বর্তমানে ব্যাংকিং খাতে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি বিরাজ করছে। এমন বাস্তবতায় ব্যাংক খাতে ব্যাপক সংস্কারের প্রয়োজনীয়তার কথা জানিয়েছিলেন অর্থনীতিবিদরা। কিন্তু বৃহস্পতিবার সংসদে অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী যে বাজেট বক্তৃতা উপস্থাপন করেছেন, তাতে ব্যাংকিং খাতের সংস্কার বিষয়ে তেমন কোনো কিছু উল্লেখ নেই, যাকে হতাশাজনক বলছেন অর্থনীতিবিদরা।
একদিকে উচ্চ মূল্যস্ফীতি এবং আস্থাহীনতার কারণে ব্যাংকে আমানত বাড়ছে না, অন্যদিকে সুদহার বাজারভিত্তিক করায় বাড়ছে ঋণের সুদহার। ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের একের পর এক রেকর্ড হচ্ছে। ডলারের দাম বাড়ার পরও ডলার এবং রিজার্ভ সংকট কাটছে না। এরই মধ্যে ১০টি দুর্বল ব্যাংক চিহ্নিত করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর। সে অনুযায়ী ব্যাংক মার্জারের উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সেই উদ্যোগের ফলে ব্যাংকের আমানতকারীদের মধ্যে আস্থাহীনতা আরও বাড়ছে। তারা ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নিচ্ছে। অন্যদিকে সঠিক পদ্ধতির মাধ্যমে মার্জারের উদ্যোগ না নিয়ে জোরপূর্বক মার্জারের উদ্যোগ নেওয়ায় থমকে পড়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের সে উদ্যোগ।
এমন প্রেক্ষাপটে ২১০ পৃষ্ঠার বাজেট বক্তৃতায় ব্যাংকিং খাতে শৃঙ্খলা ফেরাতে কোনো পদক্ষেপের কথা উল্লেখ না থাকায় হতাশ হয়েছেন অর্থনীতিবিদরা। অর্থনীতিবিদ ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম বলেন, বাজেট বক্তৃতায় ব্যাংক খাতের সংস্কার নিয়ে কোনো সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থা নেই, যা মোটেও ঠিক হয়নি। এটি খুবই হতাশাজনক। তবে আশা করছি, সংসদের আলোচনায় বিষয়টি উঠে আসবে। ব্যাংক খাত সংস্কারে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে। তাই এ বিষয়ে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। তা না হলে খেলাপি ঋণ আরও বাড়বে।
একই বিষয়ে অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান নুরুল আমিন কালবেলাকে বলেন, অর্থমন্ত্রী যে এগারোটি সংস্কারের কথা বলেছেন, সেখানে ব্যাংক খাতের কথা রয়েছে। তবে আমরা আশা করেছিলাম আরেকটু বিস্তারিত দিকনির্দেশনা থাকবে, যেখানে সুশাসন, ব্যাংক একীভূতকরণ, অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি গঠনসহ আরও কিছু বিষয়ে বিস্তারিত দিকনির্দেশনা থাকবে। কিন্তু ডিজিটাল ব্যাংক আর ব্যাংক খাত থেকে ঋণ নেওয়া ছাড়া বাজেট বক্তব্যে তেমন কোনো আলোচনা নেই। এ বিষয়গুলোর আরেকটু বিস্তারিত ও কী কী পদক্ষেপ নেওয়া হবে সে কথা আরও স্পষ্টভাবে বর্ণনা থাকার দরকার ছিল।
বাজেট বক্তৃতায় আর্থিক খাতের সংস্কার এবং আর্থিক অন্তর্ভুক্তিবিষয়ক অধ্যায়ে অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী বলেছেন, আর্থিক খাতের স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে এবং টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে আর্থিক খাতকে আরও গভীরভাবে দেশের তৃণমূলের সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে এরই মধ্যে বেশ কিছু সংস্কার কার্যক্রম সম্পন্ন করা হয়েছে। লেনদেন ব্যবস্থার স্বচ্ছতা বৃদ্ধির পাশাপাশি লেনদেনবিষয়ক সব তথ্য সহজে ও নির্ভুলভাবে সংগ্রহ এবং সংরক্ষণ নিশ্চিত করতে এ ব্যবস্থাকে ডিজিটালাইজড ও ক্যাশলেস করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের অগ্রযাত্রায় দেশের আর্থিক লেনদেন সহজ ও সাশ্রয়ী করার লক্ষ্যে ইন্টার অপারেবল ডিজিটাল ট্রানজেকশন প্ল্যাটফরম ‘বিনিময়’ চালু করা হয়েছে। এ ছাড়া আর্থিক ব্যবস্থার সম্ভাব্য ঝুঁকি ও দুর্বলতা চিহ্নিত করতে ফাইন্যান্সিয়াল প্রজেকশন মডেল (এফপিএম) বাস্তবায়ন করা হয়েছে। ব্যাংকিং খাতে শৃঙ্খলা ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে গত জুনে ‘ব্যাংক কোম্পানি (সংশোধন) আইন ২০২৩’ অনুমোদিত হয়। ‘ব্যাংক আমানত বীমা আইন-২০০০’ সংশোধনপূর্বক ‘আমানত সুরক্ষা আইন-২০২৩’ প্রণীত হয়েছে। অর্থপাচার ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধে সুইস ব্যাংকসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পাচারকৃত অর্থ বা সম্পদ উদ্ধারের কৌশল নির্ধারণ সংক্রান্ত প্রতিবেদন এবং ‘পাচারকৃত অর্থ উদ্ধার: আইনি কাঠামো ও কৌশলগত প্রক্রিয়া’ শীর্ষক গাইডলাইন অনুমোদিত হয়েছে।
বাংলাদেশ সরকারের ঘোষিত ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ বিনির্মাণের লক্ষ্যে বিশ্বব্যাপী প্রচলিত তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর ডিজিটাল ব্যাংকিং সেবা জনগণের কাছে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে দুটি ডিজিটাল ব্যাংকের অনুকূলে লেটার অব ইনটেন্ট দেওয়া হয়েছে, যা পরবর্তী সময়ে আরও বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে। ডিজিটাল ব্যাংক থেকে ঋণ বিতরণের লক্ষ্যে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ও মেশিন লার্নিং প্রযুক্তি প্রয়োগ করে ক্রেডিট স্কোরিং সিস্টেম চালু করা হবে। এর ফলে খুব সহজে ভুয়া ও বেনামি ঋণগ্রহীতাকে শনাক্ত করা সম্ভব হবে এবং প্রকৃত ঋণগ্রহীতাদের জন্য ঋণ গ্রহণ প্রক্রিয়া অনেক সহজ হবে।