হুমায়ূন কবির
প্রকাশ : ০২ মার্চ ২০২৫, ০২:৫৩ এএম
আপডেট : ০২ মার্চ ২০২৫, ০৮:৫৯ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

ইউক্রেনে শান্তি কোন পথে

ইউক্রেনে শান্তি কোন পথে

ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ তিন বছর পেরিয়ে চতুর্থ বছরে পা দিয়েছে গত ২৪ ফেব্রুয়ারি। এত লম্বা সময়ে বিশ্বের ভূরাজনীতি পৌঁছেছে নতুন মাত্রায়। হাজারো প্রাণহানি এবং লাখো মানুষ আহত হয়েছে এ যুদ্ধে। এতকিছুর পরও কবে যুদ্ধ শেষ হবে, মিলছে না সে উত্তর। এদিকে ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছিলেন, তিনি নির্বাচিত হলে এক দিনের মধ্যে এ যুদ্ধ বন্ধ করবেন। তিনি ২০ জানুয়ারি দায়িত্ব গ্রহণ করলেও যুদ্ধ বন্ধের নাম-নিশানাও নেই। এরই মধ্যে ওয়াশিংটন-কিয়েভের সম্পর্ক দিন দিন খারাপ হচ্ছে। সর্ব শেষ শুক্রবার ট্রাম্পের সঙ্গে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় হয়েছে। এতে কূটনৈতিক সম্পর্ক আরও তিক্ত হলো। এখন প্রশ্ন উঠছে, ইউক্রেন যুদ্ধ কোন দিকে মোড় নেবে? সেখানে কীভাবে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে? দুই দেশের সম্পর্কের ভবিষ্যৎ কী? বিস্তারিত জানাচ্ছেন—হুমায়ূন কবির

ইইউ-মার্কিন সম্পর্কের ভবিষ্যৎ

শুক্রবার হোয়াইট হাউসের ওভাল অফিসে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির সঙ্গে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্সের প্রকাশ্য বাদানুবাদের ঘটনা ঘটে।

মূল্যবান খনিজ নিয়ে চুক্তি ও ভবিষ্যৎ রুশ হামলা ঠেকাতে ট্রাম্পের কাছ থেকে নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি আদায়ের লক্ষ্য নিয়ে ওয়াশিংটন সফরে গিয়েছিলেন জেলেনস্কি। কিন্তু রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধ ও মার্কিন সহায়তা নিয়ে উত্তপ্ত বাক্যবিনিময়ের পর কোনো চুক্তি ছাড়াই আকস্মিকভাবে বৈঠকটি শেষ হয়। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি জেলেনস্কি অসম্মান প্রদর্শন করেছেন বলে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন ট্রাম্প ও ভ্যান্স। পরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট তার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বলেছেন, জেলেনস্কি শান্তির জন্য প্রস্তুত নন।

ক্ষমা চাইতে বলেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী রুবিও

মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও এ ঘটনার জন্য জেলেনস্কিকে ক্ষমা চাইতে বলেছেন। সংবাদমাধ্যম সিএনএনকে তিনি বলেন, ‘এভাবে বৈঠক শেষ করে আমাদের সময় নষ্ট করার জন্য (ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টের) ক্ষমা চাওয়া উচিত।’

জেলেনস্কি সত্যিই শান্তি চান কি না—এ নিয়েও সন্দেহ প্রকাশ করেছেন রুবিও। শান্তি প্রচেষ্টাকে অবমূল্যায়ন করার মাধ্যমে জেলেনস্কি এর সঙ্গে যুক্ত সবাইকে নিরাশ করেছেন বলেও উল্লেখ করেছেন তিনি। তবে এ ঘটনায় এখনো ক্ষমা চাননি জেলেনস্কি। ট্রাম্প ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত ফক্স নিউজকে তিনি বলেছেন, ‘খারাপ কিছু করেছি এমনটা আমি নিশ্চিত নই।’ তবে রিপোর্টারদের সামনে এমন বাদানুবাদ তার প্রত্যাশিত ছিল না বলেও জানান।

যুক্তরাষ্ট্রকে নিয়ে মিত্রদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন

আটলান্টিক কাউন্সিল ইউরোপ সেন্টারের সিনিয়র ফেলো রেচেল রিৎজো মনে করেন, মিত্র হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভবিষ্যৎ কেমন হবে, এ বৈঠকের পর ইউরোপীয় নেতাদের তা ভাবাবে। তিনি বলেন, ‘বিশেষ করে গত কয়েক সপ্তাহ ধরে ট্রাম্প প্রশাসনের উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদের ইউরোপ সফরের পর আমি মনে করি আমেরিকান মিত্র এবং অংশীদাররা সত্যিই প্রশ্ন তুলছে যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের কেমন অংশীদার।’ তার মতে, এর ফলে এমন এক পরিস্থিতি তৈরি হবে, যার ফলে মিত্র ও অংশীদাররা যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে তাকাতে শুরু করবেন। এতে বৈশ্বিক স্তরে যুক্তরাষ্ট্র দুর্বল হবে বলেও তিনি অভিমত দেন।

ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের পররাষ্ট্রনীতি প্রধান কায়া কালাস বলেছেন, ‘আজকে এটা পরিষ্কার হয়ে গেছে যে মুক্ত বিশ্বের একজন নতুন নেতার প্রয়োজন। এ চ্যালেঞ্জ নেওয়াটা আমাদের ইউরোপের ওপরে বর্তায়।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমরা ইউক্রেনের প্রতি আমাদের সমর্থন বৃদ্ধি করব, যাতে তারা হামলাকারীদের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যেতে পারে।’

ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁ এক্সে দেওয়া পোস্টে লিখেছেন. ‘একটি আক্রমণকারী: রাশিয়া। আক্রমণের মুখে থাকা একটি জাতি: ইউক্রেন।’ মাখোঁ তার সঙ্গে যোগ করেন, ‘যারা শুরু থেকে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে, তাদের প্রতি সম্মান জানান। কারণ তারা তাদের মর্যাদা, স্বাধীনতা, সন্তান ও ইউরোপের নিরাপত্তার জন্য লড়ছেন।’

ইউক্রেন ও জেলেনস্কির প্রতি সমর্থনের এই দলে আরও যোগ দিয়েছেন ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডেয়ার লায়েন, ইউরোপীয় কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট আন্তোনিও কস্তা, জার্মানির বিদায়ী চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎ, নির্বাচনে জয়ী চ্যান্সেলর ফ্রিডরিশ ম্যার্ৎস, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার, পোলিশ প্রধানমন্ত্রী ডোনাল্ড টুস্ক ও স্প্যানিশ প্রধানমন্ত্রী পেদ্রো সানচেজ।

সম্মেলনের ডাক মেলোনির

ইতালির প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনি এতদিন ইউক্রেনকে সমর্থন দিয়ে গেলেও কট্টর ডানপন্থি রাজনীতিবিদ হিসেবে ট্রাম্পের সঙ্গে তার ভালো সম্পর্ক। তিনি ইউক্রেনসহ বর্তমান বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ নিয়ে পশ্চিমা দেশগুলোর আলোচনার ডাক দিয়েছেন। মেলোনি বলেন, ‘পশ্চিমাদের প্রতিটি বিভাজন আমাদের সবাইকে দুর্বল করবে এবং যারা আমাদের সভ্যতার পতন দেখতে চায়, তাদের সুবিধা দেবে।’

তবে ট্রাম্প ও জেলেনস্কির দূরত্বের কারণে ভবিষ্যতে যুদ্ধ বন্ধে যে কোনো চুক্তিতে পৌঁছানো কঠিন হবে বলে মনে করেন রিৎজিও। এমনকি সমঝোতা প্রক্রিয়ায় ইউরোপ বাদ পড়তে পারে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি। বলেন, ‘ট্রাম্প জেলেনস্কিকে উদ্ধত এবং শান্তির জন্য প্রস্তুত নন বলে মনে করেন, তাই তিনি বাদ পড়বেন। যা ঘটেছে, তা সহজে কাটিয়ে ওঠা যাবে এটা আমার প্রত্যাশা, কিন্তু আমার মনে হয় তা কঠিন হবে।’

ট্রাম্পের পাশে হাঙ্গেরির অরবান

ইউরোপীয় ইউনিয়নের বেশিরভাগ দেশই হোয়াইট হাউসের ঘটনায় জেলেনস্কির পাশে দাঁড়িয়েছেন। তবে হাঙ্গেরির জাতীয়তাবাদী প্রধানমন্ত্রী ভিক্টোর অরবান মার্কিন প্রেসিডেন্টের পক্ষ নিয়েছেন। রাশিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ অরবান আগে থেকেই ট্রাম্পের মিত্র হিসেবে পরিচিত। হোয়াইট হাউসে ট্রাম্প-জেলেনস্কির বিতণ্ডার পর তিনি এক্সে লিখেছেন, ‘প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প আজ সাহসের সঙ্গে শান্তির পক্ষে দাঁড়িয়েছেন। যদিও তা অনেকের পক্ষে হজম করা কঠিন। ধন্যবাদ মি. প্রেসিডেন্ট।’ ট্রাম্পের প্রতি আরবানের সমর্থনের কারণে ইউরোপীয় ইউনিয়নের পক্ষ থেকে ইউক্রেনকে ভবিষ্যতে কিছু সহায়তা দেওয়া নিয়ে সমস্যা তৈরি হতে পারে, বিশেষ করে যেসব ক্ষেত্রে ২৭ দেশের জোটটির সব সদস্যের অনুমোদনের প্রয়োজন পড়ে।

ইউক্রেনে শান্তি কোন পথে

এখন ইউক্রেনে শান্তির জন্য কেবল একটি টেকসই যুদ্ধবিরতি প্রয়োজন। যাতে উভয়পক্ষই জেতে। তবে একতরফা চুক্তি বা এমন চুক্তি নয়, যা ফের যুদ্ধে জড়ানোর সুযোগ দেবে। পাশাপাশি ইউরোপের তাৎক্ষণিক কাজ হলো কেবল ট্রাম্পের সঙ্গে রাশিয়ার একতরফাভাবে সমঝোতার প্রচেষ্টাকে মোকাবিলা করা নয়, যা ইউক্রেনকে রাশিয়ার কাছে সহজ শর্তে তুলে দিতে পারে। বরং এটিও নিশ্চিত করা যে, কোনো চুক্তি অদূর ভবিষ্যতে আরও বিস্তৃত যুদ্ধের শঙ্কা না বাড়ায়। তবে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের দিকে ট্রাম্পের বেশি ঝোঁক থাকায় যুক্তরাষ্ট্রের চলমান শান্তি প্রক্রিয়া নিয়েও সন্দেহ তৈরি হয়েছে। তবে ইউরোপীয় কিছু নেতা মনে করেন, কেবল রাশিয়াকে আটকে দেওয়ায় ইউক্রেনে শান্তি প্রতিষ্ঠা হবে। এখন যুদ্ধবিরতি চুক্তি করলে বরং মস্কো ফের আক্রমণের জন্য শক্তি ও সামর্থ্য অর্জন করবে। যেমনটা ক্রিমিয়া দখলের সময়ে হয়েছে। তাদের যুক্তি, রাশিয়া এখন ইউক্রেনের বেশিরভাগ ভূমি দখল করতে পারলে তারা শুধু সেখানেই সীমাবদ্ধ থাকবে না, তাদের নজর মধ্য ইউরোপেও পড়বে। g

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

ঈদে সড়ক দুর্ঘটনারোধে ৯ সুপারিশ

বাগেরহাটের সাবেক এমপি মিলন কারাগারে

চাঁপাইনবাবগঞ্জে মাদক মামলায় এক ব্যক্তির যাবজ্জীবন

আ.লীগের লিফলেট বিতরণ করে চাকরি খোয়ালেন শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তা

কাশ্মীর ইস্যুতে ভারতের বিরুদ্ধে অবস্থান নিল ওআইসি

কালবেলা বিশেষ সাক্ষাৎকার / অন্তর্বর্তী সরকারের মধ্যে দু-একটি অংশ ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করার চেষ্টা করছেন

চট্টগ্রামে থানা থেকে লুট হওয়া অস্ত্র-গুলি উদ্ধার

নরসিংদীতে তরুণকে গুলি ও হাত-পায়ের রগ কেটে হত্যা

কিছুদিনের মধ্যেই দেশে আসবেন তারেক রহমান

হেঁটে বাসায় ঢুকলেন খালেদা জিয়া

১০

দেশবাসীকে ধন্যবাদ জানালেন খালেদা জিয়া

১১

অপেক্ষমাণ ভিসা ইস‍্যুটির দ্রুত সমাধান করতে ইতা‌লিকে আহ্বান

১২

এনআরবিসি ব্যাংকের নতুন এম‌ডি তৌহিদুল আলম খান

১৩

বিয়ে বাড়িতে রুটি খাওয়া নিয়ে সংঘর্ষে ২ কিশোর নিহত

১৪

সাইবার সুরক্ষা আইন এক সপ্তাহের মধ্যে কার্যকর : আইন উপদেষ্টা

১৫

সন্ধ্যায় অসুস্থ মাকে দেখতে যাবেন জুবাইদা রহমান

১৬

ড. ইউনূসকে রাষ্ট্রপতি ও তারেক রহমানকে প্রধানমন্ত্রী করে জাতীয় সরকারের প্রস্তাব

১৭

কাশ্মীর হামলার কথা আগেই জানতেন মোদি, বোমা ফাটালেন কংগ্রেস সভাপতি 

১৮

সাংবাদিককে সাজা দেওয়া সেই ইউএনওকে বদলি

১৯

পাকিস্তান উপকূলে ভারতীয় গুপ্তচর বিমান ধরা

২০
X