হুমায়ূন কবির
প্রকাশ : ৩১ আগস্ট ২০২৫, ১২:০০ এএম
আপডেট : ৩১ আগস্ট ২০২৫, ০৭:৪১ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

যে সম্মেলনে পাল্টাচ্ছে বিশ্ব রাজনীতি

যে সম্মেলনে পাল্টাচ্ছে বিশ্ব রাজনীতি

যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কনীতি ঘোষণার পর থেকে দ্রুত বদলাচ্ছে বিশ্ব রাজনীতির দৃশ্যপট। শত্রু মিত্র হচ্ছে, আর মিত্র তার সহযোগীর ওপর আস্থা হারাচ্ছে। এ ঘিরে বিশ্বব্যবস্থাকেন্দ্রিক পশ্চিমা প্রভাবে লাগাম টানতে চাইছে চীন-রাশিয়ার মতো পরাশক্তিগুলো। বিরোধ-অভিমান ভুলে শত্রু-বন্ধুদের কাছে টানছে তারা। বিভিন্ন সংস্থার মাধ্যমে সহায়তার হাত বাড়াচ্ছে। পাশে চাচ্ছে আঞ্চলিক শক্তিগুলোকে। এমন পরিস্থিতিতে চীনের তিয়ানজিনে আজ রোববার থেকে শুরু হচ্ছে সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশনের (এসসিও) শীর্ষ সম্মেলন। এর মাধ্যমে আন্তর্জাতিক রাজনীতির পটভূমিতে নতুন মাত্রা যোগ করতে যাচ্ছে চীন। যেখানে এক মঞ্চে মিলিত হচ্ছেন চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ানের মতো নেতারা। বৈঠকের সবার দৃষ্টি থাকবে শি-মোদি বৈঠকের দিকেই। বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রতিদ্বন্দ্বী এই দুই প্রতিবেশী দেশের শীর্ষ নেতার বৈঠক শুধু কূটনৈতিক নয়, বরং বৈশ্বিক শক্তির ভারসাম্যেও নতুন বার্তা দিচ্ছে। এমনকি মোদির এ সফর এশিয়ার রাজনৈতিক ভবিষ্যৎও বদলে দিতে পারে। এবারের এসসিও সম্মেলন নিয়ে বিস্তারিত লিখেছেন হুমায়ূন কবির

চীনের তিয়ানজিনে আজ রোববার থেকে এসসিওর দুদিনের শীর্ষ সম্মেলন শুরু হচ্ছে। এতে যোগ দিতে চীন সফরে যাচ্ছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। ২০২০ সালে দুদেশের সীমান্ত নিয়ে সংঘর্ষের প্রায় সাত বছর পর চীন সফরে যাচ্ছেন মোদি। এ সফরের ওপর পুরো বিশ্বের নজর রয়েছে। কারণ, এটি দুই প্রাচীন সভ্যতার মধ্যে নতুন সহযোগিতামূলক যুগের সূচনা হতে পারে। বিশ্লেষকরা বলছেন, এ সম্মেলন কেবল আলোচনার টেবিল নয়, বরং একটি শক্তিশালী বার্তা। বিশ্বকে জানিয়ে দেওয়া যে চীন, রাশিয়া ও ভারতের কৌশলগত সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ হচ্ছে। সেইসঙ্গে পশ্চিমা প্রভাবকে টেক্কা দিয়ে এক নতুন বিশ্ব-ব্যবস্থারও বার্তা দিচ্ছে এ সম্মেলন।

মোদির সফর এশিয়ার ভবিষ্যৎ বদলে দিতে পারে: ভারত ও চীনের জনসংখ্যা বিশ্বের মোট মানুষের প্রায় ৩৫ শতাংশের কাছাকাছি। অর্থনৈতিক দিক থেকে চীন বর্তমানে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি এবং ভারত শিগগির তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ হবে। সম্প্রতি মোদি ও চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই-এর বৈঠকে দুই পক্ষই একমত হয়েছে, তারা প্রতিদ্বন্দ্বী নয়; বরং অংশীদার। তারা মনে করে, এশিয়ার শতক বা ‘এশিয়ান সেঞ্চুরি’ আসতে হলে দুই দেশের সহযোগিতা অপরিহার্য।

চীন ও ভারতের সম্পর্ক হাজার বছরের পুরোনো। কুষাণ সাম্রাজ্য ও হান রাজবংশের সময় থেকে বাণিজ্য শুরু হয়। সিল্ক রোডের মতো প্রাচীন পথ দিয়ে পণ্য, প্রযুক্তি ও সংস্কৃতির আদান-প্রদান হতো। শুধু বাণিজ্যই নয়, ধর্ম ও দর্শনও একে অপরকে সমৃদ্ধ করেছে।

ভারত এখন বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল বড় অর্থনীতি। দেশটির সবচেয়ে বড় তরুণ জনগোষ্ঠী, দ্রুত বেড়ে ওঠা উদ্ভাবন ব্যবস্থা এবং ক্রমবর্ধমান ভোক্তা বাজার রয়েছে। চীন অবকাঠামো, উৎপাদন শিল্প, ডিজিটাল শাসন ও নবায়নযোগ্য জ্বালানির ক্ষেত্রে দক্ষ। দুই দেশ একসঙ্গে কাজ করলে সম্ভাবনা অসীম।

চীন ভারতের পরবর্তী প্রবৃদ্ধির ধাপে বিনিয়োগে গঠনমূলক ভূমিকা নিতে পারে। এশীয় অবকাঠামো বিনিয়োগ ব্যাংক (এআইআইবি) থেকে ভারতের সবচেয়ে বেশি অর্থসহায়তা নেওয়া এরই মধ্যে শুরু হয়েছে। এআইআইবির মাধ্যমে চীন ও ভারত অবকাঠামো, স্মার্ট সিটি, পরিচ্ছন্ন জ্বালানি, জনস্বাস্থ্য ও টেকসই কৃষির মতো খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে পারে। ২৮০ কোটি মানুষের শক্তি কাজে লাগিয়ে ডিজিটাল সংযোগ থেকে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা পর্যন্ত অসংখ্য লক্ষ্য অর্জন সম্ভব। এটি কোনো এক পক্ষের অপর পক্ষকে সাহায্য করার বিষয় নয়; বরং দুই দেশের পরস্পর পরিপূরক শক্তি কাজে লাগানোর সুযোগ। বিশ্বের এ দুই জনবহুল দেশ একসঙ্গে এশিয়ার স্থিতি ও সমৃদ্ধির মূল স্তম্ভ হতে পারে।

চীন ও ভারতের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আরও গণতান্ত্রিক বৈশ্বিক শাসনের ভিত্তি গড়ে দিতে পারে। উভয় দেশই ব্রিকস, জি-২০ এবং এসসিওর কেন্দ্রীয় সদস্য। এ সংগঠনগুলোতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার মাধ্যমে তারা উন্নয়নশীল দেশগুলোকে ক্ষমতায়ন করতে পারে এবং বৈশ্বিক বাজার ও প্রতিষ্ঠান অস্থিতিশীল করার একতরফা পদক্ষেপের বিরোধিতা করতে পারে। বিশ্বে ক্রমবর্ধমান ভূরাজনৈতিক অনিশ্চয়তার সময় এ সহযোগিতার প্রয়োজন বিশেষভাবে জরুরি।

ভালো খবর হলো, চীন ও ভারত একা নয়। ক্রয়ক্ষমতা সমান হিসেবে হিসাব করলে এশিয়া এরই মধ্যে বৈশ্বিক অর্থনীতির দুই-পঞ্চমাংশের বেশি। ভারত যদি আঞ্চলিক সমন্বিত অর্থনৈতিক অংশীদ্বারত্বে (আরসিইপি) যোগ দেয়, তাহলে দেশটি এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক জোটের অংশ হবে। এতে ভারত অন্যান্য দেশের সঙ্গে শক্তিশালী অর্থনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তুলবে।

আঞ্চলিক উন্নয়ন ও সহযোগিতা খুব দ্রুত এগোবে। চীনের সমর্থন থাকলে ভারত নিজের শর্ত মেনে অংশ নিতে পারবে। আজকের অনিশ্চিত আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিতে এবং বৈশ্বিক বাণিজ্যের ব্যাঘাতের মধ্যে এটি ভারতের জন্য অত্যন্ত লাভজনক ও প্রয়োজনীয়।

মোদির এ সফর যৌথ ঘোষণাপত্র বা সহযোগিতার রূপরেখা তৈরির ভালো সুযোগ। সীমান্ত পারাপারের বাস্তব সহযোগিতা, পর্যটন, একাডেমিক প্রোগ্রাম, বিনিয়োগ চুক্তি, অবকাঠামো, সবুজ রূপান্তর, পরিবেশ সুরক্ষা এবং ডিজিটাল প্রযুক্তি ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় সমন্বয়—এসব খাতেই উন্নতির বিশাল সুযোগ রয়েছে।

সবুজ উন্নয়ন, বহুপক্ষীয় ও শান্তিকে কেন্দ্র করে গড়া এ দৃষ্টিভঙ্গি বাস্তব রূপ নেবে যখন মোদি এ বছর আবার প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে বৈঠক করবেন। চীন ও ভারত কেবল প্রাচীন জ্ঞান ও ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারী নয়, ভবিষ্যতের সম্ভাবনারও রক্ষক। ড্রাগন আর হাতি একসঙ্গে কাজ করলে তারা এমন এক অংশীদারত্ব গড়ে তুলতে পারবে, যা শুধু দুই মহান সভ্যতার জন্য নয়, পুরো বিশ্বের জন্যও আগামী কয়েক দশক ধরে সমৃদ্ধি বয়ে আনবে।

তিন নেতার বৈঠক ভিন্ন বার্তা দেবে: বিশ্লেষকরা আরও বলছেন, জানুয়ারি থেকে চীন, ইরান, রাশিয়া এবং এখন ভারতের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা ও উচ্চ শুল্ক আরোপ করে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। এ পরিস্থিতিতে এ সম্মেলনে এসব দেশকে মোকাবিলা করার জন্য মার্কিন চেষ্টা যে ব্যর্থ হয়েছে, তা তুলে ধরতে পারেন চীনা প্রেসিডেন্ট। সেইসঙ্গে নয়াদিল্লির রাশিয়ান দূতাবাস গত সপ্তাহে জানিয়েছে, শিগগির চীন ও ভারতের সঙ্গে ত্রিপক্ষীয় বৈঠকের আশা করছে মস্কো।

এ ছাড়া শি-মোদি বৈঠকে চীন-ভারত সীমান্ত উত্তেজনা হ্রাসে সম্ভাব্য অগ্রগতি, বাণিজ্য ও ভিসা নীতিতে শিথিলতা এবং জলবায়ু ও প্রযুক্তি খাতে সহযোগিতা নিয়ে আলোচনা হতে পারে।

এ সম্মেলনে বড় কোনো সিদ্ধান্ত হওয়ার সম্ভাবনা না থাকলেও তিন নেতার একই মঞ্চে উপস্থিতি বিশ্বের জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ বার্তা। এর আগে, গত বছর রাশিয়ার ব্রিকস সম্মেলনে চীনা প্রেসিডেন্টের সঙ্গে একই মঞ্চে দেখা গেছে মোদিকে। পুতিন, মোদি ছাড়াও এ সম্মেলনে অংশ নেবেন মধ্য এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য, দক্ষিণ এশিয়া এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার নেতারা। সম্মেলনের পর মোদি দেশে ফিরে যাবেন।

হবে পুতিন-পেজেশকিয়ান বৈঠক: ইরান ও রাশিয়ার দুই প্রেসিডেন্ট সোমবার চীনে একটি বৈঠকে মিলিত হবেন। যেখানে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আলোচনা হবে।

সামরিক কুচকাওয়াজে থাকছেন পুতিন-কিম: পুতিন বেইজিংয়ে থেকে যাবেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিজয় দিবস উপলক্ষে আয়োজিত সামরিক কুচকাওয়াজে অংশ নিতে। এতে চীন-রাশিয়ার বন্ধুত্ব আরও এক ধাপ গভীর হয়ে উঠবে বলেই মনে করা হচ্ছে। পারমাণবিক ইস্যু ও আঞ্চলিক নিরাপত্তা পরিস্থিতি ঘিরে উদ্ভূত উত্তেজনার প্রেক্ষাপটে এ সম্মেলন এবং কুচকাওয়াজকে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ বার্তা হিসেবে দেখা হচ্ছে।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

এনসিপি নেতার আপত্তিকর ভিডিও ফাঁস

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পর্যবেক্ষণের সঙ্গে দ্বিমত নেই ফার্স সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের

চোখের সামনেই ডুবে গেল কৃষকের স্বপ্ন

বাকৃবিতে নির্দিষ্টকালের জন্য রেল অবরোধ ও ব্যাংকে তালা

দল বদলের শেষ দিনে যা ঘটেছিল এমি মার্টিনেজের সাথে

না ফেরার দেশে ফুটবল দলের অধিনায়ক

স্ট্যাটাস দিই, আর গালি শুনি, অনেকে ভয়ও দেখায়: জয়

বঙ্গোপসাগরে লঘুচাপ, ভারী বৃষ্টি হতে পারে যেসব এলাকায় 

দৈনন্দিন যে ৫ ভুলে নীরবে বেড়ে যাচ্ছে টাকের ঝুঁকি

উত্তরা ইপিজেডে কারখানা বন্ধের জেরে সংঘর্ষ, শ্রমিক নিহত

১০

হত্যাচেষ্টার নতুন মামলায় নাসার নজরুল গ্রেপ্তার 

১১

স্ত্রীকে পিটিয়ে হত্যা, ঘাতক স্বামী আটক

১২

এক চেকপোস্টে বদলে গেল সিলেট-ঢাকা মহাসড়ক

১৩

হত্যার উদ্দেশ্যেই নুরকে আঘাত করা হয়েছিল : মির্জা ফখরুল

১৪

বিসিবির নির্বাচন করার ঘোষণা দিলেন বুলবুল

১৫

ছেলেদের বিপক্ষে আবারও মাঠে নামবে মেয়েরা, সূচি চূড়ান্ত

১৬

সড়ক দুর্ঘটনায় মা-মেয়ে নিহত

১৭

নির্মাতার হুমকি-ধমকিতেই কি ইন্ডাস্ট্রি ছেড়ে দিচ্ছেন রিপা?

১৮

সংশোধনী অধ্যাদেশ জারি  / রাজস্বনীতি বিভাগের সচিব হবেন শুল্ক-করের অভিজ্ঞ ব্যক্তি

১৯

বিমানবন্দরের কাছে বুড়িমারি এক্সপ্রেস লাইনচ্যুত

২০
X