লারা সেত্রাকিয়ান
প্রকাশ : ১১ ডিসেম্বর ২০২৪, ০২:৫৯ এএম
আপডেট : ১১ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৮:২৭ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

ভবিষ্যৎ সিরিয়া গঠনের সুযোগ দিতে হবে

ভবিষ্যৎ সিরিয়া গঠনের সুযোগ দিতে হবে

সিরীয়দের জন্য এখন সময়টা সীমাহীন স্বপ্ন ও আশার জাল বোনার। বাশার আল-আসাদের পতনে তারা প্রাণভরে উদযাপন করছে এবং এ আনন্দ নিশ্চয়ই চলবে কিছুদিন। তারা স্বস্তির গভীর অনুভূতির জগতে উচ্ছ্বাসের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। হাজার হাজার মানুষ আসাদের শাসনামলে মারা গেছে। তাদের মধ্যে কেউ মারা গেছে আসাদের শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে। অন্যদিকে তার শাসন রক্ষা করতে লড়াই করেছে যারা, মারা গেছে তারাও। উভয়পক্ষের মানুষ একজন ব্যক্তির ক্ষমতার নেশার কাছে অপূরণীয় ক্ষতির শিকার হয়েছে। লাখ লাখ সাধারণ মানুষ তাদের বাড়িঘর হারিয়েছে বা নির্বাসনে থাকতে বাধ্য হয়েছে। থাকতে হয়েছে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন। ঘরে ফিরতে পেয়েছে ভয়। আসাদের পতনের পর যখন সেদনায়ার কারাগারের দরজা খোলা হলো তখন হাজার হাজার সিরীয় সূর্যের আলোতে বের হলো দীর্ঘকাল পর। তাদের অনেককে দীর্ঘ নির্মমতার শিকার হতে হয়েছে। পাশাপাশি অনেককে মৃত বলেও ধরে নেওয়া হয়েছিল পরিবারগুলোর পক্ষ থেকে। বস্তুত কারামুক্তির এই দৃশ্য ছিল দেশটির নতুন জীবনেরই প্রতীক।

সিরীয়দের মধ্যে বিরাট একটি সংখ্যা রয়েছে, যারা এরপর কী হবে তা নিয়ে ভীষণ চিন্তিত। যুদ্ধক্ষেত্রে অর্থাৎ সিরীয় গৃহযুদ্ধে বেশ কয়েকটি বিদ্রোহী গ্রুপ একত্রিত হয়ে আসাদকে হটিয়েছে। যদিও এই যুদ্ধে হায়াত তাহরির আল-শামের (এইচটিএস) নেতৃত্ব ও প্রভাব ছিল বেশি। এই দলটি উপদলগুলোর একটি জোট, যা রক্ষণশীল থেকে অতিরক্ষণশীল স্পিরিট ধারণ করে থাকে। এইচটিএস এক দশক আগে গঠিত হয়। তখন এর নাম ছিল জাভাত আল-নুসরা। সে সময় উত্তর সিরিয়াজুড়ে অনেক মিলিশিয়া গড়ে উঠছিল। এইচটিএস তাদের মধ্যে অন্যতম একটি দল।

এই দলগুলোর মধ্যে জাভাত আল-নুসরা সর্বদাই ছিল শক্তিশালী। সে সময় যদি কেউ বলত যে, এই গ্রুপটি ৫০ বছরের আসাদ সরকারের পতনের দিকে নিয়ে যেতে পারে, তখন নিজেদের মধ্যে হাসাহাসিও হতো। কিন্তু ২০১১ সালের যে বিপ্লবের সূচনা হয়, সেই বিপ্লবী জোশ আর এখনকার জোশ একরকম নয়। দীর্ঘ এ সময়ে নানা বাঁকবদল ও চড়াই-উতরাইয়ের ভেতর দিয়ে বা বিবর্তনের যুদ্ধক্ষেত্র বিদ্রোহীদের ব্যাপকভাবে করেছে পরিপক্ব। এ সময়ে এইচটিএস তার সুর নরম করেছে। অস্বীকার করেছে আলকায়দার সঙ্গে তার মূল সম্পর্ককে। কিন্তু এখনো এর মূলে রয়ে গেছে একটি কর্তৃত্ববাদী মডেল। এটি ইদলিবে একটি ডি ফ্যাক্টো আঞ্চলিক সরকারকে সমর্থন করতে রূপান্তরিত হয়েছে, যার রয়েছে একাধিক রাজস্ব ধারাসহ একটি বৃহত্তর যুদ্ধবাহিনী। এর রয়েছে বিদ্রোহী দলগুলোর একটি জোটের নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতা। ইতিমধ্যেই সামাজিক রক্ষণশীলতার একটি ঘাঁটি ইদলিবকে তাদের এ দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে নতুন আকার দেওয়া হয়েছে। সেখানকার শিশু ছেলেমেয়েদের আলাদা আলাদা স্কুলে কঠোরভাবে ধর্মের নামে উগ্রপন্থি পাঠ্যক্রম পড়ানো হয়।

এইচটিএস সব সিরিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করে না। তবে তারা প্রমাণ করেছে, তারা কৌশলগত উপায় অবলম্বন এবং সিরিয়ার ভূখণ্ডের অংশ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। এই অভ্যুত্থান আসাদের পতনের কৃতিত্বের পাশাপাশি সংস্থাটিকে ভবিষ্যতের সরকার ও তার নীতিনির্ধারণ ক্ষমতা দিয়েছে।

ভবিষ্যৎ রাষ্ট্র গঠনে সম্ভাবনাময় নানা উপাদান রয়েছে, যা সিরীয়দের আশাবাদী করতে পারে। আর এ সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে শুধু আসাদের প্রস্থানের ভেতর দিয়ে। সামরিক ও গোয়েন্দা পরিষেবার বাইরে রাষ্ট্রীয় আমলাতন্ত্র যথেষ্ট শক্তিশালীভাবে কাজ পরিচালনা করতে পারে। তারা প্রতিভাবান সিরিয়ান টেকনোক্র্যাটদের দেশে থাকার ব্যাপারে কাজ করতে পারে। পাশাপাশি তাদের মধ্যে যারা দেশের বাইরে রয়েছে, তাদের ফিরিয়ে আনার জন্য রাজি করাতে পারে এ আমলারা। সিরীয়দের একটি প্রজন্ম যারা যুদ্ধ শুরুর পর থেকে বিদেশে বসবাস করে, বিদেশে পড়াশোনা করেছে, তাদের দক্ষতা দেশের কাজে লাগাতে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নিতে পারবে তারা। তাদের শুধু এই নিশ্চয়তা দিতে হবে যে, রাজনৈতিক ইসলামের প্রতিশ্রুত চ্যাম্পিয়ন এইচটিএস যে দেশটি গড়ে তুলতে চাচ্ছে, তা হবে তাদেরই বিকাশ ও সমৃদ্ধির জায়গা। তাদের প্রাথমিক বিবৃতি নারীদের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দিয়েছে। বিদেশে থাকা সিরীয়দের ফিরতে উৎসাহিত করেছে। এই মুহূর্তে সিরিয়ার জনগণকে একটি জাতীয় ঐকমত্য তৈরি করতে হবে। একটি অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক চুক্তি তৈরি করতে হবে; যা দেশকে একত্রিত করতে পারে এবং সামনে এগিয়ে যাওয়ার গতির সঞ্চার করতে পারে।

সিরীয়রা বিগত ১৩ বছরে বিশৃঙ্খলা, সংঘর্ষ ও অস্থিতিশীল সময়ের মধ্যে দেখিয়েছে যে, দেশ গড়ে তোলার জন্য তাদের বাস্তবতাবোধ ও অভিযোজন ক্ষমতা রয়েছে। নাগরিক সমাজের সমন্বয়ে গড়ে তোলা হয় হোয়াইট হেলমেট ও লোকাল কোঅরডিশন কমিটি। এদের মতো নতুন নতুন প্রতিষ্ঠান মানবিক ত্রাণ বিতরণ, অনুসন্ধান ও উদ্ধার অভিযান পরিচালনা করার উদ্যোগ নেয়। আনুষ্ঠানিক সরকার নেই, এমন অঞ্চলেও আবর্জনা সংগ্রহ করা থেকে শুরু করে নানা কাজ পরিচালনা করতে উদ্যোগ নেয় নাগরিক সমাজ। দীর্ঘদিন ধরে সিরিয়ান প্রবাসীদের সমর্থিত দাতব্য ফাউন্ডেশনগুলো চিকিৎসাসেবা প্রদান করেছে। জুসুর, করম ফাউন্ডেশন এবং সিরিয়ান ইয়ুথ এমপাওয়ারমেন্টের মতো অন্য অনেক সংস্থা শিক্ষামূলক প্রোগ্রাম তৈরি করেছে। এর ফলে সিরিয়ার পেশাজীবীদের মধ্যে সৃষ্টি করেছে বিস্তৃত, বৈচিত্র্যময় নেটওয়ার্ক। যুদ্ধের মধ্যে এক দশকেরও বেশি সময় ধরে দেশ ও দেশের বাইরে থেকে যে জরুরি সহযোগিতার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল, তা এই মুহূর্তে দেশের জন্য ঐকমত্য এবং দেশের কল্যাণে একটি সাধারণ মনোভাব তৈরিতে কাজে লাগানো যেতে পারে। এরই মধ্যে সেই মনোভাব যে বিকশিত হয়েছে, তা বলাই বাহুল্য।

এত সব করার পরও সিরিয়ানরা ভালোভাবে জানে যে দেশটির তার নতুন চেহারা খুঁজে পাওয়ার পথে ঝুঁকিও রয়েছে তীব্র। মার্কিন ডলার ও তুর্কি লিরা হয়ে উঠেছে দেশটির সাধারণভাবে ব্যবহৃত মুদ্রা। ক্রান্তিকালীন ন্যায়বিচারের জন্য পরিকল্পনা তৈরির অনেক বছর গত হয়েছে। তবে এখন এসেছে উত্তরণের মুহূর্ত। কয়েক দশকের দুঃশাসনে অপরাধ, দুর্নীতি ও অপব্যবহারের জবাবদিহি বা তাকে কীভাবে ডিল করা হবে, সেই পরীক্ষা সম্মুখে। একটি বিশেষ ট্রাইব্যুনালের দাবি উঠতে পারে। তবে বড় কথা হচ্ছে, এ সময়ে সিরীয়দের সর্বোচ্চ সংযম দেখাতে হবে; যে কোনো প্ররোচনায় পা না দিয়ে বা ব্যক্তিগত প্রতিশোধের দিকে না গিয়ে পরিচয় দিতে হবে প্রজ্ঞার।

সিরীয়দেরও এখন আর্থসামাজিক হতাশা, ব্যাপক বাস্তুচ্যুতি এবং ক্যাপ্টাগন বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত মাদকের অপব্যবহারে জর্জরিত একটি দেশকে ঠিক করতে হবে। সবকিছু আনুষ্ঠানিকভাবে রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যে একীভূত করতে হবে। হাজার হাজার সিরিয়ান সশস্ত্রদের বিকল্প কাজের পথ তৈরি করাসহ বিস্তারিত পরিকল্পনা করতে হবে। উদ্যোগ নিতে হবে তাদের সশস্ত্র তৎপরতা নিষ্ক্রিয়করণে। সর্বোপরি এসব সশস্ত্র গ্রুপ যেন নিজেদের মধ্যে ভয়ংকর সংঘাতে লিপ্ত হতে না পারে, সেই ঝুঁকি ঠিকঠাকভাবে পরিচালনা করতে হবে। বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির স্বার্থে ক্ষমতা ও সম্পদের আগমন ঘটানোর যুদ্ধবাজদের অভাব নেই। সিরিয়ার দক্ষিণ ও উত্তরে সশস্ত্রগোষ্ঠী রয়েছে; যাদের স্বার্থের বিপরীতে গেলে এইচটিএসকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে এবং তাদের সে শক্তিও রয়েছে যথেষ্ট। যদি বাইরের শক্তিগুলো প্রতিযোগী গোষ্ঠীকে সমর্থন ও সহযোগিতার সিদ্ধান্ত নেয়, তবে তারা এরই মধ্যে যথেষ্ট ক্ষতিগ্রস্ত সিরীয়দের ব্যয়ে একটি চলমান প্রক্সি যুদ্ধের ঝুঁকি নেবে।

কয়েক দশক ধরে সিরিয়ান আরব প্রজাতন্ত্র ছিল নিষ্ঠুরভাবে নিয়ন্ত্রিত। কিন্তু এখন চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, পরিস্থিতি যেন তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে না যায়— তা নিশ্চিত করতে হবে। কিছু আশা নিশ্চয়ই আছে যে, এইচটিএস মানুষের বসবাস ও ভারসাম্যের পথ অনুসরণ করবে। সব চ্যালেঞ্জ থাকা সত্ত্বেও সিরীয়দের সেই ভারসাম্য তৈরি এবং তাদের নিজস্ব ভবিষ্যৎ গঠন করার সুযোগ দেওয়া উচিত।

লেখক: সাংবাদিক। অ্যাপ্লাইড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এপিআরআই) সভাপতি। নিউজ ডিপলি এবং এর উদ্বোধনী প্ল্যাটফর্ম সিরিয়া ডিপলির সহপ্রতিষ্ঠাতা। এবিসি নিউজ ও ব্লুমবার্গ টেলিভিশনের মধ্যপ্রাচ্যের সাবেক রিপোর্টার। নিবন্ধটি আরব নিউজের মতামত বিভাগ থেকে ভাষান্তর করেছেন সঞ্জয় হালদার

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

চেম্বার জজ আদালতের রায়ের বিষয়ে শিশির মনিরের প্রতিক্রিয়া

ডা. মুরাদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা

মেসি শেষ কবে ফাইনাল হেরেছিলেন?

শেষ ম্যাচেও হার, এশিয়া কাপ থেকে ছিটকে গেল বাংলাদেশ

পবিপ্রবির ১৪ কর্মকর্তার নিয়োগে অনিয়ম তদন্তে দুদক

ফেনীতে দাবদাহে পুড়ছে জনপদ, জনজীবনে স্থবিরতা

অবরোধে ঢাকা-ময়মনসিংহ রেল চলাচল বন্ধ

৯ তারিখেই ডাকসু নির্বাচন চান ভিপি প্রার্থী শামিম

৩০ জুলাইয়ের ভাঙা কাচের ছবি নিয়ে বামজোট প্রার্থীর ব্যাখ্যা

আফগানিস্তানে সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত একটি গ্রাম, নিহত ছাড়াল ৮০০

১০

ডাকসু নির্বাচন নিয়ে হাইকোর্টের আদেশ স্থগিত

১১

দুই ম্যাচ খেলেই চাকরি গেল সাবেক ম্যানইউ কোচের

১২

চবিতে সংঘর্ষ : হাসপাতালে ভর্তি ১২ শিক্ষার্থী, দুজন লাইফ সাপোর্টে

১৩

ডাকসু নির্বাচন স্থগিত করে যে নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট

১৪

স্কুলের সামনেই প্রাণ গেল শিক্ষার্থীর, মিষ্টি খাওয়ায় ব্যস্ত শিক্ষকরা

১৫

ডাকসু স্থগিতের প্রতিবাদে শহীদুল্লাহ হল থেকে শিক্ষার্থীদের মিছিল

১৬

ডাকসু নির্বাচন স্থগিতের বিষয়ে কী হবে জানালেন শিশির মনির

১৭

মালয়েশিয়ায় সড়ক দুর্ঘটনায় দুই বাংলাদেশির মৃত্যু

১৮

দুধ দিয়ে গোসল করে জুয়া খেলা ছাড়লেন যুবক

১৯

শিশুদের জন্য লবণ কতটুকু প্রয়োজন, যা বলছেন পুষ্টিবিদ

২০
X