হুমায়ূন কবির
প্রকাশ : ২১ ডিসেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম
আপডেট : ২১ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৭:৪৫ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

ঋতুর ডাকে ডানার মানচিত্রে পৃথিবী

ঋতুর ডাকে ডানার মানচিত্রে পৃথিবী

নীল আকাশে যখন একঝাঁক পাখি তীরের ফলার মতো আকৃতিতে উড়ে যায়, তখন কেবল একদল প্রাণী এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যায় না; বরং মহাকালের এক অনন্ত যাত্রা সচল থাকে। মানুষের তৈরি করা কাঁটাতার, পাসপোর্ট বা ভিসা যে সার্বভৌমত্বের দোহাই দেয়, প্রকৃতির এ যাযাবরদের কাছে তা অর্থহীন। তাদের কাছে পৃথিবীটা কোনো মানচিত্র নয়, বরং পানি, হাওয়া আর ঋতুর এক অবিচ্ছিন্ন সমীকরণ। ‘ঋতুর ডাকে ডানার মানচিত্রে পৃথিবী’—এই দর্শনেই লুকিয়ে আছে প্রাণজগতের এক অবিশ্বাস্য টিকে থাকার লড়াই। মাইল মাইল ছুটে আসা কেবল বেঁচে থাকার তাগিদেই—পরিযায়ী পাখির এই মহাকাব্যিক অভিপ্রায়ণ প্রকৃতির এক আদি ও অকৃত্রিম ছন্দ। তবে বর্তমানে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও জলাবায়ুর চরম পরিবর্তন তাদের চিরচেনা পথ ও জীবনচক্র তছনছ করে দিচ্ছে। বাস্তুসংস্থানের অবিচ্ছেদ্য এই কারিগররা কেবল শীতের অতিথি নয়, তারা বিশ্বের পরিবেশগত ভারসাম্যের জীবন্ত প্রতীক। তাই এই বিপন্ন বিশ্বপথিকদের আকাশপথ নিরাপদ রাখা এখন আর কোনো দয়া নয়, বরং পৃথিবীর ভবিষ্যৎ অস্তিত্ব রক্ষারই এক জরুরি অঙ্গীকার। পরিযায়ী পাখির আদ্যোপান্ত নিয়ে লিখেছেন হুমায়ূন কবির

পরিযায়ী পাখি কী

সহজ কথায় পরিযায়ী পাখি হলো সেসব পাখি, যারা বছরের একটি নির্দিষ্ট সময়ে জলবায়ু পরিবর্তন ও খাদ্যের অভাবজনিত প্রতিকূলতা এড়াতে নিজেদের আদি নিবাস ছেড়ে সাময়িকভাবে অন্য দেশে বা অঞ্চলে চলে যায়। আবার আবহাওয়া অনুকূলে এলে তারা নিজ দেশে ফিরে আসে।

এরা হাজার হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দেয়। কোনো কোনো পাখি বিরতিহীনভাবে কয়েকদিন পর্যন্ত উড়তে পারে। পাখিরা পথ চেনার জন্য সূর্যের অবস্থান, নক্ষত্র এবং পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্র ব্যবহার করে। এটি প্রকৃতির এক রহস্যময় জিপিএস সিস্টেম।

বাংলাদেশে আসা পরিযায়ী পাখিদের মধ্যে বিভিন্ন প্রজাতির হাঁস (যেমন— ল্যাঞ্জা হাঁস, গিরিয়া হাঁস), বালিহাঁস, গাংচিল, স্যান্ডপাইপার এবং বিভিন্ন ধরনের ছোট সৈকত পাখি প্রধান।

কেন এই নিরন্তর দেশান্তর

পরিযায়ী হওয়া কোনো বিলাসিতা নয়, এটি বংশপরম্পরায় বয়ে চলা এক জৈবিক বাধ্যবাধকতা। পাখিরা কেন হাজার মাইল পাড়ি দেয়, এ প্রশ্নের উত্তরে লুকিয়ে আছে তিনটি মৌলিক কারণ। খাদ্যনিরাপত্তা, প্রজনন এবং বৈরী আবহাওয়া থেকে আত্মরক্ষা।

উত্তর গোলার্ধের দেশগুলোয় যখন শীতের পদধ্বনি শোনা যায়, তখন প্রকৃতি এক মৃতবৎ রূপ ধারণ করে। বরফে ঢেকে যায় ফসলের মাঠ, জমে বরফ হয়ে যায় নদী ও বিলের জল। ফলে পাখিদের প্রধান খাদ্য—জলজ উদ্ভিদ, ছোট মাছ এবং পোকামাকড় সহজেই উধাও হয়ে যায়। ঠিক সে সময়েই শুরু হয় দক্ষিণ গোলার্ধের নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলে তাদের বাঁচার আকুতি। এই দীর্ঘ পথ পাড়ি দেওয়ার প্রস্তুতি তারা নেয় কয়েক মাস আগে থেকেই। শরীরের চর্বি জমিয়ে তারা নিজেদের করে তোলে এক একটি জীবন্ত জ্বালানি আধার।

ঋতুচক্রের মহাকাব্য

পাখিদের এই বৈশ্বিক ভ্রমণের সূচি পৃথিবীর ঋতুচক্রের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে যুক্ত। তাদের ডানা যেন ঋতু পরিবর্তনের ক্যালেন্ডার।

শীতকাল: অক্টোবর থেকে নভেম্বরে যখন সাইবেরিয়া, হিমালয়ের উত্তরাঞ্চল কিংবা ইউরোপে হাড়কাঁপানো শীত পড়ে, তখন পাখিরা উড়াল দেয় দক্ষিণে। বাংলাদেশ, ভারত, শ্রীলঙ্কা ও আফ্রিকার দেশগুলোতে তারা আশ্রয় নেয়। এখানকার ধানক্ষেত, হাওর আর মোহনাগুলো তাদের জন্য ডাইনিং টেবিলের মতো কাজ করে।

বসন্তকাল: ফেব্রুয়ারির শেষ থেকে মার্চে যখন দক্ষিণের দেশগুলোয় উষ্ণতা বাড়তে শুরু করে, তখন পাখিরা বুঝতে পারে তাদের জন্মভূমিতে এখন বরফ গলতে শুরু করেছে। এক অজানা প্রাণের টানে তারা আবার ফিরতি পথ ধরে। এটি তাদের জীবনের সবচেয়ে কঠিন যাত্রা, কারণ দীর্ঘ শীতের পর তাদের শরীরে শক্তির সঞ্চয় থাকে কম।

গ্রীষ্ম ও বর্ষাকাল: জুন-জুলাই মাসের গ্রীষ্মকাল হলো পরিযায়ী পাখিদের প্রজনন ঋতু। তারা উত্তরের নির্জন অঞ্চলে বাসা বাঁধে। গ্রীষ্মের দীর্ঘদিনের আলো ছানাদের বেড়ে ওঠার জন্য পর্যাপ্ত খাদ্যের জোগান দেয়। বর্ষাকালে যখন নিচু জমিগুলো প্লাবিত হয়, তখন জলচর পাখিরা নিরাপদ জলাভূমিতে তাদের বংশবিস্তার সম্পন্ন করে।

ডানার মানচিত্রে অদৃশ্য পথরেখা

বিশ্বের পাখিরা নির্দিষ্ট কিছু আকাশপথ অনুসরণ করে। মানচিত্রে যেমন হাইওয়ে থাকে, পাখিদের জন্য আকাশে তেমন ৮ থেকে ৯টি প্রধান ফ্লাইওয়ে রয়েছে।

সেন্ট্রাল এশিয়ান ফ্লাইওয়ে: এ পথটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ বাংলাদেশ ও ভারত এ রুটের প্রধান কেন্দ্র। এটি আর্কটিক মহাসাগর থেকে শুরু হয়ে ভারত মহাসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত।

ইস্ট এশিয়ান-অস্ট্রালেশিয়ান ফ্লাইওয়ে: সাইবেরিয়া থেকে শুরু হয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া হয়ে অস্ট্রেলিয়া পর্যন্ত।

আফ্রিকান-ইউরেশিয়ান ফ্লাইওয়ে: ইউরোপ ও উত্তর এশিয়া থেকে আফ্রিকা পর্যন্ত।

এ প্রতিটি পথই প্রাকৃতিক বাধা যেমন—উচ্চ হিমালয় পর্বতমালা বা উত্তাল মহাসাগর দিয়ে ঘেরা। কিন্তু পাখিরা সেই বাধা ডিঙিয়ে যায় অবলীলায়। ‘বার-হেডেড গুস’ নামের রাজহাঁস হিমালয়ের মাউন্ট এভারেস্টের উচ্চতা দিয়ে উড়ে যাওয়ার ক্ষমতা রাখে, যেখানে সাধারণ মানুষের জন্য অক্সিজেন ছাড়া টিকে থাকা অসম্ভব।

কম্পাস যখন ডিএনএ-তে

পাখিরা কীভাবে হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে ঠিক সেই একই জলাশয়ে ফিরে আসে, তা আজও বিজ্ঞানীদের কাছে এক পরম বিস্ময়। তাদের শরীরে রয়েছে প্রকৃতির দেওয়া সেরা জিপিএস সিস্টেম—

ম্যাগনেটোরেসেপশন: পাখিদের চোখে ‘ক্রিপ্টোক্রোম’ নামে এক বিশেষ প্রোটিন থাকে, যা তাদের পৃথিবীর চৌম্বকীয় ক্ষেত্র দেখতে বা অনুভব করতে সাহায্য করে। তারা মূলত পৃথিবীকে এক বিশাল মানচিত্র হিসেবে দেখতে পায়।

নাক্ষত্রিক কম্পাস: পরিযায়ী পাখিরা রাতের বেলা নক্ষত্রের অবস্থান দেখে দিক ঠিক করে। উত্তর গোলার্ধের পাখিরা ধ্রুবতারাকে কেন্দ্র করে তাদের পথ চিনে নেয়।

স্মৃতি ও ঘ্রাণশক্তি: পুরোনো ল্যান্ডমার্ক—যেমন একটি নির্দিষ্ট পাহাড়, নদীর বাঁক বা সমুদ্রের নোনা বাতাসের ঘ্রাণ তাদের পথ চেনার অন্যতম মাধ্যম।

নানা সংকট

বর্তমান পৃথিবী আর পাখিদের জন্য সে নিরাপদ স্বর্গ নেই। গ্লোবাল ওয়ার্মিং বা বিশ্ব উষ্ণায়ন তাদের জৈবিক ঘড়িকে তছনছ করে দিচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বসন্তকাল আগেই চলে আসছে। পাখিরা যখন প্রজনন ক্ষেত্রে পৌঁছাচ্ছে, ততক্ষণে পোকামাকড় (ছানাদের খাবার) জন্মানোর সময় পেরিয়ে যাচ্ছে। ফলে খাদ্যের অভাবে ছানারা মারা যাচ্ছে। উন্নয়নের নামে জলাভূমি ভরাট এবং নগরায়ণ পাখিদের বিশ্রামের জায়গা কেড়ে নিচ্ছে। ক্ষুধার্ত ও ক্লান্ত পাখিরা আশ্রয় না পেয়ে মাঝপথেই ঝরে পড়ছে।

রাতের বেলা শহরের কৃত্রিম আলো পাখিদের বিভ্রান্ত করে, ফলে তারা বহুতল ভবনের সঙ্গে ধাক্কা খায়। এ ছাড়া বিষটোপ দিয়ে পাখি শিকার তো আছেই।

বাস্তুসংস্থানে পাখিদের বৈশ্বিক ভূমিকা

পাখিরা কেবল অতিথি নয়, তারা বৈশ্বিক পরিবেশের ‘ইকোসিস্টেম ইঞ্জিনিয়ার’।

বীজ বিস্তার: হাজার মাইল যাত্রায় তারা মলত্যাগের মাধ্যমে এক অঞ্চলের উদ্ভিদের বীজ অন্য অঞ্চলে ছড়িয়ে দেয়, যা বনায়নে সাহায্য করে।

কীটপতঙ্গ নিয়ন্ত্রণ: পরিযায়ী পাখিরা ফসলের ক্ষতিকারক পোকা খেয়ে কৃষকের অকৃত্রিম বন্ধু হিসেবে কাজ করে।

পুষ্টিচক্র: জলাশয়ে তাদের বিচরণ মাছের খাদ্যের উৎস তৈরি করে এবং পানির উর্বরতা বাড়ায়।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট ও দায়বদ্ধতা

বাংলাদেশ হলো পরিযায়ী পাখিদের অন্যতম প্রধান বিচরণস্থল। টাঙ্গুয়ার হাওর, হাইল হাওর, হাকালুকি এবং নিঝুম দ্বীপের মতো এলাকাগুলো বিশ্বব্যাপী পাখিদের নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে পরিচিত। কিন্তু ক্রমবর্ধমান প্লাস্টিক দূষণ এবং পর্যটকদের অবাধ বিচরণ এই নীরব অতিথিদের জন্য বিষফোড়া হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সাইবেরিয়ার একটি হাঁস যখন বাংলাদেশের কোনো বিলে ডানা ঝাপটায়, তখন বুঝতে হবে দুই দেশের পরিবেশগত ভাগ্য একই সুতোয় গাঁথা। যদি আমরা জলবায়ুর পরিবর্তন রুখতে না পারি, যদি আমাদের জলাভূমিগুলো কংক্রিটের নিচে চাপা পড়ে যায়, তবে একদিন এই আকাশের মানচিত্র ধূসর হয়ে যাবে। আমাদের দায়িত্ব হলো, ঋতুর ডাকে সাড়া দিয়ে আসা এ অদম্য ডানাগুলোর জন্য আকাশটাকে মেঘমুক্ত রাখা এবং তাদের যাত্রাপথকে নিরাপদ করা। কারণ, পাখিরা যদি পথ হারায়, তবে একদিন মানুষও এ পৃথিবীতে তার অস্তিত্বের ঠিকানা খুঁজে পাবে না।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

সড়ক দুর্ঘটনায় আহত নোরা ফাতেহি

তেঁতুলিয়ায় হাড় কাঁপানো শীত

চট্টগ্রামের কোচের দায়িত্বে আইপিএল খেলা ক্রিকেটার

ফের পুত্রসন্তানের মা হলেন ভারতী সিং

শহীদ ৬ শান্তিরক্ষীর জানাজা সম্পন্ন

আজকের স্বর্ণের বাজারদর

খুন করে বিপ্লবের চেতনা দমন করা যায় না : জামায়াত আমির

রোনালদোকে ছুঁয়ে রিয়ালকে জেতালেন এমবাপ্পে, জয় পেল সিটিও

কেমন থাকবে আজকের ঢাকার আবহাওয়া

সমাজকে পরিবর্তনের অঙ্গীকার নিয়ে আমি এমপি হতে চেয়েছি : অ্যাটর্নি জেনারেল

১০

বদলে গেল বিপিএল শুরুর সময়

১১

তিন বাহিনীর প্রধানদের সঙ্গে সিইসির বৈঠক রোববার

১২

বিএনপি সব ধর্মের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠার রাজনীতি করে : ড. মারুফ

১৩

মস্তকবিহীন মরদেহ উদ্ধার, মিলল চাঞ্চল্যকর তথ্য

১৪

সেনা কর্মকর্তাসহ ১৭ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের আদেশ আজ

১৫

মিরপুরে এনসিপি নেতাকর্মীদের ওপর হামলা

১৬

বগুড়ায় স্কুলছাত্র নিখোঁজ

১৭

ভেনেজুয়েলা উপকূলে আরেক তেল ট্যাংকার জব্দ করল যুক্তরাষ্ট্র

১৮

গাজায় সংযম দেখানোর আহ্বান যুক্তরাষ্ট্রসহ চার দেশের 

১৯

সুখবর পেলেন ছাত্রদল নেতা

২০
X