

নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলার বিচ্ছিন্ন চরআতাউর। এ চরে দুটি গুচ্ছগ্রাম ও একটি ব্যারাক হাউসে প্রায় ৪০০ মানুষের বসবাস। বিশাল সমুদ্রের পাশে থেকে এ চরের মানুষ আজ পানির জন্য হাহাকার করছে। সুপেয় পানির তীব্র সংকটে পড়েছেন সেখানকার বাসিন্দারা।
পুকুর শুকিয়ে গেছে। গভীর নলকূপগুলোও বিকল হয়ে গেছে। তাই ঘরের সামনে মাটিতে গর্ত খুঁড়ে সেখানে জমে থাকা সামান্য ঘোলা পানি ব্যবহার করছেন তারা। একই পানিতে থালাবাসন ধোয়া, কাপড় কাঁচা, গোসল করা, এমনকি রান্নার কাজেও কখনো ব্যবহার করতে হয়। সেই পানি পান করে তাদের গৃহপালিত পশু পাখিরাও বেঁচে থাকার চেষ্টা করছে।
জানা গেছে, হাতিয়ার চরআতাউরে সরকারিভাবে দুটি বড় পুকুর খনন করা হয়। অস্বাভাবিক জোয়ারে পুকুরের পাড় ভেঙে পানি ডুকে পড়ে। তাতে পলি জমে জমে পুকুরগুলো সমতলের মতো হয়ে যায়। এখন আর পানি জমে না এই পুকুরগুলোতে। এছাড়া এসব বাসিন্দাদের জন্য ৪টি গভীর নলকুপ স্থাপন করা হয়। এর মধ্যে ৩টি অনেক আগে বিকল হয়। এর মধ্যে একটি আছে কোনোমতে খাওয়ার পানি সংগ্রহ করা যায়। কিন্তু দৈনন্দিন ব্যবহারের জন্য মানুষজনকে নদীর লোনা পানিসহ বিকল্প উৎস খুঁজতে হয়।
সরেজমিনে তরুবীতি গুচ্ছ গ্রামের গিয়ে দেখা গেছে, মধ্য বয়সী এক গৃহিণী ঘরের সামনে একটি গর্তের মধ্যে স্বাভাবিকভাবে জমে যাওয়া গোলা পানিতে ঘরের আসবাবপত্র পরিষ্কার করছেন। অল্প পানিতে থালাবাসন ভালোভাবে পরিষ্কার হয় কি না প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, কিছুই করার নেই। নদীর লোনা পানির চেয়ে অনেক ভালো গর্তের এ পানি। লোনা পানি ব্যবহারে শরীরে এলার্জিসহ নানা রোগ দেখা দিয়েছে। এজন্য ঘরের সামনে পুকুরের মধ্যে গর্ত তৈরি করে নিয়েছেন। তাতে দৈনন্দিন ব্যবহার, গোসল, রান্নার কাজে ব্যবহার সহ বিভিন্ন প্রয়োজনীয়তা মিটাতে হয়।
অজিফা নামের এ গৃহিণী আরও বলেন, ৭ বছর আগে এখানে বসবাস শুরু করি। তরুবীথি ও ছায়াবীথি নামে এই দুটি গুচ্ছ গ্রামে দুই শতাধিক লোকের বসবাস ছিল। সবার জন্য ৪টি গভীর নলকূপ স্থাপন করা হয়। কিন্তু বিভিন্ন সময় ৩টি একেবারে বিকল হয়ে গেছে, এখন একটি নলকূপে কোনোমতে খাওয়ার পানি সংগ্রহ করা যায়। তাও মাঝে মধ্যে বিকল হয়ে থাকে।
আফিয়া নামের আরও একজন বলেন, একটি মাত্র পানির কল আছে। তাতে সবাই গোসল ও পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার কাজ করলে অল্প সময়ের মধ্যে তা একেবারে বিকল হয়ে যাবে। এজন্য ঘরের সামনে পুকুরের মধ্যে গর্ত করে নিয়েছেন। তাতেই পারিবারিক পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার কাজ করছেন। মাঝে মধ্যে হাঁটু সমান এই পানিতে গোসল পর্যন্ত করতে হয়।
গুচ্ছ গ্রামের উত্তর পাড়ে বসবাস করেন লিপি রানী দাস নামে একজন। পেশায় জেলে হলেও চরে থেকে ৭-৮টি গরু পালন করেন। তিনি বলেন, নদীতে এখন লোনা পানি। গরু ছাগল এ পানি পান করতে পারে না। এজন্য মিষ্টি পানির প্রয়োজন হয়। পুকুরে পানি নেই। উপায় না পেয়ে ঘরের পাশে গর্ত করে নিয়েছেন। তাতে জমে থাকা পানি নিজেরা ও ব্যবহার করেন। আবার গরু ছাগলও পান করে।
তিনি আরও বলেন, এখন শীত মৌসুম শুরু হয়েছে। বৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা নেই। কিছুদিন পর গর্তের পানি শুকিয়ে যাবে। তখন গরু ছাগল ও নিজেকে প্রয়োজন মেটানো অনেক কঠিন হবে।
চরআতাউরে প্রথম থেকে বসবাস করে আসছেন খোকন মাঝি। তিনি বলেন, সরকার ভূমিহীনের বসবাসের জন্য এ চরে দুটি গুচ্ছগ্রাম ও একটি ব্যারাক হাউস তৈরি করেছেন। ব্যারাক হাউসে কোনো পুকুর না থাকলেও গুচ্ছগ্রাম দুটিতে বিশাল দুটি পুকুর খনন করা হয়। সেই পুকুর গুলো এই চরে বসবাস করা ৪০০ পরিবার ও দুই সহস্রাধিক গরু মহিষের জন্য যথেষ্ট ছিল। কিন্তু চার বছর আগে জোয়ারের স্রোতে পাড় ভেঙে পুকুরগুলো সমতল হয়ে গেছে। নলকূপও বিকল হয়ে যায়। মিষ্টি পানির জন্য চরে এক ধরনের হাহাকার পড়ে গেছে।
তিনি আরও বলেন, নদীর লোনা পানি ব্যবহারে মানুষের মধ্যে চর্ম রোগ দেখা দিয়েছে। সরকারিভাবে এখানে মানুষের বসবাস এর ব্যবস্থা করা হলেও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
হাতিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আলাউদ্দিন বলেন, হাতিয়ার মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন চরআতাউরে বসবাস করা ভূমিহীনদের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে আমরা কাজ করছি। তাদের মাঝে শীতবস্ত্র বিতরণ করা হয়েছে। সেখানে মিষ্টি পানির সংকট আছে। আমরা ইতোমধ্যে সেখানে নতুন একটি পুকুর খনন করার জন্য চিন্তা করতেছি। এছাড়া আগের পুকুরগুলো পুনরায় খনন করার বিষয়ে আমরা পরিকল্পনা গ্রহণ করেছি।
মন্তব্য করুন