এক দশক ধরে নানা সূচকে ভালো সময় পার করেছে দেশের অর্থনীতি। তার মধ্যেও প্রায় স্থবির হয়ে ছিল বেসরকারি বিনিয়োগ পরিস্থিতি। শুরু থেকেই অর্থনীতিবিদরা সতর্ক করেছিলেন, বিনিয়োগ বাড়াতে না পারলে উৎপাদন ও কর্মসংস্থান ব্যাহত হবে। এতে প্রবৃদ্ধির ঊর্ধ্বগতি থমকে যেতে পারে।
নানাভাবে চেষ্টা করেও বিনিয়োগ বাড়াতে না পারায় শেষ পর্যন্ত বাস্তব রূপ নিচ্ছে সেই আশঙ্কা। এরই মধ্যে দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) মন্থর হয়ে পড়েছে। গত অর্থবছরের মতো এবারও ৬ শতাংশের নিচে রয়ে যাচ্ছে প্রবৃদ্ধি। সেখান থেকে আগামী (২০২৪-২৫) অর্থবছরে এই হার ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশে উন্নীত হবে বাজেট বক্তৃতায় আশা করেছেন অর্থমন্ত্রী।
অন্যদিকে সরকার চলতি (২০২৩-২৪) অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশের মধ্যে সীমিত রাখার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিল; কিন্তু নানা পদক্ষেপেও থামানো যাচ্ছে না মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি। টানা ১৫ মাস ধরে সাড়ে ৯ শতাংশের আশপাশে ঘুরছে সার্বিক মূল্যস্ফীতি। তার মানে, দেশে এখন স্বল্প প্রবৃদ্ধি ও উচ্চ মূল্যস্ফীতির ধারা চলছে। অচিরেই এ পরিস্থিতি থেকে বেরোতে না পারলে অর্থনীতি ‘মন্দাস্ফীতি’র (স্ট্যাগফ্লেশান) দীর্ঘস্থায়ী ফাঁদে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা অর্থনীতিবিদদের।
বিশ্লেষকদের মতে, ২০১০ সালের পর থেকে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে উচ্চ প্রবৃদ্ধির ধারা তৈরি হয়েছিল। তখন থেকে টানা ৯ বছর প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৬ শতাংশের বেশি। রপ্তানি ও রেমিট্যান্সের ঊর্ধ্বগতির ফলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৪ হাজার ৮০০ কোটি ডলার ছাড়িয়েছিল। দুই অঙ্কে শুরু হওয়া মূল্যস্ফীতি এক পর্যায়ে সাড়ে ৫ শতাংশের নিচে নেমেছিল। ডলারের বিপরীতে টাকার অবস্থান ছিল সুসংহত। লক্ষ্যমাত্রা ছোঁয়া না গেলেও রাজস্ব আয়ের প্রবৃদ্ধি ছিল ঊর্ধ্বমুখী। বাজেট ঘাটতি মেটাতে সরকারের নেওয়া ঋণ জিডিপির তুলনায় সহনীয় ছিল। বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্যও স্বস্তিদায়ক ছিল।
এত কিছুর মধ্যেও দেশে বেসরকারি বিনিয়োগ পরিস্থিতি ছিল নাজুক। দেশি-বিদেশি দুই উৎসের বিনিয়োগে এখনো সেই স্থবিরতা অব্যাহত রয়েছে। গত এক দশক ধরে মোট বিনিয়োগ জিডিপির ৩১ থেকে ৩২ শতাংশের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। এর মধ্যে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ ২৪ শতাংশের কাছাকাছি আটকে আছে। অথচ সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় এ হার ২৮ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছিল; কিন্তু অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০২৪-এর তথ্য অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরে বেসরকারি বিনিয়োগ হয়েছে জিডিপির ২৪ দশমিক ১৮ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে (২০২৩-২৪) তা আরও কমে ২৩ দশমিক ৫১ শতাংশে দাঁড়াবে।
দেশে বিনিয়োগের এই খরার পাশাপাশি করোনা মহামারির প্রভাব, বিশ্ব অর্থনীতিতে অস্থিরতাসহ নানা কারণে কাঙ্ক্ষিত হারে উৎপাদন বাড়ছে না, যার প্রভাব পড়েছে জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ ৭ দশমিক ৮৮ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়। করোনার ধাক্কায় পরের বছরই প্রবৃদ্ধির ৩ দশমিক ৪৫ শতাংশে নেমে আসে। মহামারির পর ২০২১-২২ অর্থবছরে ৭ দশমিক ১০ হারে প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়। তবে উৎপাদন গতিশীল করতে না পারায় এরপর থেকেই নিম্নগামী হয়েছে প্রবৃদ্ধি। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৫ দশমিক ৭৮ শতাংশের পর চলতি অর্থবছরে ৫ দশমিক ৮২ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি অর্জিত হবে বলে জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। যদিও বাজেট ঘোষণার সময় লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছিল সাড়ে ৭ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি। অন্যদিকে অর্থমন্ত্রীর আশা, আগামী অর্থবছরে ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি অর্জিত হবে। তবে বিনিয়োগসহ সার্বিক পরিস্থিতির বড় কোনো পরিবর্তন না হলে প্রবৃদ্ধির এই লক্ষ্য অর্জন করা কঠিন হবে বলে অর্থনীতিবিদরা মনে করেন।
অন্যদিকে দুবছরেরও বেশি সময় ধরে চলছে উচ্চ মূল্যস্ফীতি। এ সময় বৈশ্বিক পরিস্থিতি অনেকটা বদলালেও বাংলাদেশে তা সম্ভব হয়নি। গত এপ্রিলে প্রকাশিত আইএমএফের ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, উন্নত দেশগুলোর গড় মূল্যস্ফীতি ২০২২ সালে ৭ দশমিক ২৮-এ উঠে যায়। তবে দ্রুতই তা নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। এসব দেশে ২০২৪ সালে গড় মূল্যস্ফীতি ২ দশমিক ৬২ শতাংশে দাঁড়াবে বলে প্রক্ষেপণ করা হয়েছে। উন্নয়নশীল ও বিকাশমান অর্থনীতির দেশগুলোর মূল্যস্ফীতিও অনেকটাই নিম্নমুখী। ২০২২ সালে এসব দেশের গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৮ শতাংশ। সেখান থেকে চলতি বছর ৮ দশমিক ৩ এবং ২০২৫ সালে ৬ দশমিক ২ শতাংশে নেমে আসবে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে।
অথচ বাংলাদেশে গত ১৫ মাস ধরে মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের ওপরে রয়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য বলছে, ২০১০-১১ অর্থবছরে দেশে সর্বোচ্চ ১০ দশমিক ৯২ শতাংশ হারে মূল্যস্ফীতি হয়েছিল। এরপর ধারাবাহিকভাবে কমে ২০২০-২১ অর্থবছরে সাড়ে ৫ শতাংশে নেমে আসে। পরের বছর থেকে আবার বাড়তে থাকে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে বার্ষিক গড় মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়। চলতি অর্থবছরেও সেই ধারা অব্যাহত রয়েছে। সর্বশেষ মে মাসে এই হার ছিল ৯ দশমিক ৮৯ শতাংশ। এর মধ্যে খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি দুই অঙ্ক ছাড়িয়ে গেছে। আইএমএফ বলছে, চলতি বছর বাংলাদেশে বার্ষিক গড় মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ৪ শতাংশে দাঁড়াবে।
বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী আশা করেছেন, আগামী অর্থবছরে সাড়ে ৬ শতাংশে নামবে মূল্যস্ফীতি। তবে বর্তমান প্রেক্ষাপট এবং বাজেটে যেসব পদক্ষেপের কথা বলা হয়েছে, তাতে এই লক্ষ্য অর্জন কোনোভাবেই সম্ভব নয় বলে অর্থনীতিবিদরা মনে করেন। আর তেমনটা হলে আগামী অর্থ বছরেও জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার মূল্যস্ফীতির চেয়ে কমই থাকবে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বিশ্বের অনেক দেশের অর্থনীতিতেই এখন উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও স্বল্প প্রবৃদ্ধির বিরাজ করছে। অর্থনীতির পরিভাষায় এই অবস্থাকে স্ট্যাগফ্লেশন (মন্দাস্ফীতি) বলা হয়। এ ধরনের পরিস্থিতি দীর্ঘায়িত হলে অর্থনীতি অস্বাভাবিক মন্থর হয়ে পড়তে পারে। এতে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ স্তিমিত হয়ে পড়তে পারে। আর এর ফল হিসেবে উৎপাদন ও কর্মসংস্থানের সুযোগ সংকোচিত হয়ে দারিদ্র্য বিমোচন কার্যক্রমে মারাত্মক প্রভাব ফেলতে পারে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বাংলাদেশের অর্থনীতিকে তেমন পরিস্থিতি থেকে রক্ষার জন্য উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। তবে নতুন বাজেটে অর্থমন্ত্রী এক্ষেত্রে আশাবাদী হওয়ার মতো কোনো পরিকল্পনা দিতে পারেননি। এবারও চাহিদার রাশ টেনে ধরা ও সরবরাহ বৃদ্ধির মাধ্যমে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে চান তিনি। তবে আগের দুটি বাজেটেও একই পদক্ষেপের কথা বলা হলেও শেষ পর্যন্ত তার ফল মেলেনি। বাজারে মুদ্রা সরবরাহ কমানোর পাশাপাশি পণ্য আমদানিতে নানা সুবিধা দেওয়া হলেও বাজারে তার ইতিবাচক প্রভাব পড়েনি। তার ওপর আইএমএফের চাপে সরকারের রাজস্ব আয় বাড়াতে বিভিন্ন পণ্যের কর অব্যাহতি তুলে দেওয়া এবং জ্বালানি তেল, গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি মূল্যস্ফীতিকে আরও উসকে দিতে পারে।
বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম কালবেলাকে বলেন, ‘ভারত ও শ্রীলঙ্কা মূল্যস্ফীতির হারকে ৫ শতাংশে নামিয়ে এনেছে। আমরা সেটা করতে পারিনি। দেশে মূল্যস্ফীতি সাধারণ মানুষের জীবন ও জীবিকাকে মারাত্মকভাবে পর্যুদস্ত করছে। এবারের বাজেটে মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৬ শতাংশে নামিয়ে আনার যে লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে, তা অর্জন করা কঠিন চ্যালেঞ্জ। যদি এতে সাফল্য অর্জিত হয়, সেটা প্রশংসনীয় হবে; কিন্তু এটা করা যাবে কি না, তা এ মুহূর্তে একেবারে সঠিকভাবে বলা যাচ্ছে না। তবে উদ্দেশ্য হিসেবে এটা গ্রহণযোগ্য। এ জন্য এবারের বাজেটকে সংকোচনমূলক করা হয়েছে।’
তবে গতকাল শুক্রবার বাজেট-পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আশা প্রকাশ করে বলেন, ‘এ বছরের শেষের দিকে মূল্যস্ফীতি কমে আসবে। বাজেটের আকার কমিয়ে রেখেছি যাতে দ্রব্যমূল্যের ওপর কোনো চাপ না পড়ে।’
অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘মূল্যস্ফীতি এখনো ৯ শতাংশের ঘরে রয়েছে। বৈশ্বিক কারণে মুদ্রার ওপর চাপ বাড়ায় টাকার মান কমেছে। মূল্যস্ফীতি বাড়ার জন্য এটা কারণ। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে যে পদক্ষেপ নেওয়া দরকার, নিয়েছি। আরও যেসব পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন আমরা নেব।’
অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য বাজারে টাকার প্রবাহ কমাতে ব্যাংক ঋণের সুদের হার বাড়ানোর পথে হাঁটছে সরকার। ধারণা করা হচ্ছে, এতে মানুষের হাতে নগদ টাকার পরিমাণ ও খরচ করার প্রবণতা কমবে। তবে এ ধরনের পদক্ষেপের কোনো প্রভাব বাজারে দেখা যাচ্ছে না। উল্টো অতিরিক্ত সুদের কারণে বেসরকারি বিনিয়োগ আরও ব্যাহত হতে পারে। কারণ বিনিয়োগকারীদের জন্য ব্যাংক থেকে ঋণ পাওয়া কঠিন হলে কিংবা বেশি সুদ দিতে হলে তারা নতুন বিনিয়োগে যেতে পারবেন না। আবার বিদ্যমান ব্যবসা সম্প্রসারণও বাধাগ্রস্ত হবে। অতিরিক্ত ব্যয়ের কারণে আমদানিকারকরাও নিরুৎসাহিত হবে। এসব কিছুই জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
এ বিষয়ে অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম বলেন, ‘আগামী বছর জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ হবে বলে যে আশা করা হয়েছে, সেটা অত্যন্ত উচ্চাভিলাষী একটি লক্ষ্য। যদি সেটার কাছাকাছিও পৌঁছায় তাতেও অর্থনীতিতে সুবাতাস বইবে। তবে মূল্যস্ফীতিকে কমিয়ে আনার জন্য যে প্রক্রিয়াগুলো নেওয়া হয়েছে, সেটা প্রবৃদ্ধিকে কমিয়ে দেওয়ার একটা আশঙ্কা রয়েছে।’