আবিদ রাইহান
প্রকাশ : ২৫ জুলাই ২০২৫, ১২:০০ এএম
আপডেট : ২৫ জুলাই ২০২৫, ১২:১৬ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ

স্পেনে মুসলমানদের পতনের ইতিহাস

স্পেনে মুসলমানদের পতনের ইতিহাস

ইউরোপ মহাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তে এবং আটলান্টিক মহাসাগরের উপকূল ঘেঁষে অবস্থিত ঐতিহাসিক দেশ স্পেন। ৭১১ খ্রিষ্টাব্দে স্পেন বিজয় করে মুসলিম বাহিনী। মুসলিম সেনাপতি তারিক ইবনে জিয়াদের নেতৃত্বে স্পেনের অত্যাচারী রাজা রডারিককে পরাজিত করে মুসলমানরা এ ভূখণ্ডে ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠা করে। মুসলিম আগমনের এক দশকের মধ্যে আইবেরীয় উপদ্বীপের (বর্তমান স্পেন ও পর্তুগাল) অধিকাংশ ভূখণ্ডই তাদের অধীনে চলে আসে। এরপর ৭০০ বছরের বেশি সময় মুসলমান এ ভূখণ্ড শাসন করে। মুসলিম আমলে এর নাম ছিল ‘আন্দালুস’। খ্রিষ্টীয় নবম শতকে আন্দালুস হয়ে ওঠে ইউরোপের সবচেয়ে অগ্রসর অঞ্চল। এ ভূখণ্ডের জনসংখ্যার ৮০ শতাংশ লোকই ইসলাম ছায়াতলে আশ্রয় নেয়। এর রাজধানী কর্দোভা ছিল মুসলিম বিশ্ব ও ইউরোপের জ্ঞানপিপাসুদের তীর্থস্থান।

১০৩১ খ্রিষ্টাব্দে উমাইয়া শাসনের পতন হলে আন্দালুস অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যে বিভক্ত হয়ে পড়ে। ক্ষুদ্র এ রাজ্যগুলো ‘তাইফা’ নামে পরিচিত ছিল। ক্ষুদ্র এ রাজ্যগুলো দুর্বল এবং একতাবদ্ধ না থাকার কারণে ধীরে ধীরে উত্তরের খ্রিষ্টান রাজ্যগুলোর আগ্রাসনের শিকার হতে থাকে। পরবর্তী ২০০ বছরের মধ্যে খ্রিষ্টান আগ্রাসনে একে একে এ রাজ্যগুলোর পতন ঘটতে থাকে। ১২৪০ সালের মধ্যে দক্ষিণের একমাত্র গ্রানাদা ছাড়া বাকি সব রাজ্য মুসলমানদের হাতছাড়া হয়ে যায়। ১২৩৬ সালে কর্দোভার পতনের পর, গ্রানাদার শাসকরা উত্তরের খ্রিষ্টান রাজ্যগুলোর মধ্যে অন্যতম শক্তিশালী রাজ্য ক্যাস্টাইলের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়। চুক্তি অনুসারে, বার্ষিক কর প্রদানের ভিত্তিতে গ্রানাদা নিজেদের স্বাধীনতা টিকিয়ে রাখার অধিকার লাভ করে। অর্থাৎ গ্রানাদা স্বাধীনভাবে তাদের অবস্থান টিকিয়ে রাখতে খ্রিষ্টান ক্যাস্টাইল রাজ্যকে কর প্রদান করতে বাধ্য ছিল।

এ চুক্তির মাধ্যমে গ্রানাদার শাসকরা তাদের স্বাধীনতা টিকিয়ে রাখার পরিবর্তে বরং তাদের শত্রুদের হাতকেই অধিক শক্তিশালী করে। এ ছাড়া গ্রানাদার স্বাধীনভাবে টিকে থাকার আরও একটি কারণ ছিল তার ভৌগোলিক অবস্থান। দক্ষিণ স্পেনের সিয়েরা নেভদার পাহাড়ি অঞ্চলে রাজ্যটি অবস্থিত থাকার কারণে এখানে সেনা অভিযান পরিচালনা ছিল কঠিন। সামরিক দিক হতে ক্যাস্টাইলের থেকে দুর্বল হওয়া সত্ত্বেও সিয়েরা নেভদার পাহাড় গ্রানাদার প্রতিরক্ষাকে শক্তিশালী করেছিল। যদিও ২৫০ বছরের অধিক গ্রানাদা খ্রিষ্টান ক্যাস্টাইল রাজ্যের করদ রাজ্য হিসেবে তার অবস্থান টিকিয়ে রাখে, কিন্তু চারপাশের বৈরী খ্রিষ্টান রাজ্যগুলোর অবস্থানে সবসময়ই তার স্বাধীনতা হারানোর আশঙ্কায় ছিল।

১৪৬৯ খ্রিষ্টাব্দে আরাগনের রাজা ফার্দিনান্দ ক্যাস্টাইলের রানি ইসাবেলাকে বিয়ে করেন। এর মাধ্যমে আইবেরীয় উপদ্বীপের দুটি শক্তিশালী খ্রিষ্টান রাজ্য একত্রিত হয়। এই ঐক্যবদ্ধ খ্রিষ্টান শক্তি আন্দালুসের মাটি থেকে সর্বশেষ মুসলিম রাজ্যটির স্বাধীন শাসনের অবসান ঘটানোর সিদ্ধান্ত নেয়। ১৪৮২ খ্রিষ্টাব্দে ঐক্যবদ্ধ খ্রিষ্টান শক্তির সঙ্গে গ্রানাদার সংঘর্ষ শুরু হয়। সামরিক দিক হতে পিছিয়ে থাকা সত্ত্বেও গ্রানাদার অধিবাসীরা অসম্ভব সাহসিকতার সঙ্গে লড়াই করে। আন্দালুসের সর্বশেষ অবস্থান টিকিয়ে রাখতে সাধারণ মুসলিম জনগণ এবং সৈন্যবাহিনী চরম সাহসিকতার লড়াই করলেও তাদের শাসকরা সেরূপ সাহসিকতার পরিচয় দিতে পারেনি।

যুদ্ধের সম্পূর্ণ সময় খ্রিষ্টান সেনাবাহিনী ঐক্যবদ্ধ ছিল। তাদের মধ্যে ব্যক্তিগত ক্ষুদ্র স্বার্থের কোনো দ্বন্দ্ব ছিল না। অন্যদিকে, গ্রানাদায় মুসলিম শাসক ও প্রশাসকরা পারস্পরিক ক্ষুদ্র স্বার্থ নিয়ে দ্বন্দ্বে লিপ্ত ছিল। তাদের মধ্যে আবার অনেকেই অর্থের বিনিময়ে খ্রিষ্টান শক্তির পক্ষে কাজ করছিল। যুদ্ধ শুরু হওয়ার এক বছরের মাথায় গ্রানাদার আমির আবুল হাসানের পুত্র মুহাম্মদ তার পিতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। রাজা ফার্দিনান্দ এ সুযোগকে তার কাজে লাগান। তিনি মুহাম্মদকে তার পিতা এবং পরবর্তীকালে তার চাচা আল জাগলের বিরুদ্ধে সংঘর্ষে সাহায্য করেন। মুহাম্মদ ফার্দিনান্দের সাহায্যে তার পরিবারের বিরুদ্ধে যুদ্ধে গ্রানাদার অধিকারে সক্ষম হন। এর মাধ্যমে ফার্দিনান্দের সেনাবাহিনী গ্রানাদার ভূমিতে পা ফেলতে সক্ষম হয়। ১৪৯০ সালে মুহাম্মদ যখন গ্রানাদা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন, তখন গ্রানাদা শহর ছাড়া আর কোনো অঞ্চলই তার ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত ছিল না। গ্রানাদা অধিকারের পরপরই, নতুন আমির মুহাম্মদকে রাজা ফার্দিনান্দ গ্রানাদাকে তার হাতে হস্তান্তরের নির্দেশ দিয়ে একটি চিঠি পাঠান। এ চিঠিতে মুহাম্মদ বিস্মিত হন এবং বুঝতে পারেন, তিনি এতদিন ফার্দিনান্দের দাবার ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছেন। মুহাম্মদ খ্রিষ্টান বাহিনীকে প্রতিরোধের সিদ্ধান্ত নেন এবং বিশ্বের বিভিন্ন মুসলিম শাসকদের কাছে সাহায্য চেয়ে চিঠি পাঠান। ছোট একটি ওসমানীয় নৌবহর ছাড়া আর কেউই তার সাহায্যে এগিয়ে আসেনি। ১৪৯১ সালের শেষে গ্রানাদা ফার্দিনান্দ ও ইসাবেলার সম্মিলিত বাহিনীর অবরোধের শিকার হয়। ১৪৯১ সালের নভেম্বরে মুহাম্মদ গ্রানাদার শাসন খ্রিষ্টান অধিকারে প্রদানের চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে বাধ্য হন।

১৪৯২ সালের ২ জানুয়ারি, স্বাক্ষরিত চুক্তি অনুসারে স্পেনীয় সেনাবাহিনী শহরে প্রবেশ করে এবং আনুষ্ঠানিকভাবে মুসলিম আন্দালুস রাষ্ট্রের পতন ঘটায়। খ্রিষ্টান সৈন্যরা বিখ্যাত আলহামরা প্রাসাদ দখল করে এবং এর ওপর সম্মিলিত খ্রিষ্টান শক্তির বিজয় পতাকা উড়িয়ে দেয়। আলহামরার সর্বোচ্চ প্রাসাদে রুপার তৈরি একটি বিশাল ক্রুশ স্থাপিত হয়। আমির মুহাম্মদকে নির্বাসনে পাঠানো হয়। চুক্তি অনুসারে যদিও খ্রিষ্টান বাহিনী ধর্মীয় স্বাধীনতা ও সমনাগরিক অধিকারের প্রতিশ্রুতি প্রদান করেছিল, কিন্তু শিগগির তারা তাদের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে। ১৫০১ সালে ক্যাস্টাইলে এক রাজকীয় আদেশে ঘোষণা করা হয়, ক্যাস্টাইল আর লিয়নের সব মুসলিমকে হয় খ্রিষ্টান হতে হবে, না হয় স্পেন ছেড়ে চলে যেতে হবে।

১৫০২ খ্রিষ্টাব্দে সমগ্র স্পেনে ইসলামী বিশ্বাসকে বেআইনি ঘোষণা করা হয়। অসংখ্য স্পেনীয় মুসলমান তখন উত্তর আফ্রিকায় হিজরত করে। যারা স্পেনে ছিল, তারাও তাদের বিশ্বাসকে গোপন করতে বাধ্য হয়। ১৬০০ ইসায়ীর মধ্যে স্পেন সম্পূর্ণরূপে মুসলিমশূন্য হয়ে পড়ে। এ পরাজয়ের পর মুসলিমদের ওপর নেমে আসে ভয়াবহ নির্যাতন। ১৫৫৬ সালে দ্বিতীয় ফিলিপ আইন জারি করেন, স্পেনের মাটি থেকে মুসলিমদের ভাষা, নামাজ-রোজা, অন্যান্য ধর্মীয় অনুষ্ঠান এবং প্রভাব মুছে ফেলতে হবে। ১৬০৯ সালে তৃতীয় ফিলিপ মুসলিম বিতাড়নের শেষ হুকুমনামায় স্বাক্ষর করেন। এর ফলে স্পেনের সব মুসলিমকে জোর করে বের করে দেওয়া হয়। এভাবে মুসলিম স্পেন থেকে হারিয়ে যায় মুসলমানদের ইতিহাসের গৌরবময় অধ্যায়।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

পল্লবী থানা হেফাজতে জনি হত্যা : দুই পুলিশ কর্মকর্তার যাবজ্জীবন দণ্ড বহাল

গানের টিজারেই ঝড় তুললেন হৃতিক আর জুনিয়র এনটিআর

ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস জিনিয়াসে প্রেসিডেন্সি ইউনিভার্সিটির সাফল্য 

মিরপুরে পিচ পরিদর্শনে হেমিং, চোখে পড়ল ‘পুঁই বাগান’

ত্বকের যেসব লক্ষণে বুঝবেন শরীরে কোলেস্টেরল বাড়ছে

তারেক রহমানের নির্দেশে বৃদ্ধ দম্পতিকে সহায়তা

আরপিও চূড়ান্তে ইসির মুলতবি সভা শুরু

আপন বোন ও তার প্রেমিককে খুন করল ভাই

শোয়েবুর হত্যার রহস্য উদ্ঘাটন

ওমানে প্রবাসীদের জন্য রেসিডেন্স কার্ড চালু

১০

নির্বাচনে ৮০ হাজারের বেশি সেনাসদস্য দায়িত্বে থাকবে : স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা

১১

আবারও বড়সড় বিপদের মুখে এয়ার ইন্ডিয়া

১২

বেগম রোকেয়ার ‘সুলতানার স্বপ্ন’ গ্রন্থের ইউনেস্কোর স্বীকৃতি উপলক্ষে ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির সেমিনার

১৩

সাবেক এমপি সোলাইমান সেলিম ফের ৩ দিনের রিমান্ডে

১৪

সাইফ-কারিনার দুই ছেলের রক্তে মিশে আছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

১৫

এনইউবি–আল-আজহার যৌথ কর্মশালা: আধুনিকতা–পরাধুনিকতার কাব্যতাত্ত্বিক মানচিত্র

১৬

সাংবাদিক তুহিন হত্যার ঘটনায় মালয়েশিয়ায় প্রতিবাদ সভা

১৭

প্লট দুর্নীতি  / শেখ হাসিনা-জয়-পুতুলের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য আজ

১৮

ইয়ামালের জোড়া গোলে বার্সার গাম্পার ট্রফি জয়

১৯

হত্যাচেষ্টার মামলায় জামিন পেলেন শমী কায়সার

২০
X