গত সাড়ে ১৫ বছরে শাসকচক্র দুর্নীতিকে এমন পর্যায়ে নিয়ে গেছে যে, দুদকে কামান দাগা ছাড়া এখন আর কোনো পথ খোলা নেই। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, দুদকে কামান দাগবে কে? শেখ হাসিনার সরকার দুর্নীতিকে মহামারির মতো বিস্তার করে গেছে। সাধারণ ওষুধপত্র বা ঝাড়ফুঁকে এই মহামারি নিরাময় সম্ভব নয়। সংবাদপত্রের পাতায় প্রায় প্রতিদিন দুর্নীতির ফিরিস্তি প্রকাশিত হচ্ছে। এসব বিবরণ পড়লে মনে হয়, দুর্নীতিবাজরাই দেশ শাসন করে গেছে। দুর্নীতিতে যেন ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। সরকারের মন্ত্রী, এমপি, দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতা থেকে শুরু করে উপজেলা পর্যায়ের নেতা, উঠতি নেতা, সরকার-ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী, পুলিশ কর্মকর্তা, আমলা, বিচারক-কর্মকর্তা দুই হাতে টাকা লুট করেছেন। গড়েছেন সম্পদের পাহাড়। যারা দুর্নীতিসহ বিভিন্ন অপরাধের বিচার করবেন, সেই বিচারকরাই দুর্নীতিতে লিপ্ত হয়েছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর বলেছেন, ‘শেখ হাসিনার সহযোগী ব্যবসায়ীরা ব্যাংক খাত থেকে ১ হাজার ৭০০ কোটি ডলারের সমপরিমাণ টাকা সরিয়েছেন। রাষ্ট্রীয় মদদে এ মাত্রায় ব্যাংক ডাকাতি বিশ্বের অন্য কোথাও নেই।’ এদিকে ২৯ অক্টোবর দুদক চেয়ারম্যান ও দুই কমিশনার পদত্যাগ করেছেন। কারা আসছেন দুদকের শীর্ষ পদে? এ নিয়ে চলছে নানামুখী আলোচনা।
দুর্নীতির ভয়াবহ মাত্রা বোঝার জন্য এখানে কিছু উদাহরণ তুলে ধরা হলো মাত্র, দুর্নীতির মাত্রা এর চেয়ে হাজারগুণ বেশি। একটি দৈনিকের প্রথম পাতার শিরোনাম হচ্ছে—‘অবিশ্বাস্য সম্পদ অর্ধশত বিচারক-কর্মকর্তার’। খবরের উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে দুদকের অনুসন্ধান: অ্যাকাউন্টে শতকোটি টাকা অনেকের, বিদেশে বিপুল অর্থ পাচার, বেগমপাড়ায় বাড়ি, শত শত বিঘা জমি, (সমকাল, ১৪ অক্টোবর); সাবেক ভূমিমন্ত্রীর আরও ৩০০ (তিনশ) বাড়ির সন্ধান, তিনি (সাইফুজ্জামান চৌধুরী) বর্তমানে লন্ডনে ১৪ মিলিয়ন ডলারের বিলাসবহুল একটি বাড়িতে রয়েছেন (আলজাজিরার অনুসন্ধান, দৈনিক কালবেলা, ২৩ অক্টোবর); দেশ জুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে মির্জা আজমের (সাবেক প্রতিমন্ত্রী মির্জা আজম) সম্পদের পাহাড়, নিজের ও স্ত্রী-সন্তানের নামে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, স্থাবর সম্পত্তি, ফ্ল্যাট, বাগানবাড়িসহ সম্পত্তি ক্রয়, দেশ-বিদেশে নানা খাতে বিপুল বিনিয়োগ, ছাত্রলীগ নেতার নামে জামালপুর শহরে এবং বাইরে প্রায় ৩০০ একর জমি (সমকাল, ২ অক্টোবর), এমপি-মন্ত্রী হয়ে বদলে যান আব্দুর রাজ্জাক, অবৈধ সম্পদের পাহাড় (সমকাল, ২৭ অক্টোবর)। ‘ভাঙাড়ি বিক্রেতা থেকে হাজার কোটি টাকার মালিক’ শিরোনামে মানবজমিন ৩১ অক্টোবর প্রকাশিত খবরে বলা হয়: খুলনার অলিতেগলিতে ঘুরে একসময় ভাঙাড়ি কিনে বিক্রি করত দেলোয়ার হোসেন দেলো। এরপর ছিল নতুন বাজারের মাছের আড়তে ক্লিনার। শেখ হাসিনার চাচাতো ভাই সাবেক এমপি শেখ জুয়েল ও শেখ সোহেলের আশীর্বাদে শূন্য থেকে হাজার কোটি টাকার মালিক হয়েছে। তার রয়েছে মাছের কোম্পানি, পণ্যবাহী জাহাজ, একাধিক গাড়ি-বাড়িসহ অঢেল সম্পত্তি। দৈনিক কালবেলায় ৩ অক্টোবর একটি খবরের শিরোনাম হচ্ছে—‘দেড় বিঘা জমি থেকে শতকোটি টাকার মালিক জিন্নাহ (বগুড়া-১ আসনের সাবেক এমপি শরিফুল ইসলাম জিন্নাহ)’।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর প্রভাবশালী গণমাধ্যম ফিন্যান্সিয়াল টাইমসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকার বলেছেন, ‘এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইফুল আলম ও তার সহযোগীরা ব্যাংক খাত থেকে অন্তত ১০ বিলিয়ন ডলার লুটপাট করেছেন। প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা দপ্তরের (ডিজিএফআই) সাবেক কিছু কর্মকর্তা শীর্ষ স্থানীয় ব্যাংক দখল করতে সহায়তা করেছেন। বিভিন্ন ব্যাংক দখল করে বাংলাদেশ থেকে টাকা পাচার করা হয়েছে। নতুন শেয়ারধারীদের ঋণ দেওয়া ও আমদানির অতিরিক্ত খরচ দেখিয়ে এই পাচার কার্যক্রম চলেছে। যে কোনো বৈশ্বিক মানদণ্ডে এটি সবচেয়ে বড় ব্যাংক ডাকাতি। ব্যাংকের সাবেক প্রধান নির্বাহীদের মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে এটা করা হয়েছে। অর্থ লোপাটে এস আলম গ্রুপ প্রতিদিনই নিজেদের নামে ঋণ অনুমোদন করেছে।’ ফিন্যান্সিয়াল টাইমসকে দেওয়া গভর্নরের সাক্ষাৎকারের এ খবর সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়।
উল্লিখিত খবরের বিস্তারিত বিবরণ থেকে দেখা যায়, পতিত সরকারের মন্ত্রী-এমপি, দলের নেতা, ব্যবসায়ী, বিচারক, পুলিশ, আমলাদের একটি বড় অংশ দুর্নীতি করেছেন। অনেক ক্ষেত্রে তারা পরস্পর যোগসাজশ করে বড় বড় দুর্নীতি সংঘটিত করেছেন। এ যেন ‘দুর্নীতিতে ভ্রাতৃত্ব’ প্রতিষ্ঠা। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর খন্দকার ইব্রাহিম খালেদ এক মুক্ত সংলাপে বলেছিলেন, “আজকে দুর্নীতিতে ভ্রাতৃত্ব। এত কঠিন একতা, ভালো জিনিসের সঙ্গে তুলনা করা ঠিক নয়। তবুও আমাদের স্বাধীনতার সময় যেমন ঐক্য ছিল, তার চেয়েও কঠিন ঐক্য। তখন রাজাকার ছিল, কিন্তু তাদের মধ্যে রাজাকার নেই। তারা সব এক। একেবারে সর্বোচ্চ পর্যায়ে থেকে পিয়ন পর্যন্ত কেউ বিপদে পড়লে তারা সবাই ছুটে আসে। আপনি যদি পুলিশে কেস দিতে যান, আপনাকে আটকে রাখবে। কেস নেবে না। আপনি যদি বিচার বিভাগে যান, তো বহু কষ্টে হয়তো কিছু ফিসটিস দিয়ে কেসটা জমা হবে, কিন্তু যার বিরুদ্ধে কেস করবেন তার জামিন হয়ে যাবে। তাকে আটকাতে পারবেন না। বিচারক মহোদয় তার অধিকার রক্ষার জন্য তাকে জামিন দিয়ে দেন। আপনি কোথায় যাবেন? এমন একটা পরিস্থিতি। খুব কঠিন ঐক্যের মধ্যে তারা আছে। তারা ‘দুর্নীতি ভাই’ বন্ধনে আবদ্ধ।” মরহুম ইব্রাহিম খালেদ সাড়ে ২৫ বছর আগে (১৯৯৯ সালের এপ্রিল মাসে) প্রথম আলো আয়োজিত এক মুক্ত সংলাপে এ কথাগুলো বলেছিলেন। তখনো আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় ছিল। আর গত সাড়ে ১৫ বছর ক্ষমতাসীন সরকারের আমলে ‘দুর্নীতিতে ভ্রাতৃত্ব’ সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
দুর্নীতি দমনের লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। কিন্তু দুর্নীতি দমনে দুদকের ভূমিকা এখন রীতিমতো প্রশ্নবিদ্ধ। দুদক বিভিন্ন সরকারের আমলে ক্ষমতাসীনদের হাতিয়ার হিসেবেই ব্যবহৃত হয়েছে। ক্ষমতাসীনরা বিরোধী দলকে শায়েস্তা করার জন্য তাদের নেতাকর্মীদের নামে মামলা দিতে দুদককে কাজে লাগিয়েছে। এ কথা বলার অর্থ এই নয় যে, বিরোধী দলের নেতারা ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় দুর্নীতি করেননি। অর্থাৎ বিএনপি যখন ক্ষমতায় ছিল, তাদের এমপি-মন্ত্রী ও নেতাদের নামে দুর্নীতির মামলা হওয়া ও সাজার ঘটনার নজির কি আছে? আওয়ামী লীগ স্বৈরাচারী সরকারের আমলে মন্ত্রী-এমপি, দলের নেতা, ব্যবসায়ী, আমলা, পুলিশ, বিচার বিভাগের কর্মকর্তা কারও বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করে দুদক কি সাজার ব্যবস্থা করতে পেরেছে? সরকারদলীয় কোনো কোনো সংসদ সদস্য, সরকারের আশীর্বাদপুষ্ট ব্যবসায়ী, কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ জমা পড়লে এবং গণমাধ্যমের খবরের পরিপ্রেক্ষিতে দুদক এসব অভিযোগের নামকাওয়াস্তে তদন্ত করে অভিযুক্তদের ‘ক্লিন সার্টিফিকেট’ দিয়েছে। গত তিনটি নির্বাচনের আগে সরকারদলীয় অনেক প্রার্থীর বিরুদ্ধে জমা হওয়া দুর্নীতির অভিযোগের মুখে এমন দায়মুক্তি বা ‘সাদা মনের মানুষ’ হিসেবে সনদ দিয়েছে দুদক। দুদক কখনোই দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে তার ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারেনি। দুদক কার্যত একটি ব্যর্থ প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। আর এজন্য দুদকের একজন সাবেক চেয়ারম্যান বলেছিলেন, ‘দুদক হচ্ছে নখ-দন্তহীন বাঘ।’ বিভিন্ন সময়ে দুদকে কর্মরত অনেক কর্মকর্তার বিরুদ্ধেও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে।
অন্তর্বর্তী সরকার গত ৫ সেপ্টেম্বর দুদক সংস্কার কমিশন গঠন করে। কমিশন সুপারিশমালা তৈরির জন্য কাজ করে যাচ্ছে। আগামী ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে সুপারিশ প্রণয়নের কাজ শেষ হওয়ার কথা। এরই মধ্যে দুদকের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মইনউদ্দিন আব্দুল্লাহ এবং কমিশনার (তদন্ত) মো. জহুরুল হক ও কমিশনার (অনুসন্ধান) মোছা. আছিয়া খাতুন পদত্যাগ করেছেন, আগেই তা উল্লেখ করা হয়েছে। তাদের পদত্যাগের পর ‘রাজনৈতিক বিবেচনা’ ও ‘আমলাতান্ত্রিক প্রভাব’ থেকে বেরিয়ে এসে দুর্নীতি দমন কমিশনের নতুন কমিশন নিয়োগের আহ্বান জানিয়েছে টিআইবি। ৩১ অক্টোবর গণমাধ্যমে পাঠানো টিআইবির এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘ক্ষমতাচ্যুত কর্তৃত্ববাদী সরকারের শতাধিক সাবেক মন্ত্রী-এমপি এবং সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জন ও অর্থ পাচারের অভিযোগে অনুসন্ধান কাজ চলমান রয়েছে। এমন একটি সময়ে শীর্ষ পর্যায়ের শূন্যতা দুদকের তদন্তসহ সব কার্যক্রমে স্থবিরতা সৃষ্টি করতে পারে। কারণ নতুন কমিশন গঠনের আগপর্যন্ত নতুন করে কারও বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু ও তদন্ত বা মামলা করার সুযোগ থাকবে না। ফলে দ্রুত নতুন কমিশন গঠনের মাধ্যমে এ শূন্যতা পূরণ করা জরুরি। তা না হলে রাষ্ট্র সংস্কারের ক্ষেত্রে হিতে বিপরীত পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে।’
টিআইবির আহ্বানের পরিপ্রেক্ষিতে বলতে হয়, ২০০৪ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে দুদক দুর্নীতি দমনে কার্যকর কোনো ভূমিকাই রাখতে পারেনি। বরং দুদকের ভূমিকার বিপরীতে দেশে দুর্নীতির ব্যাপক বিস্তার হয়েছে। স্বৈরাচারী সরকারের সাড়ে ১৫ বছরে দুর্নীতি ভয়াবহ মাত্রা পায়। সরকারের প্রশ্রয়ে দুর্নীতিবাজরা সর্বত্র দাপিয়ে বেড়িয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান প্রধান অঙ্গীকারের মধ্যে দুর্নীতি দমন অন্যতম। দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত করতে হলে দুর্নীতি দমনের কোনো বিকল্প নেই। দুর্নীতিতে দুনিয়ার রাঘববোয়ালরা সবসময় ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যাচ্ছে। অন্তর্বর্তী সরকার দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করেছে। কিন্তু দেশে যারা দুর্নীতিবাজ হিসেবে চিহ্নিত তাদের অনেককে খুনের মামলার আসামি করা হচ্ছে। তারা হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত কি না, তা তদন্ত সাপেক্ষ এবং আদালতের বিচার্য বিষয়। তবে গ্রেপ্তার হওয়া পতিত সরকারের এমপি-মন্ত্রীদের অধিকাংশ বড় বড় দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত। এখন পর্যন্ত বড় বড় দুর্নীতিবাজের বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা হওয়া বা তদন্তের বিষয় তেমন দৃশ্যমান নয়। দুর্নীতি দমনের জনগণের আস্থা ফেরানো জরুরি। আর এ লক্ষ্যে প্রথমেই বর্তমান দুদকের খোলনলচে বদলাতে হবে। কারণ, আজ্ঞাবহ দুদক দিয়ে দুর্নীতি দমন কোনোভাবেই সম্ভব নয়। রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক প্রভাবমুক্ত হয়ে প্রশ্নাতীতভাবে সৎ, দক্ষ, উপযুক্ত এবং মেরুদণ্ড শক্ত এমন ব্যক্তিদের নতুন চেয়ারম্যান ও কমিশনার হিসেবে নিয়োগ দিতে হবে। বর্তমানে দুদকে কর্মরত মহাপরিচালক, পরিচালক ও কর্মকর্তাদের বিষয়েও খোঁজখবর হওয়া দরকার। কেননা স্বৈরাচারী সরকারের আমলে দুর্নীতি দমনে তাদের কার কী ভূমিকা ছিল, তা সরকারকে জানতে হবে। অন্তর্বর্তী সরকার দুর্নীতি দমনে দৃঢ় ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণে ব্যর্থ হলে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে সৃষ্ট জনআকাঙ্ক্ষা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে।
লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও বিশ্লেষক