

বাংলা সনের ষড়ঋতুর মধ্যে পৌষ-মাঘ মিলে শীতকাল। এখন কেবল হেমন্তের শেষ মাস অগ্রহায়ণ শুরু। ষড়ঋতু হিসেবে শীতকাল আসতে আরও এক মাস বাকি। তবুও পুরো শীতের আমেজ বিরাজ করছে যশোরে। শীতের আবহ শুরু হয় কার্তিক মাসের মাঝামাঝি থেকে। আর এই শীত বয়ে আনে ‘যশোরের যশ, খেজুরের রস’ এর মৌসুম, যার সুখ্যাতি দেশময়।
ইতোমধ্যে যশোরের গাছিরা পুরোদমে নেমে পড়েছেন খেজুরের রস আহরণে। তারা আরও তিন সপ্তাহ আগে থেকে শুরু করেন প্রস্তুতি। সে সময় গাছের বাঁকল কেটে রস সংগ্রহের স্থান প্রস্তুত করেন। এখন গাছের প্রস্তুতকৃত স্থান সপ্তাহের নির্দিষ্ট দিনে কেটে রস সংগ্রহ করছেন।
খেজুরের রস-গুড়-পাটালির জন্যও বিখ্যাত এ জেলা। দেশ পেরিয়ে বিদেশেও রয়েছে বেশ কদর। যুগ যুগ ধরে চলা জেলার এ খ্যাতি প্রকাশে প্রচলিত ও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ‘যশোরের যশ, খেজুরের রস’। শীতের দিন মানেই যশোরের গ্রামাঞ্চলে খেজুর রস ও গুড়ের ঘ্রাণ, শীতের সকালে খেজুরের তাজা রস, রসের বিভিন্ন প্রকার পিঠা এবং পায়েস তো আছেই। এই অঞ্চলে একটি গানও প্রচলিত আছে, ‘ঠিলে ধুয়ে দে বউ গাছ কাটতি যাবো, সন্ধ্যে নস ঝেড়ে এনে জাউ নেন্ধে খাবো।’
যশোর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, বর্তমানে জেলায় খেজুর গাছ রয়েছে ১৬ লাখ ২৫ হাজারের মতো। জেলার বিভিন্ন অঞ্চল ঘুরে দেখা যায়, খেজুর গাছ সাধারণত ক্ষেতের আইলে, রাস্তার ধারে, নদী বা খালের পাড়ে হয়ে থাকে। আবার দু’এক জায়গায় পতিত জমিতে খেজুরের বাগানও রয়েছে।
কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তাদের মতে, যশোর অঞ্চলের মাটি সাধারণত বেলে দো-আঁশ। আর পানিতে লবণাক্ততা নেই। এর ফলে গাছের শিকড় অনেক নিচে পর্যন্ত যেতে পারে। সব মিলিয়ে জলবায়ু উপযোগী যশোরের খেজুরের রস সুগন্ধি ও সুস্বাদু হয়ে থাকে।
গাছিরা জানান, কাচা রস ঠিলে বা ভাড় প্রতি (৩-৫ কেজি) ১৫০-২০০ টাকা বিক্রি হয়। ভালো মানের এক ভাড় গুড় বিক্রি হয় হাজার টাকায়। আর পাটালি কেজি প্রতি ৪০০-৫০০ টাকা। রস সংগ্রহ থেকে গুড়-পাটালি বানানো কাজটা বেশ কষ্টসাধ্য এবং সময় সাপেক্ষ। বাংলা সনের আশ্বিন মাসের (অক্টোবরের মাঝামাঝির পর থেকে) শুরু থেকে চৈত্র (মার্চ) মাস পর্যন্ত প্রায় ৫ মাস গাছি এবং গাছি পরিবারকে দিনের একটা উল্লেখযোগ্য সময় এর পিছনে ব্যয় করতে হয়। অক্লান্ত পরিশ্রম করে মৌসুম শেষে গাছিদের আয়-রোজগার হয় বেশ ভালোই।
যশোরে সবচেয়ে বড় খেজুর গুড়ের হাট বসে সদরের রূপদিয়া, বাঘারপাড়ার খাজুরা, মণিরামপুর, কেশবপুর ও মণিরামপুর উপজেলার রাজগঞ্জে। ব্যবসায়ীরা এসব হাট থেকে খেজুরের গুড় ও পাটালি কিনে সারা দেশে সরবরাহ করেন। এখানকার কারিগরদের পাটালি তৈরিতে সুনাম থাকায় খেজুরের গুড়-পাটালির ব্যাপক চাহিদা রয়েছে দেশের অন্যান্য জেলায়, এমনকি দেশের বাইরেও। যশোরের সুস্বাদু এই গুড়-পাটালি অনেক ব্যবসায়ী সরাসরি গাছিদের কাছে অর্ডার দিয়ে পাইকারি মূল্যে কিনে দেশের বাইরেও সরবরাহ করে থাকেন। কয়েক বছর আগে থেকে অনলাইনে ব্যাবসা শুরু করেছেন অনেকেই।
এদিকে গত ২ নভেম্বর চলতি মৌসুমে খেজুরগাছ প্রস্তুতের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়েছে। চৌগাছা উপজেলার হায়াতপুর গ্রামে অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেন ইউএনও শাহিনুর আক্তার।
সদর উপজেলার পতেঙ্গালী গ্রামের মাঠে খেজুর গাছ কাটছিলেন ওই গ্রামের গাছি টিপু সুলতান। তিনি বলেন, ‘আমার নিজস্ব কোনো খেজুর গাছ নেই। গ্রামের কয়েকজনের কাছ থেকে দেড়শ গাছ লিজ নিয়েছি। লিজ বা ভাগ বের করে দিয়েও মৌসুম শেষে দেড়শ গাছে লাখ দেড়েক টাকা মুনাফা থাকবে বলে আশা করছি।’
এ বিষয়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর যশোরের উপপরিচালক মো. মোশাররফ হোসেন কালবেলাকে বলেন, ‘কৃষি অফিসের পক্ষ থেকে নিরাপদ রস-গুড় উৎপাদনে কৃষকদের উৎসাহিত ও সচেতন করা হচ্ছে। সেক্ষেত্রে গাছে ঝোলানো ভাড় বা ঠিলের মুখ খোলা না রেখে নেটিং পদ্ধতি ব্যবহারে উৎসাহিত করা হচ্ছে। ম্যাকানিক্যাল ক্লাইম্বার বা গাছের ওঠার যন্ত্র ব্যবহার করলে কষ্টদায়ক এ কাজ গাছিদের জন্য সহজ হয়। এ লক্ষ্যে একটি প্রজেক্টও এরই মধ্যে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘২০২৪-২৫ অর্থবছরে যশোর জেলায় ৩ কোটি ৭১ লাখ লিটার রস ও ২ হাজার ৭৪২ মেট্রিক টন গুড় উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। বাজারদর অনুযায়ী রস ও গুড়ের বাজার দর প্রায় ১০০ কোটি টাকা।’
মন্তব্য করুন