নীতিনৈতিকতার অবক্ষয় কোন পর্যায়ে পৌঁছলে জীবন বাঁচাতে একজন রোগী যখন অপারেশন থিয়েটারে, তখনো নীতিবিবর্জিত এবং চূড়ান্ত অমানবিকতা চর্চায় বিবেক সায় দেয় কীভাবে? এ প্রশ্নের উত্তর আমাদের কাছে অজানা। ওটিতে রোগীকে মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ ব্যবহারের মতো বিস্ময়কর ও ঘৃণ্য ঘটনা ঘটেছে রাজধানী ঢাকার এক প্রাইভেট হাসপাতালে। এটি কোনোভাবেই কাম্য নয়।
রোববার দৈনিক কালবেলায় প্রকাশিত এ-সংক্রান্ত একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে বিস্তারিত চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুসারে, রাজধানীর সোবহানবাগের ওই হাসপাতালটিতে অস্ত্রোপচারের রোগীদের হঠাৎ অবস্থার অবনতি হওয়ায় ২০২১ সালে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে তাদের রেফারের হার বেড়ে যায়। বেড়ে যায় মৃত্যুর হারও। কারণ অনুসন্ধানে এ নিয়ে চার সদস্যের একটি অভ্যন্তরীণ তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। ওই কমিটি অনুসন্ধানে দেখে, ওটি কক্ষে ফ্রিজারে মেয়াদোত্তীর্ণ বিভিন্ন ওষুধের ভায়াল। সেই ওষুধ অস্ত্রোপচারের রোগীর ওপর প্রয়োগ করা হতো। আবার গলার অস্ত্রোপচারের সময় তারা স্বাভাবিকভাবে শ্বাস নিতে পারেন না। তাই শ্বাসনালিতে এন্ডোট্র্যাকিয়াল টিউব স্থাপন করা হয়। এতে রোগীর স্বাভাবিক শ্বাস-প্রশ্বাস ঠিক থাকে। সংবেদনশীল এসব মেডিকেল ডিভাইসের জন্য আলাদা মূল্য পরিশোধ করার পরও একই টিউব একাধিক রোগীর শ্বাসনালিতে স্থাপন করা হয়। এখানেই থেমে থাকেনি অপকর্ম। হাসপাতালটির রোগীর ওষুধের বিল নিয়ে চলেছে নানা অসদুপায়। তদন্তে আরও বেরিয়ে আসে, ওটির ফ্রিজারের সংবেদনশীল ওষুধ আর বিভিন্ন খাবার একসঙ্গে রাখা, মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধের ভায়ালের তথ্য আড়াল করতে ঘষামাজা করে তারিখ মুছে ফেলার চেষ্টাসহ নানা অনিয়ম। এ ছাড়া রয়েছে বিভিন্ন আর্থিক অনিয়মের ঘটনা, যা এখন সরকারের সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের তদন্তাধীন।
বাংলাদেশে বিভিন্ন প্রাইভেট হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে রোগীদের অভিযোগ নতুন নয়। সীমাহীন অর্থলিপ্সা প্রবণতায় বিভিন্ন সময় রোগীদের ব্ল্যাকমেইলসহ নানা অপ্রীতিকর ঘটনার সংখ্যাও অতীতে কম নয়। সেসব অপ্রত্যাশিত ঘটনায় সংশ্লিষ্ট হাসপাতালের বিরুদ্ধে প্রাথমিকভাবে সরকারের সংশ্লিষ্টদের তৎপরতা দেখা যায়। কিন্তু এসবের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির নজির নেই বললেই চলে। পাশাপাশি নেই রাজধানীসহ জেলা-উপজেলায় ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে ওঠা হাজার হাজার প্রাইভেট ডায়াগনস্টিক, ক্লিনিক, হাসপাতালে পর্যাপ্ত নজরদারি। ফলে রোগীদের অসহায়ত্ব, ভোগান্তির শেষ হয় না।
আমরা মনে করি, স্বাধীনতার এত বছর পরও দেশে কার্যকর একটি স্বাস্থ্যব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। খুবই কমসংখ্যক একটি শ্রেণির মানুষ ছাড়া অধিকাংশেরই এ সেবা পেতে হলে পদে পদে নানা ভোগান্তির মধ্য দিয়ে যেতে হয়। কেননা সরকারি সেবায় রয়েছে সীমাবদ্ধতা। এরপর প্রাইভেট হাসপাতালগুলোয় নিয়ন্ত্রণ নেই নানা ক্ষেত্রে। ফলে সবাইকে এ সেবা প্রদানে পুরো স্বাস্থ্যব্যবস্থায় আনতে হবে প্রয়োজনীয় সংস্কার। এ সেবায় কোনো রকমের অবহেলা গ্রহণযোগ্য নয়। সরকারি স্বাস্থ্যসেবার বাইরে দেশে যে প্রাইভেট স্বাস্থ্যসেবা গড়ে উঠেছে, সেখানে গুণগত মান নিশ্চিত জরুরি। এটি করতে হলে নিয়মিত প্রতিষ্ঠানে নজরদারি বাড়ানো দরকার। কোনোরকমের অনিয়ম দেখা দিলে জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। আমাদের প্রত্যাশা, প্রতিবেদনে উল্লিখিত হাসপাতালের বিরুদ্ধে তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।