স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তোলার স্বার্থে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) চাপ উপেক্ষা করেই আইসিটি খাতের ১৯ ধরনের ব্যবসাকে তিন বছরের জন্য করমুক্ত রাখতে যাচ্ছে সরকার। এসব খাতের আর্থিক লেনদেনকে ক্যাশলেস করার শর্তে আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে এমন ঘোষণা আসতে পারে। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে তাল মেলাতে বিদ্যুৎচালিত গাড়ির (ইলেকট্রিক কার) শুল্ক-কর কমানোর সিদ্ধান্ত আসতে পারে। অন্যদিকে, রাজস্ব আয় বাড়াতে বেসরকারিভাবে গড়ে ওঠা হাইটেক পার্ক এবং অর্থনৈতিক অঞ্চলের কর অব্যাহতি সুবিধা বাতিলের প্রস্তাব করতে পারেন অর্থমন্ত্রী। সেইসঙ্গে সব স্তরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আয়ের ওপর করারোপের প্রস্তাব করা হতে পারে। এ ছাড়া বাজেটে ১৫ শতাংশ কর দিয়ে স্থাবর সম্পত্তি কিংবা নগদ অর্থ বিনা প্রশ্নে সাদা করার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে বলেও অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, এর আগে ১০ শতাংশ কর দিয়ে অপ্রদর্শিত অর্থ বা সম্পত্তি বৈধ করার সুযোগ দিয়েছিল জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এ ক্ষেত্রে এবার করহার ৫ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব করা হতে পারে।
বাজেটে এ ধরনের সুযোগ দেওয়ার বিষয়ে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান কালবেলাকে বলেন, ‘বিনা প্রশ্নে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। একই সঙ্গে দুর্নীতির সহায়ক। একজন করদাতা সৎভাবে অর্থ উপার্জন করে কর দেবেন ৩০ শতাংশ, আর অবৈধভাবে উপার্জন করে কর দেবেন ১৫ শতাংশ, তা কোনোভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। এতে সমাজে বৈষম্য তৈরি হবে। একই সঙ্গে অবৈধভাবে অর্থ উপার্জনকারীকে উৎসাহিত করা হচ্ছে। সরকারের উচিত এ ধরনের চিন্তা থেকে সরে আসা।’
জানা গেছে, আগামী অর্থবছরে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে সব স্তরের এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানের আয়ের ওপর ২০ শতাংশ হারে করারোপের প্রস্তাব আসতে পারে। একই সঙ্গে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের আয়েও করারোপ করা হতে পারে ১০ শতাংশ হারে। করপোরেট করহার কমানো হলেও ব্যক্তি খাতের সর্বোচ্চ করহার ২৫ থেকে বাড়িয়ে ৩০ শতাংশ করা হতে পারে। করের আওতা বাড়াতে উৎসে করে বেশকিছু পরিবর্তন আনা হচ্ছে আগামী বাজেটে। এ ক্ষেত্রে হোটেল-মোটেল থেকে শুরু করে রেস্টুরেন্ট, হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের লাইসেন্স নবায়নে রিটার্ন দাখিলের প্রমাণপত্র পেশ করতে হবে। আর কমিউনিটি সেন্টার বা কমিউনিটি হল ভাড়া নিতে গেলেও দেখাতে হবে রিটার্ন দাখিলের প্রমাণপত্র। আর ব্যবসার স্থানে রিটার্ন দাখিলের প্রমাণপত্র দেখাতে ব্যর্থ হলে ব্যবসায়ীকে গুনতে হবে ২০ থেকে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা। কোনো সেলুলার ফোন উৎপাদনকারীর পরিশোধিত আয় বণ্টন, লাইসেন্স ফি বা অন্য কোনো ফি বা চার্জ হতে আসা আয়ের ওপর কর বাড়ানোর প্রস্তাব করা হতে পারে। ইটভাটা মালিকদের লাইসেন্স নবায়নেও দিতে হবে বাড়তি কর।
সূত্র আরও জানায়, আগামী অর্থবছরের বাজেটে কর আদায় বাড়াতে করপোরেট করহার কমিয়ে শর্ত জুড়ে দেওয়া হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে করপোরেট করহার সাড়ে ২৭ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২৫ শতাংশ করা হলেও ক্যাশলেস হওয়ার শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে প্রত্যেক একক লেনদেনের ক্ষেত্রে ৫ লাখ এবং বার্ষিক ৩৬ লাখ টাকার বেশি লেনদেন ব্যাংকিং চ্যানেলের বাইরে হলে এই করহার কমানোর সুবিধা পাবে না কোনো প্রতিষ্ঠান। গুনতে হবে আগের করপোরেট করহার। এ ছাড়া পুঁজিবাজারের ক্যাপিটাল গেইনেও করারোপের প্রস্তাব করা হতে পারে। সমবায় সমিতির করহার ১৫ থেকে বাড়িয়ে ২০ শতাংশ করার প্রস্তাব করা হতে পারে। আর পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির করহার আড়াই শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব করা হতে পারে। তবে চার ধরনের আয়কে করমুক্ত করার প্রস্তাব করা হতে পারে। এ ক্ষেত্রে উত্তরাধিকার, উইল এবং ট্রাস্ট মূলে পাওয়া সম্পদ করমুক্ত করার প্রস্তাব আসতে পারে। একই সঙ্গে এনজিও ব্যুরো অনুমোদিত ব্যক্তির দান, এতিমখানা, অনাথ আশ্রম ও উপাসনালয়ের গাড়ির অগ্রিম আয়কর অব্যাহতির প্রস্তাব আসতে পারে। এ ছাড়া প্রত্যক্ষ কর ব্যয় বেড়ে যাওয়ার কারণে এক ব্যক্তি কোনো উৎস আয়ের বিপরীতে একবার কর অব্যাহতি পেলে দ্বিতীয়বার আর পাবেন না। বেসরকারি খাতের অর্থনৈতিক অঞ্চলের সুবিধা বাতিলের প্রস্তাব আসতে পারে আগামী বাজেটে।
এ বিষয়ে ডিএসই ব্রোকারেজ অ্যাসোসিয়েশনের (ডিবিএ) সভাপতি সাইফুল ইসলাম কালবেলাকে বলেন, ‘বর্তমান প্রেক্ষাপটে পুঁজিবাজারে মৌলভিত্তির কোম্পানির সংকট রয়েছে। নতুন করে মৌলভিত্তিসম্পন্ন কোম্পানি বাজারে আসছে না। এই পরিস্থিতিতে লিস্টেড ও নন-লিস্টেড কোম্পানির মধ্যে করের ব্যবধান কমানো হলে ভালো কোম্পানি বাজারে আসার আগ্রহ পাবে না। এতে বাধাগ্রস্ত হবে পুঁজিবাজারের বিনিয়োগ। কোথায় ভালো কোম্পানি তালিকাভুক্তির জন্য প্রণোদনা দেওয়ার কথা, সেখানে লিস্টেড কোম্পানির করহার বাড়িয়ে দিয়ে পুঁজিবাজারের বিনিয়োগকে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে।’
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে নতুন করে ইলেকট্রিক কারে বিশেষ সুবিধা দেওয়ার প্রস্তাব করা হতে পারে আগামী বাজেটে। এ ক্ষেত্রে ইলেকট্রিক কারের করভার ৮৯ থেকে কমিয়ে ৫৮ শতাংশ করার প্রস্তাব আসতে পারে। একই সঙ্গে দেশে ইলেকট্রিক কারের বিনিয়োগ উৎসাহিত করা হতে পারে। এ ছাড়া পণ্য আমদানিতে শুল্ক সুবিধা বাতিল করে ক্ষেত্র বিশেষে ১ থেকে ১০ শতাংশ পর্যন্ত শুল্কারোপের প্রস্তাব আসতে পারে। আর শুল্ক আইন-২০২৩ এ শুল্ক কর্মকর্তাদের বিচারিক ক্ষমতা খর্ব করা হচ্ছে। এতে চাইলে কোনো কর্মকর্তা কোনো বিশেষ অভিযানে গিয়ে কাউকে আটক বা জরিমানা করতে পারবেন না। এ ক্ষেত্রে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নিয়ে অভিযান পরিচালনা করতে হবে। এতে চোরাচালান প্রতিরোধ কার্যক্রমের গতি শ্লথ হবে বলেও মনে করেন শুল্ক কর্মকর্তারা। তবে আগামী বাজেটে নতুন আইন বাস্তবায়ন না হলেও বেশকিছু পরিবর্তন আনা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে শুল্ক খাতের বকেয়া আদায়ে গতি আনতে নতুন করে জরিমানার বিধান যুক্ত করা হচ্ছে। কোনো আমদানিকারককে বকেয়া জানানোর দিন থেকে ১০ দিনের মধ্যে শুল্ক পরিশোধ না করলে তাকে জরিমানা গুনতে হবে। এ ক্ষেত্রে জরিমানার পরিমাণ হবে বার্ষিক ১০ শতাংশ। বর্তমানে বিভিন্ন কাস্টম হাউসে কমিশনাররা নিজেদের মতো পণ্য খালাসের ক্ষেত্র বিশেষে গ্যারান্টি হিসেবে অঙ্গীকারনামা নিতেন। কেউ কেউ ব্যাংক গ্যারান্টি নিতেন। আগামী অর্থবছর থেকে একই ধরনের উদ্যোগ নিতে হবে। আর আমদানি করা পণ্য দেশে আসার পর কোনো সংস্থা দ্বারা লক বা আটক করার পর আইজিএম সংশোধনের সুযোগ আর থাকবে না। এ ক্ষেত্রে মিথ্যা ঘোষণা কমার পাশাপাশি শুল্ক আদায় আরও বাড়বে বলেও মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।