কেউ ডাক্তারি করছেন, কেউ ডাক্তারি পড়ছেন; কিন্তু তারাই শরীরে নিচ্ছেন ভয়ংকর নেশা প্যাথেড্রিন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ডক্টরস হলে প্রকাশ্যেই চলছে এমন মাদক সেবন। নারী এনে অসামাজিক কার্যকলাপের অভিযোগও রয়েছে কারও কারও বিরুদ্ধে। এসব অপকর্ম ঢাকতে হলের বিভিন্ন স্থানে লাগানো সিসিটিভির সংযোগ খুলে রেখেছেন তারা।
হলের বাথরুম, ছাদসহ একাধিক স্থান ঘুরে দেখেছেন এ প্রতিবেদক। সবখানেই মাদক সেবনের আলামত পাওয়া গেছে। সাততলাবিশিষ্ট ভবনটিতে প্রবেশের সময়ই চোখে পড়ে দেয়ালে লাগানো সিসিটিভি; কিন্তু সিসিটিভির বিদ্যুৎ সংযোগের কেবলটি খুলে রাখা হয়েছে। ওই ভবনে থাকা অন্য সিসিটিভি ক্যামেরাগুলোরও অবস্থা একই। ভবনটির সপ্তম তলায় রয়েছে একটি অফিস কক্ষ। অফিস কক্ষের পাশেই কয়েকটি বাথরুম। সেখানে ঢুকেই দেখা যায় ভেতরে ও বাইরের ভেন্টিলেটরে শত শত ইনজেকশন ও সিরিঞ্জ পড়ে আছে।
হাসপাতালে ইনজেকশন ও সিরিঞ্জ থাকা খুবই স্বাভাবিক বিষয়; কিন্তু ডাক্তার ও মেডিকেল শিক্ষার্থীদের বাথরুমে এত ইনজেকশন ও সিরিঞ্জ কেন—এই কৌতূহল থেকে দেখা যায়, সেগুলো প্যাথেড্রিনের এবং একই জাতীয় গ্রুপের। এই প্যাথেড্রিন রোগীর অস্ত্রোপচারের সময় ব্যবহার করা হলেও এটি ভয়ংকর একটি মাদকও।
বিএসএমএমইউর ডক্টরস হোস্টেলে এত প্যাথেড্রিন কোত্থেকে এলো—জানতে যোগাযোগ করা হয় সেখানকার এক কর্মকর্তার সঙ্গে। পরিচয় গোপন রাখার শর্তে কালবেলাকে তিনি বলেন, ‘হোস্টেলে থাকা কিছু মেডিকেল স্টুডেন্ট প্যাথেড্রিনের নেশায় আসক্ত। এমনকি ওই হোস্টেলে থাকা এমবিবিএস পাস করা কয়েকজন চিকিৎসকও এমন নেশায় আসক্ত।’ তিনি আরও জানান, শুধু বাথরুম নয়, ভবনের ছাদে বসে নিয়মিত মদ, গাঁজা, ফেনসিডিল সেবন করেন শিক্ষার্থীরা।
তার কথার সূত্র ধরে ভবনটির ছাদে গিয়েও একাধিক ফেনসিডিলের খালি বোতল পড়ে থাকতে দেখা গেছে। নিয়মিত মদ্যপানের আলামতও মিলেছে সেখানে।
এসব বিষয় নিয়ে কথা হয় হলের আরও কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারীর সঙ্গে। তারা কেউ ভয়ে মুখ খুলতে চাননি। দু-একজন ফিসফিস করে বলেন, ডক্টর হলে অবৈধভাবে থাকছেন নানা কিসিমের মানুষ। ছাত্রত্ব শেষ হলেও হল ছাড়েননি অনেক চিকিৎসক। বারবার নোটিশ দেওয়ার পরও কাজ হয়নি। তাদের কথার সত্যতা মিলল হলের সাবেক প্রভোস্ট অধ্যাপক ডা. আলী আসগর মোড়লের সঙ্গে কথা বলে। তিনি বলেন, ‘ওখানে কিছু রাজনৈতিক প্রভাব রয়েছে। চাইলেই সবকিছু করা যায় না। আমি যতদিন ছিলাম চেষ্টা করেছি; কিন্তু পুরোপুরি পারিনি। আমি নিচে আনসার মোতায়েনসহ সিসিটিভি ক্যামেরা বসিয়েছিলাম।’
হলের ডাইনিংয়ে অবৈধভাবে একটি দোকানও চলছে বহু বছর ধরে। এর পাশেই নিয়মিত বসে নেশার আসর। এ নিয়ে কথা হয় হলের ৭২২ নম্বর রুমে বসবাসকারী ডা. শুভর সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘নেশা করার কিছু ঘটনার অভিযোগ রয়েছে। বিস্তারিত এখন বলতে পারছি না।’
ডক্টরস হলে নেশাদ্রব্য কীভাবে আসে—জানতে চাইলে কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি হল সুপার আ র ম ওয়ালীউল্লাহ। তার দাবি, নেশার বিষয়টি বর্তমান প্রভোস্টের মাধ্যমে উপাচার্যকে জানানো হয়েছে। তিনি বলেন, ‘তারা ব্যবস্থা না নিলে আমরা কী করতে পারি।’
শুধু মাদক সেবনেই সীমাবদ্ধ নেই তারা। বাইরে থেকে নারী এনে অসামাজিক কার্যকলাপের অভিযোগও উঠেছে। ২০২৩ সালের ২০ জুলাই সন্ধ্যায় হলের ৭১৮ নম্বর কক্ষে এক ছাত্র এক নারীকে রুমে নিয়ে এসেছিলেন। পরে অন্য ছাত্ররা তাদের দেখে রুম আটকে দেন। এরপর পুলিশ এসে তাদের নিয়ে যায়। ওই ঘটনা তদন্তে ২৩ জুলাই একটি কমিটি গঠন করে বিএসএমএমইউ কর্তৃপক্ষ। সেই ঘটনার তদন্ত প্রতিবেদন ও সুপারিশের বিষয়ে কিছু জানা যায়নি। তবে ছাত্র হলে নারীদের প্রবেশ যে বন্ধ হয়নি, সম্প্রতি সরেজমিন গিয়ে তার স্পষ্ট প্রমাণ মিলেছে। দিনদুপুরেই হলের সাততলায় নারীদের প্রবেশ করতে দেখা গেছে।
ডক্টরস হলের দায়িত্ব নেওয়ার পর হলটির সংস্কারসহ নানা রকমের সুপারিশ করেছেন বর্তমান হল প্রভোস্ট অধ্যাপক ডা. এস এম মোস্তফা জামান। তার কাছে এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি কালবেলাকে বলেন, ‘আমরা সুনির্দিষ্ট কিছু বিষয় নোট করে লিখিতভাবে কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি এবং একটি কমিটিও গঠন করা হয়েছে। হলের সংস্কারসহ নানা রকমের প্রস্তাবনা দেওয়া হয়েছে।’
অভিযোগের বিষয়ে জানতে উপাচার্য ডা. দীন মোহাম্মদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। তার ব্যক্তিগত সহকারীর রুমে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করেও দেখা মেলেনি উপাচার্যের। পরে মোবাইল ফোনে একাধিকবার ফোন দিলেও তিনি ধরেননি। এরপর খুদে বার্তা পাঠালেও কোনো উত্তর দেননি।
মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো একটি সংবেদনশীল জায়গায় চিকিৎসকরাই নেশায় জড়িয়ে পড়ছে, বিষয়টি কীভাবে দেখেন—জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ডা. তৌহিদুল হক কালবেলাকে বলেন, ‘মানুষ স্রষ্টার পরে ভরসা করে চিকিৎসকের ওপরে। কারণ চিকিৎসকরাই একজন মানুষের প্রাণ বাঁচাতে পারেন। সেই চিকিৎসকের মধ্যে কেউ নেশাগ্রস্ত হলে সেটা সমাজের জন্য ভয়াবহ সমস্যা। চিকিৎসাসেবার সুযোগ নিয়ে কেউ এ ধরনের মাদক গ্রহণ করলে তাদের কাছে থেকে আমরা কতটা নিরাপদ—সেটাই বড় প্রশ্ন।’
অন্যদিকে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর বলছে, প্যাথেড্রিন একটি ভয়ানক ড্রাগ। অনুমতি ছাড়া এটি উৎপাদন এবং কেনাবেচা পুরোপুরি নিষিদ্ধ ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ। অধিদপ্তরের পরিচালক (গোয়েন্দা ও অপারেশন) তানভীর মমতাজ কালবেলাকে বলেন, “প্যাথেড্রিন একটি ‘ক’ শ্রেণিভুক্ত মাদক। অনুমতি ছাড়া এটি উৎপাদন, কেনাবেচা ও গ্রহণ নিষিদ্ধ। কোনো মেডিকেল স্টুডেন্ট বা চিকিৎসক তাদের পেশার সুযোগ নিয়ে এটি ব্যবহার করলে প্রচলিত মাদক আইনে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
তাদের বিরুদ্ধে প্রচলিত আইনে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানিয়েছেন ঢাকা মহানগর পুলিশের উপকমিশনার (মিডিয়া) মো. ফারুক হোসেনও। তিনি বলেন, ‘সমাজের যে কোনো সেক্টরের মানুষ মাদকে জড়িয়ে গেলে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। চিকিৎসক ও মেডিকেল ছাত্ররাও যদি প্যাথেড্রিন গ্রহণ এবং পুলিশের অভিযানে আটক হন, তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
এদিকে এই প্রতিবেদন নিয়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলার পরই গতকাল সন্ধ্যায় খবর আসে, বিএসএমএমইউর ডক্টরস হলে অভিযান চালিয়ে মাদক সেবন অবস্থায় দুজনকে আটক করা হয়েছে। বিষয়টি নিশ্চিত করে হল প্রভোস্ট অধ্যাপক ডা. এস এম মোস্তফা জামান বলেন, ‘হলের বাথরুম থেকে দুজনকে আটক করা হয়েছে। তারা হলেন শুভ ও আব্দুস সামাদ। তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।’
হলে থাকা চিকিৎসকদের দাবি, আটক দুজনই বহিরাগত। তাদের হাসপাতালের আনসার সদস্যদের কাছে তুলে দেওয়া হয়েছে। বিএসএমএমইউর আনসার কমান্ডার মনির বলেন, তাদের শাহবাগ থানায় হস্তান্তর করা হয়েছে।