‘মধ্যপ্রাচ্য উনুনে চাপানো কড়াইয়ের পানির মতো টগবগ করে ফুটছে। ইসরায়েল ইরানে হামলার জন্য চূড়ান্তভাবে প্রস্তুত, যুক্তরাষ্ট্র বিপাকে।’ ইসরায়েলের বিখ্যাত দৈনিক হেরিটজ (Haaretz) জিম্মিদের মুক্তি ও শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য সমঝোতা ও যুদ্ধ বিরতির পক্ষে ওকালতি করে আসছে। উপরোক্ত মন্তব্য তাদের।
যুক্তরাষ্ট্রের ঘোষিত নীতি যুদ্ধবিরতি কার্যকর এবং মধ্যপ্রাচ্যে সংঘাতের বিস্তৃতি রোধ করা। বছর পেরিয়েছে, মার্কিন পররাষ্ট্র সচিব ব্লিঙ্কেন শাটলের মতো ওয়াশিংটন-তেল আবিব উড়ছেন, কিন্তু শান্তির সন্ধান মেলেনি। বরং গাজা ও পশ্চিম তীর পেরিয়ে ইসরায়েলের সেনাবাহিনী পৌঁছে গেছে লেবাননে। এক পা-দুই পা করে যুদ্ধ ইরান অভিমুখী। হতাশ মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেন হোয়াইট হাউসে তার ব্যক্তিগত অফিস কক্ষে নেতানিয়াহুর উদ্দেশে রাগ ঝাড়ছেন, ‘ফাকিং লায়ার’ বলতেও ছাড়েননি, এ খবর গণমাধ্যমে প্রচারিত হয়েছে। বাস্তবে মার্কিন প্রশাসন নিজেদের নীতি অবস্থান ছেড়ে দিয়ে ইসরায়েলের কাছে একের পর এক আত্মসমর্পণ করে চলেছে।
বস্তুত ইদানীং ইসরায়েল পরামর্শ করা দূরে থাকুক, যুক্তরাষ্ট্রকে হামলার আগাম খবর দেওয়ার ব্যাপারেও গড়িমসি করছে। বাইডেন প্রশাসন ভীত, ইসরায়েল আসন্ন মার্কিন জাতীয় নির্বাচনের আগেই ইরানের পরমাণু অবকাঠামোতে না হামলা চালায়। যার অবশ্যম্ভাবী পরিণতি চলমান ইরান-ইসরায়েল ছায়াযুদ্ধের সর্বাত্মক যুদ্ধে রূপান্তর। এ এক শাঁখের করাত, দুদিকেই কাটে। আঞ্চলিক যুদ্ধে বাইডেন প্রশাসন ইসরায়েলের পক্ষাবলম্বন না করলে বিপদ, করলেও তাই। ডেমোক্র্যাটদের নাজুক নির্বাচনী সমীকরণে নিশ্চিত ভাঙন, ইহুদি ভোটের অন্তর্ভুক্ত। পক্ষান্তরে, মিশিগান সুইং স্টেট। সেখানে কয়েক লাখ প্যালেস্টাইন মুসলিম বসবাস করেন। তাদের ভোট না পেলে মিশিগান হাতছাড়া। মিশিগান না জিতলে হোয়াইট হাউসের দরজা বন্ধ। গতবার বাইডেনের সঙ্গে সেখানে ট্রাম্পের ভোটের ব্যবধান ছিল মাত্র হাজার পঁয়ত্রিশ। ২০১৬-এর নির্বাচনে গোটা দেশ মিলিয়ে ট্রাম্পের চেয়ে ত্রিশ লাখ ভোট বেশি পেলেও মিশিগানে হাজারখানেক ভোটে পিছিয়ে পড়ে হিলারি ইলেকটোরাল কলেজের হিসাবে পরাজিত হয়েছিলেন। কাজেই বাইডেন ইসরায়েলকে প্রলোভন দেখাচ্ছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সম্মত টার্গেটের মধ্যে হামলা সীমাবদ্ধ রাখলে বিনিময়ে বড়সড় ‘ক্ষতিপূরণ প্যাকেজ’ অর্থাৎ আর্থিক ও সামরিক সাহায্য দেবেন। এরই মধ্যে তিনি ইসরায়েলের জন্য জরুরি ভিত্তিতে ১.২৫ বিলিয়ন মূল্যের Terminal High Altitude Area Defence (THAAD) ছাড়ের ব্যবস্থা করেছেন। শূন্যে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা বিধানে ইসরায়েলের এটি প্রয়োজন। এটি মোতায়েন করা পর্যন্ত যদি কিছুটা সময় হাতে মেলে এবং ইরানের পারমাণবিক স্থাপনা এবং জ্বালানি উৎপাদন কেন্দ্রে হামলা থেকে ইসরায়েলকে নিরস্ত রাখা যায়।
নেতানিয়াহু মার্কিন প্রেসিডেন্টকে অবজ্ঞা করার সাহস পান কোথায়? ওয়াশিংটন পোস্টের ‘How Netanyahu ran rings around Biden’, উপসম্পাদকীয়তে এর উত্তর আছে। প্রেসিডেন্টের আশপাশের লোকজনের পরিচয় থেকে স্পষ্ট, বাইডেন কাদের ঘেরাটোপে বন্দি। ‘বিবি’ অর্থাৎ নেতানিয়াহু ওয়াশিংটনে কাটিয়েছেন বহু বছর। মার্কিনি রাজনীতির অন্ধিসন্ধি তার নখদর্পণে, উজির-নাজিররাও পরিচিতজন। যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াল স্ট্রিটের শেয়ারবাজার ও ব্যাংকের নিয়ন্ত্রক ইহুদি ধনকুবের, গণমাধ্যমের মালিক-সাংবাদিক, খ্যাতনামা বুদ্ধিজীবী ও পেশাজীবীরা একই গোয়ালের গরু। ইসরায়েল তাদের নিরাপদ স্বর্গ, শেষ আশ্রয়। ডেমোক্র্যাটরা নেতানিয়াহুকে পরিত্যাগ করলে পর মুহূর্তেই ট্রাম্প এবং রিপালিকানরা তাকে কোলে তুলে নাচবেন।
ইহুদি প্রতিষ্ঠান Anti-Defamation League হচ্ছে শিকারি কুকুর। কারও গায়ে কিছুমাত্র ‘অ্যান্টি সেমিটিজমের’ গন্ধ লেগে আছে কি না, শুঁকে বেড়ায়। যুক্তরাষ্ট্রের বৃহত্তম নির্বাচনী তহবিলের মালিক AIPAC বা আমেরিকান ইসরায়েলি পাবলিক কমিটি। কোনো রাজনীতিক ইসরায়েলের বিরুদ্ধে কথা বললে তার কপাল মন্দ। তার প্রতিদ্বন্দ্বীকে জেতানোর জন্য AIPAC যত টাকা লাগুক খরচ করতে একপায়ে খাড়া। ডেমোক্র্যাট বামপন্থি ককাসের বেশ কজন উঠতি নেতা প্যালেস্টাইনের পক্ষে কথা বলায় তাদের খাড়ার নিচে কাটা পড়েছেন। প্রাইমারি পর্যন্ত পেরোতে পারেননি।
কিঞ্চিৎ ইতিহাস আলোচনা করা যাক। মধ্যযুগ থেকে ইউরোপের সমস্যা ইহুদিরা, ‘ঈশ্বরপুত্র যিশুর শূলে চড়ানোর জন্য এরাই দায়ী’। ইউরোপের সর্বোচ্চ কর্তৃত্ব ভ্যাটিকানের ধর্মাধিকারী পোপ দুর্বল হয়ে পড়লেন। কিন্তু তার স্থানাধিকারী পরস্পর যুদ্ধরত ‘সার্বভৌম রাজা’রা ধারের অর্থ ফেরত চাইলে যুদ্ধ তহবিলের জোগানদার সুদখোর ইহুদি মহাজনদের ওপর বেজায় বিরূপ হন। আধুনিক গণতন্ত্রের যুগে জাতিরাষ্ট্রে বহিরাগত লগ্নিকার, মহাজন ও বণিকশ্রেণির প্রতি স্থানীয় জনসাধারণের ঈর্ষা, অবিশ্বাস ও বৈরিতা কথিত ‘ইহুদি বিদ্বেষ বা অ্যান্টি সেমিটিজম’ আবির্ভূত হলো। এর চরম রূপ দেখা গেল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হলোকাস্ট বা ইহুদি নির্মূলের ঘটনায়। যুদ্ধোত্তর বিজয়ী মিত্রজোটের নেতারা ইহুদি সমস্যার একটি স্থায়ী সমাধানের ব্যাপারে একমত হলেন, মধ্যপ্রাচ্যে ইহুদিদের নিরাপদ আবাস ভূমি একটি ইহুদি রাষ্ট্র স্থাপন। আপাতদৃষ্টিতে নিরীহ এ সিদ্ধান্তের নেপথ্যে যদিও আরও একটি বিবেচনা ছিল। সেটি হচ্ছে আধুনিক শিল্পের জন্য অত্যাবশ্যকীয় খনিজ জ্বালানি তেলের উৎস মধ্যপ্রাচ্যে। তেলের উৎস ও সরবরাহ পথের ওপর পশ্চিমা শক্তির রাজনৈতিক ও সামরিক নিয়ন্ত্রণ অতি গুরুত্বপূর্ণ। এ কারণে ঔপনিবেশিক ব্যবস্থার ভাঙনের যুগে এ অঞ্চলে তাদের একটি স্থায়ী উপনিবেশ দরকার। ইসরায়েল প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এক ঢিলে দুটি পাখি মারা সম্ভব। ইউরোপের বর্ণ সমস্যার মধ্যপ্রাচ্যে স্থানান্তর এবং নিজস্ব ঘাঁটি স্থাপন। প্যালেস্টাইনের আরব জনগণ নিজস্ব ভূমির ওপর বহিরাগতদের জবরদখল মেনে নেবে না। অস্তিত্বের জন্য সাম্রাজ্যবাদের সমর্থনের মুখাপেক্ষী ইসরায়েল হবে মধ্যপ্রাচ্য ও পশ্চিম এশিয়ায় শক্তিধর ‘পশ্চিমের’ প্রসারিত বাহু। সে বাহুকে মেদ ও শক্তি জোগালেই অর্থাৎ অস্ত্র ও অর্থ দিয়ে বলশালী রাখলে কাজ উদ্ধার।
হলো ঠিক তাই। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা ইহুদি অভিবাসীরা প্যালেস্টাইনের স্থায়ী বাসিন্দা আরবদের ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করে তাদের বাড়িঘর জমিজিরেত দখল করল। ইউরোপে ভ্রাম্যমাণ ‘রিফিউজি’ ইহুদিরা ভূমি ও রাষ্ট্রের মালিক হলেন। প্যালেস্টাইনের আরবরা সব হারিয়ে ছিন্নমূল রিফিউজিতে রূপান্তরিত হলেন। সাম্রাজ্যবাদী মহল ‘ইহুদি রাষ্ট্রের অস্তিত্ব ও নিরাপত্তার অধিকার’ নিয়ে চেঁচামেচি করলেও আসল কথা হচ্ছে, যে কোনো মূল্যে পশ্চিম এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলের কৌশলগত সামরিক প্রাধান্য ধরে রাখা। বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদের এতদাঞ্চলে ভয় দেখানো ও বিভাজনের রাজনীতির বড় হাতিয়ার ইসরায়েল। ফলে মানবাধিকারের অভিভাবকরা অন্যত্র হল্লাচিল্লা করলেও ইসরায়েলের গণহত্যার বেলায় চোখ বুজে থাকেন।
প্যালেস্টাইন সমস্যার কেন্দ্রে ভূমির সংঘাত। একপক্ষে স্থানীয় আরব, যারা হৃত জমি পুনরুদ্ধার বা জমির ওপর দখল টিকিয়ে রাখার জন্য সংগ্রাম করছে, অন্যপক্ষ ভূমিলোভী বহিরাগত অভিবাসী এবং তাদের প্রতিনিধি জবরদখলকারী ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র ইসরায়েল। যুদ্ধের মধ্যেই তেল আবিবে জমি কেনাবেচার ধুম চলেছে। ইসরায়েলি ভূমিদস্যু রিয়েল স্টেট ব্যবসায়ী সংস্থাগুলো গাজা, পশ্চিম তীর ও দক্ষিণ লেবাননের জমি বেচাবিক্রি করছে। জমির ওপর এ ব্যবসায়ীদের আইনগত কোনো অধিকার নেই, দখলকৃত ভূখণ্ড নিয়ে ইসরায়েল কী করবে তাও অনিশ্চিত, কেনার লোকের কিন্তু অভাব হচ্ছে না।
নিউইয়র্ক টাইমসের দুজন সাংবাদিক লিখেছেন, ‘বাইডেন প্রশাসনের মধ্যপ্রাচ্য নীতি ব্যর্থ হয়েছে, কিন্তু এর উদ্দেশ্য ছিল সাধু, শান্তি স্থাপন।’ ইসরায়েলকে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার জন্য সশস্ত্র করা ও কূটনৈতিক সুরক্ষা দেওয়া বাইডেন প্রশাসনের কৃতিত্ব। আন্তর্জাতিক আদালতে ইসরায়েলের নেতাদের বিরুদ্ধে গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে হোয়াইট হাউস উদ্বিগ্ন, তারা না জড়িয়ে যান। কাজেই শান্তি স্থাপন নিয়ে অযথা কথাবার্তা, লোকদেখানো বাক্যালাপ, কিন্তু শান্তি ধরাছোঁয়ার বাইরে।
বাইডেনের বিদেশনীতির ব্যর্থতার দিকে ইঙ্গিত করে সিনেটর রন পল লিখেছেন, “যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদাধিকারী সামরিক কর্মকর্তারা বিদেশে (ইসরায়েল) বসে সেই দেশের জন্য যুদ্ধ পরিকল্পনা করছেন অন্য আরেকটি দেশের বিরুদ্ধে (ইরান)। এ যুদ্ধের জ্বালানি হচ্ছে মার্কিন অস্ত্রশস্ত্র ও সামরিক সামগ্রী, মার্কিন গোয়েন্দা তথ্য ও মার্কিন ট্যাক্স ডলার। এ প্রশাসন ইসরায়েলকে আরও বেশি অস্ত্র, অর্থ ও কূটনৈতিক সমর্থনের ‘ক্ষতিপূরণ’ প্যাকেজের অঙ্গীকার করেছে। শর্ত হচ্ছে, মার্কিন সম্মতি সাপেক্ষে টার্গেটগুলোতে হামলা চালাতে হবে এবং তারা সম্মত নয়, এমন সব টার্গেট হামলার বাইরে থাকবে।”
তিনি আরও লিখেছেন, ‘কল্পনা করুন, ইরানকে তাদের পছন্দসই টার্গেট বাদ রেখে অন্য কিছু সুনির্দিষ্ট মার্কিন টার্গেটে হামলা চালাতে চীন তেহরানকে অর্থ ও অস্ত্র সাহায্য করল। সে ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র কার সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত বলে সিদ্ধান্ত করবে? ইরান অথবা চীন, নাকি চীন ও ইরান উভয়ই? বিদেশি রাষ্ট্র ইরান কি যুক্তরাষ্ট্রে সামরিক আঘাত হেনেছে? মার্কিন নাগরিকদের কি হুমকি দিচ্ছে? এই মুহূর্তে ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে আমাদের কি নিজস্ব কোনো প্রয়োজন আছে? এর প্রতিটি উত্তর না; যে কোনো মূল্যে আমরা মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ পরিহার করতে চাই, বিশেষত যদি তা ইরানের বিরুদ্ধে হয়। কিন্তু নিশ্চিত থাকুন, আমরা যুদ্ধই পাচ্ছি।’
নেতানিয়াহু মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেনকে দুই পয়সার গুরুত্বও দিচ্ছেন না। কারণ তিনি জানেন, বিশ্বের একমাত্র পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি তার পায়ের ছাপকে অনুসরণ করা ছাড়া গত্যন্তর নেই। তিনি নিজের ইচ্ছেয় চলছেন, কর্মফল চাপাচ্ছেন যুক্তরাষ্ট্রের ঘাড়ে।
লেখক: রাজনীতি বিশ্লেষক, আমেরিকা প্রবাসী