সারা বছর ধরে সরকার যত টাকা ব্যয় করে, তাকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়। এর একটি হলো পরিচালন ব্যয়। আরেকটি উন্নয়ন ব্যয়। মনে করি, বাংলাদেশে আগামী এক বছর (এ ক্ষেত্রে অর্থবছর) এ দুই রকম কাজ চালাতে মোট লাগবে ১০০ টাকা। তবে সব ঠিক থাকলে কর খাতে সরকারের আয় হতে পারে সর্বোচ্চ ৬২ টাকা। বিভিন্ন ফি, টোল, জরিমানা, সুদসহ বাকি সব কর্মকাণ্ড থেকে আয় হবে ৬ টাকা। এ দুই উৎসের হিসাব পুরোপুরি মিললেও আরও দরকার হবে ৩২ টাকা। সেজন্যও আছে সরকারের পরিকল্পনা। ব্যাংকসহ নানা মাধ্যমে দেশের মানুষের কাছ থেকে ঋণ নেওয়া হবে ২০ টাকা। আর বিদেশিদের কাছ থেকে পাওয়া যেতে পারে বাকি প্রায় ১২ টাকা। তার মধ্যে ৫০ পয়সার মতো অনুদান আসবে, যা কখনোই ফেরত দিতে হবে না। আর ১১ টাকা ৪০ পয়সা ঋণ দেবে দাতারা।
এটাই হলো আগামী (২০২৪-২৫) অর্থবছরের জন্য অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীর প্রস্তাবিত বাজেটের আয় পরিকল্পনা। নতুন বাজেটের মোট আকার ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা, যা চলতি (২০২৩-২৪) অর্থবছরের তুলনায় বাজেটের মাত্র ৪ দশমিক ৬ শতাংশ বেশি। অথচ গত পাঁচটি অর্থবছরে বাজেটের আকার আগেরটির তুলনায় অন্তত ১১ শতাংশ বেশি ছিল।
আবার বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী আশা করেছেন, আগামী অর্থবছরে সাড়ে ৬ শতাংশে নামবে মূল্যস্ফীতি। সেটা ঠিক হলেও বাজেটের প্রকৃত আকার প্রায় ২ শতাংশ কমে যাচ্ছে। আর বর্তমান প্রবণতা অনুযায়ী মূল্যস্ফীতি পৌনে ৯ শতাংশের ওপরে থাকলে সরকারের প্রকৃত ব্যয় (বাজেট) অন্তত ৫ শতাংশ কমে যাচ্ছে।
বরাবরের মতো এবারের বাজেটেরও বড় অংশ ব্যয় হবে পরিচালন (বেতন-ভাতা-পেনশন, সুদ, সরকারি অফিসের নিয়মিত কেনাকাটা, ভর্তুকি ইত্যাদি) খাতে, যার পরিমাণ ৫ লাখ ৬ হাজার ৯৭১ কোটি টাকা। আর সরকারের রাজস্ব আয় ধরা হয়েছে ৫ লাখ ৪১ হাজার কোটি টাকা। তার মানে, পরিচালন ব্যয় মিটিয়ে উন্নয়ন কাজের জন্য সরকারের কাছে উদ্বৃত্ত থাকবে মাত্র ৩৪ হাজার কোটি টাকা। অথচ এবার বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আকারই ২ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা। এর উন্নয়ন ব্যয় আছে আরও ১৬ হাজার ৪৫৩ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে এ খাতে লাগবে ২ লাখ ৮১ হাজার ৪৫৩ কোটি টাকা। তার মানে হচ্ছে, ২ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকার ঘাটতি পূরণে সফলতার ওপর নির্ভর করছে, বিশাল আকারের উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হবে কিনা?
শুধু আয়-ব্যয়ের হিসাব নয়, প্রস্তাবিত বাজেটের নানা ক্ষেত্রে সাধ ও সাধ্যের এই ফারাক স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
অর্থমন্ত্রী তার বাজেট বক্তৃতায় আগামী অর্থবছরে অর্থনীতির পাঁচটি চ্যালেঞ্জ তুলে ধরেছেন। সেগুলো হলো—মূল্যস্ফীতি, বৈশ্বিক আর্থিক বাজারে উচ্চ সুদের হার, টাকার অবমূল্যায়ন, জলবায়ু পরিবর্তন ও মানবসম্পদ উন্নয়ন। তবে এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সার্বিক পরিকল্পনা বাজেট বক্তৃতায় উঠে আসেনি। যেটুকুই বা এসেছে, তাও গতানুগতিক।
যেমন মূল্যস্ফীতিকে প্রধান চ্যালেঞ্জ ঘোষণা করে চাহিদার রাশ টেনে ধরা ও সরবরাহ বৃদ্ধির মাধ্যমে তা নিয়ন্ত্রণের কথা বলেছেন অর্থমন্ত্রী। আগের দুটি বাজেটেও এমন পদক্ষেপের কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু বাজার নিয়ন্ত্রণে তা কোনো ভূমিকা রাখতে পারেনি। একই সঙ্গে এবার বাজেট ঘাটতি হ্রাস ও সরকারি ব্যয়ে কৃচ্ছ্রসাধনের ধারা অব্যাহত রাখার কথা বলা হয়েছে। আবার এই ধারা বেশিদিন চললে প্রবৃদ্ধির গতি শ্লথ হবে বলেও আশঙ্কা করা হয়েছে। এ কারণে আগামী অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে সরকারি ব্যয় ধীরে ধীরে বাড়ানো হবে। সেটা আবার রাজস্ব আয় কতটা বাড়ানো যাচ্ছে, তার ওপর নির্ভর করবে। আয় বাড়াতে কর অব্যাহতি তুলে নেওয়ার কথা বলেছেন অর্থমন্ত্রী। কিন্তু বিভিন্ন খাতের কর অব্যাহতি তুলে নেওয়া হলে হয় সেসব খাতের গতি কমে যাবে, না হয় বাজারে পণ্যের মূল্য বেড়ে যাবে।
এসব করেও রাজস্ব আয় যেটুকু বাড়ানো যাবে, তাতে আড়াই লাখ কোটি টাকার ঘাটতি পূরণের সম্ভাবনা নেই। তাই বাজেট বাস্তবায়নে সরকারকে ঋণের ওপরই নির্ভর করতে হবে। সেক্ষেত্রে বাজেটের ২০ শতাংশ আসবে অভ্যন্তরীণ খাত থেকে। আগামী এক বছরে শুধু ব্যাংক খাত থেকে ১ লাখ ৩৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার পরিকল্পনা করেছেন অর্থমন্ত্রী। পরিকল্পনা মতো রাজস্ব আদায় না হলে ঋণের অঙ্ক আরও বাড়বে। এর ফলে ব্যাংকে তারল্য সংকট তৈরি হবে। আর বেসরকারি খাতে বিনিয়োগের সুযোগ কমে যায়। এর সরাসরি প্রভাব পড়বে উৎপাদন ও কর্মসংস্থানে।
প্রস্তাবিত বাজেটে বৈদেশিক উৎস থেকে নিট ৯০ হাজার ৭০০ কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার পরিকল্পনা করা হয়েছে। চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে এই অঙ্ক ৭৬ হাজার ২৯৩ কোটি টাকা। অর্থাৎ আগামী অর্থবছরে বিদেশি ঋণ-নির্ভরতা বাড়ছে ১৪ হাজার ৪০৭ কোটি টাকা। তবে অতিরিক্ত এই ঋণ পেতে হলে সরকারকে যে ঋণদাতা সংস্থাগুলোর আরও শর্ত পূরণ করতে হবে, তা না বললেও চলে। তার অর্থ হলো, আগামীতে জ্বালানি তেল, বিদ্যুৎ ও সারের দাম এবং করের আওতা আরও বাড়বে। এতে মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি অব্যাহত থাকবে। সার্বিকভাবে এই পরিস্থিতি দেশে বিনিয়োগের প্রতিকূল পরিস্থিতিকে আরও বাড়িয়ে তুলবে। আর বিনিয়োগ ও উৎপাদনের গতি বাড়াতে না পারলে স্বাভাবিকভাবেই কমবে জিডিপি প্রবৃদ্ধি।
এমনিতেই প্রস্তাবিত বাজেটের প্রক্ষেপণ অনুযায়ী বাংলাদেশ কম প্রবৃদ্ধি এবং উচ্চ মূল্যস্ফীতির অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির মুখে পড়তে যাচ্ছে। ফলে সাধ ও সাধ্যের দুস্তর ব্যবধান রেখে প্রণীত এই বাজেট নানা দিক থেকেই প্রবল ঝুঁকিপূর্ণ বলা যেতে পারে।