ "
সরকারি হিসাব বলছে, রিমালে মৃত্যু হয়েছে ২০ জনের। মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, খুলনার ১০ উপজেলার ৭২টি ইউনিয়নে দুর্গত মানুষের সংখ্যা ধরা হয়েছে ৪ লাখ ৫২ হাজার ২০০ জন। এ জেলায় মানুষের ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে ৭৬ হাজার ৯০৪টি। এর মধ্যে আংশিক বিধ্বস্ত হয়েছে ৫৬ হাজার ১৪২টি এবং পুরোপুরি বিধ্বস্ত হয়েছে ২০ হাজার ৭৬২টি। নিহত হয়েছে একজন।
সাতক্ষীরার ৪৩টি ইউনিয়নে রিমালের তাণ্ডবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ২ লাখ ২১ হাজার ১৭৬ জন। ১ হাজার ৪৬৮টি ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। আংশিক বিধ্বস্ত হয়েছে ১ হাজার ১৯২টি এবং পুরোপুরি বিধ্বস্ত ২৭৬টি। রিমাল প্রাণ কেড়েছে একজনের।
বাগেরহাট জেলার ৭৫টি ইউনিয়নের দুর্গত মানুষের সংখ্যা ৫ লাখ। ৪৫ হাজার ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে বলে স্থানীয় প্রশাসনের হিসাবে উঠে এসেছে। পুরোপুরি বিধ্বস্ত ঘরবাড়ি ১০ হাজার এবং আংশিক বিধ্বস্ত ৩৫ হাজার। এ জেলায় প্রাণহানির কোনো খবর দেয়নি প্রশাসন।
ঝালকাঠির ৩২টি ইউনিয়নে রিমালে দুর্গত মানুষ ৭ হাজার ৭৬২ জন। এ জেলায় ১ হাজার ৯৪০টি ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হওয়ার খবর মিলেছে। এর মধ্যে ১ হাজার ৭৯০টি ঘরবাড়ি আংশিক বিধ্বস্ত হয়েছে। পুরোপুরি বিধ্বস্ত হয়েছে ১৫০টি ঘরবাড়ি।
বরিশাল জেলার ১০২টি ইউনিয়নে ১ লাখ ৮৫ হাজার ৫০০ মানুষ রিমালে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ জেলায় ২ হাজার ৭২২টি ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। এর মধ্যে ২৫৫টি ঘরবাড়ি সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বাকি ২ হাজার ৪৬৭টি ঘরবাড়ি আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
পুটয়াখালীর ৭৬ ইউনিয়নের ক্ষয়ক্ষতির প্রাথমিক তথ্য নিরূপণ করেছে প্রশাসন। ৩ লাখ ২৭ হাজার মানুষ রিমালে সরাসরি আক্রান্ত হয়েছে। ২ হাজার ১০০টি ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। এর মধ্যে পুরোপুরি বিধ্বস্ত ঘরবাড়ির সংখ্যা ২৩৫টি এবং আংশিক বিধ্বস্ত ১ হাজার ৮৬৫টি।
পিরোজপুরে ৫৭ ইউনিয়নে ৯ লাখ মানুষ রিমাল দুর্গত। ১৪ হাজার ২১৮টি ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। পুরোপুরি বিধ্বস্ত হয়েছে ২ হাজার ৬৭১টি। আংশিক ১১ হাজার ৫৪৭টি। বরগুনার ৪২ ইউনিয়নে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সাড়ে ৫ লাখ মানুষ। ১৬ হাজার ৪০৮টি ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। পুরোপুরি বিধ্বস্ত হয়েছে ৩ হাজার ৩৭৪টি ঘরবাড়ি। ভোলার ৬০ ইউনিয়নে ২ লাখ ২৩ হাজার ৩০৩ জন চরম দুর্বিপাকে পড়েছে। তাদের ৭ হাজার ৬২৩টি ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। এর মধ্যে ২ হাজার ৪৬৫টি পুরোপুরি বিধ্বস্ত এবং ৫ হাজার ১৫৮টি ঘরবাড়ি আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফেনীতে ক্ষয়ক্ষতি কম হয়েছে। এ জেলায় দুর্গত মানুষ ৪ হাজার ধরা হলেও ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত কিংবা অন্য কোনো ক্ষয়ক্ষতির হিসাব করতে পারেনি জেলা প্রশাসন। কক্সবাজার জেলায়ও ক্ষয়ক্ষতির হিসাব করেনি প্রশাসন।
চট্টগ্রামের ২০ ইউনিয়নে ১৬৫টি ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হওয়ার খবর মিলেছে। এ জেলায় ৬ হাজার ৩৬৮ জন রিমালের প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানিয়েছে জেলা প্রশাসন। নোয়াখালীর ২৬ ইউনিয়নে ৫৩ হাজার ৪৫০ জন রিমালে আক্রান্ত হয়েছে। তাদের ৩ হাজার ৩৭৬টি ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হওয়ার তথ্য দেখিয়েছে স্থানীয় প্রশাসন। তবে এ জেলায় বাস্তবে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আরও বেশি বলে দাবি স্থানীয়দের। নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলার বেশিরভাগ অংশই পানিতে তলিয়ে গেছে। ঘরবাড়ি তছনছ করে দিয়েছে ঘূর্ণিঝড় রিমাল।
লক্ষ্মীপুরের ১৭৫ ইউনিয়নেও রিমাল তাণ্ডবের চিহ্ন রেখে গেছে। এ জেলায় ৬৫ হাজার ক্ষতির শিকার হয়েছে। তবে তাদের ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হওয়ার খবর এখনো মেলেনি। চাঁদপুরে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ জানাতে পারেনি প্রশাসন। নড়াইলে ২০০টি ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হওয়ার খবর দিয়েছে প্রশাসন। গোপালগঞ্জে ১১ লাখ মানুষ ঘূর্ণিঝড় রিমালে আক্রান্ত হয়েছে বলে দাবি স্থানীয় প্রশাসনের। তাদের ১ হাজার ২০০টি ঘরবাড়ি আংশিক বিধ্বস্ত হয়েছে। যশোরে প্রায় ১৫০টি ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। শরীয়তপুরের ৪৫ ইউনিয়নে ২ হাজার ২০৫ জন মানুষকে দুর্গত দেখিয়েছে স্থানীয় প্রশাসন। তাদের প্রায় ৪০০টি ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে বলে দাবি প্রশাসনের।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাতে ক্ষতি সাড়ে ৭০০ কোটি মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাতে বড় ক্ষতি হয়েছে দেশের। এ দুই খাতে প্রায় ৭৫০ কোটি টাকার বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। তবে এখন পর্যন্ত চূড়ান্ত হিসাব তৈরি করতে পারেনি সরকার। স্থানীয় প্রশাসন এবং মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাতের কর্মকর্তারা ক্ষতির তালিকা তৈরিতে কাজ করছেন। চূড়ান্ত ক্ষতির পরিমাণ জানতে আরও তিন থেকে চার দিন সময় লাগবে বলে ধারণা করছেন তারা।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের অ্যানিমেল প্রোডাকশন অফিসার আলী রেজা আহমেদ জানান, খুলনা জেলার কয়রা এবং সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলায় বাঁধ ভেঙে বিভিন্ন গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। ভেটেরিনারি মেডিকেল টিম ও রেসকিউ টিম ক্ষতিগ্রস্ত গবাদি পশু, হাঁস-মুরগি ও পশুখাদ্য সামগ্রীর ক্ষয়ক্ষতির তথ্য সংগ্রহ চালাচ্ছে। বৈরী আবহাওয়ার কারণে সারা দেশের তথ্য সংগ্রহ বিলম্ব হচ্ছে বলে জানান তিনি।
বরাদ্দ ৬ কোটি ৮৫ লাখ
রিমালে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য গতকাল বুধবার পর্যন্ত ৬ কোটি ৮৫ লাখ টাকা বরাদ্দ দিয়েছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়। এর মধ্যে ১৫ জেলায় ৩ কোটি ৮৫ লাখ টাকা দেওয়া হয়েছে। ৫ হাজার ৫০০ টন চাল ও ৫ হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার পৌঁছানো হয়েছে। এ ছাড়া শিশুখাদ্য কেনার জন্য ১ কোটি ৫০ লাখ টাকা সহযোগিতা করা হয়েছে। এসব সহযোগিতা ক্ষতিগ্রস্তদের মোবাইল অ্যাকাউন্টে যাবে। বরাদ্দ অব্যাহত থাকবে বলে জানিয়েছেন প্রতিমন্ত্রী মহিবুর রহমান।