কাজী বনফুল
প্রকাশ : ১৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ০২:৫৯ এএম
আপডেট : ১৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৮:২৯ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

আরব বসন্ত ও বাশার আল-আসাদের পতন

আরব বসন্ত ও বাশার আল-আসাদের পতন

বসন্ত শুধুমাত্র বৃক্ষ, লতাপাতা, ফুল ও ফলের গায়েই তার নতুনত্বের গীতচক্র নির্মাণ করে না; বসন্ত মাঝেমধ্যে রাষ্ট্র দেশ এমনকি পৃথিবীকেও নব-কল্লোলে ভেঙে চুরমার করে আবার নতুন করে সাজিয়ে তোলে। ঠিক তেমনি এক বসন্তের নাম আমরা সেই কৈশোর থেকেই বারবার শুনে শুনে বেড়ে উঠেছি। সে বসন্তের নাম হচ্ছে আরব বসন্ত, যা মূলত আরব তথা মধ্যপ্রাচ্যের নবজাগরণেরই বহিঃপ্রকাশ। সেই আরব বসন্তের মর্মর ধ্বনির কম্পিত ঝাঁকুনির দোলায় অবশেষে ঝরে পড়ছে পৃথিবী বৃক্ষের সিরিয়ার বাশার আল-আসাদ নামক হলুদ পাতাটিও। সিরিয়ার প্রেসিডেন্টকে ঘিরে দীর্ঘ সময় ধরে চলমান দেশটির সংকটের অবশেষে অবসান হলো তার পতনের মধ্য দিয়ে।

সালটা তখন ২০১০-এর শেষের দিক, আমরা তখন কৈশোরের দুরন্ত কিশোরপনায় নবযৌবনের আগমনী বার্তায় দোল খেয়ে খেয়ে বেড়ে উঠছি, ঠিক সেই মুহূর্তে বারবার যে শব্দটি কানে এসে বেজেছে সেটি হচ্ছে—আরব বসন্ত নামক এক নবজাগরণের মানব সৃষ্ট সমীরণের সম্মিলিত মুক্তির চিৎকার, যা মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে ক্রমাগত ছড়িয়ে পড়ে। আরব বসন্ত মূলত আরব অঞ্চলের বিভিন্ন দেশের গণজাগরণকে বোঝায়। জনগণ যখন সেসব রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে পুরাতন সরকার পরিবর্তন করে নতুন সরকার ব্যবস্থার জন্য সংগ্রামে লিপ্ত হয়ে ওঠে, তখনই একনাগাড়ে তার নামকরণ করা হয় আরব বসন্ত। যেহেতু এ গণজাগরণ আরবের বসন্তকাল থেকেই শুরু হয়েছিল, তাই এ গণআন্দোলনের নামকরণ করা হয়েছিল আরব বসন্ত। জীবনযাত্রার ব্যয়বৃদ্ধির প্রতিবাদে ২০১০ সালের ১৭ ডিসেম্বর তিউনিশিয়ার মোহাম্মদ বোয়াজ-জি নামের এক তরুণ সবজি বিক্রেতা আগুন দেন নিজের শরীরে। পরবর্তীকালে সেই তরুণ ২০১১ সালের ৪ জানুয়ারি মারা যান। তার সেই আত্মত্যাগ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ও বিশ্ব মিডিয়া থেকে শুরু করে সব মানব আত্মোপলব্ধিতে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে এবং সূত্রপাত ঘটায় প্রেসিডেন্ট জয়নাল এন আবেদিন বিন আলির বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলনের। মাত্র দশ দিনের মাথায় পুড়ে ছারখার হয়ে যায় বেন আলির ২৩ বছরের সাজানো মসনদ। পরে সৌদি আরব পালিয়ে যেতে বাধ্য হোন তিনি, যা ছিল সমগ্র আরব বিশ্বের প্রথম কোনো শাসকের গণআন্দোলনের মুখে অনিবার্য পতন। সেই থেকেই শুরু এ ক্রমধারা সমগ্র আরব বিশ্বে প্রচণ্ড ঝাপটায় ছড়িয়ে পড়ে প্রতিটি আনাচে-কানাচে। এরপর মিশরের হোসনি মোবারক, লিবিয়ার ৪২ বছরের মজবুত গাঁথুনিতে পোক্তভাবে গেঁথে থাকা গাদ্দাফি ও ইয়েমেনের আলি আবদুল্লাহর পতন হয় সেই বসন্তের প্রবাহের ধারায়।

পরবর্তীকালে ২০১১ সালের ৬ মার্চ দক্ষিণ সিরিয়ার এক স্কুলের দেয়ালে মুয়াবিয়া নামে এক কিশোর ছোট্ট একটি বাক্য লিখে রাখে। বাক্যটির বাংলা অর্থ করলে যার তর্জমা দাঁড়ায়—‘ডাক্তার এবার তোমার পালা’; যা অনেকটা বাংলা সিনেমার ডায়লগের মতো। বাক্যটি দেখে বাশার আল-আসাদ সরকারের সেনাবাহিনী তাকে খুঁজে বের করতে চিরুনি অভিযান চালায়। অনেক খোঁজাখুঁজির পরও তাকে খুঁজে না পেয়ে অবশেষে সন্দেহের বশে সেখানকার ১৫ জন কিশোরকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয় এবং তাদের ওপর অমানবিক নির্যাতন করা হয়। যার ফলে ধীরে ধীরে রাস্তায় নামে মানুষ এবং তা গণআন্দোলনে রূপ নেয়। শুরু হয় প্রচণ্ড যুদ্ধ, যা ধীরে ধীরে গৃহযুদ্ধে রূপ নেয়। তৎকালীন সময়ে সেই ছোট্ট একটি ঘটনা কেন্দ্র করে প্রাণ যায় প্রায় চার লাখ মানুষের। কিন্তু সেই সময় রাশিয়া ও ইরানের সমর্থনে টিকে যায় বাশার আল-আসাদের মসনদ। ২০১১ সালের সেই গণজোয়ার সামলে নিলেও এ যাত্রায় আর পারলেন না তিনি। মাত্র ১২ দিনের মাথায় তাকে দীর্ঘ সময় ধরে আঁকড়ে থাকা মসনদ ছেড়ে পালাতে হলো অবশেষে।

বাশার আল-আসাদ মূলত একজন চক্ষু চিকিৎসক। মানুষের চোখের চিকিৎসা তিনি হয়তো করতে পারেন কিন্তু একজন রাষ্ট্রপ্রধান হতে হলে তাকে জনগণের চোখের ভাষাও বুঝতে-শিখতে হয় কিন্তু তিনি সেটা অর্জন করতে ব্যর্থ হন। বাশার আল-আসাদ কখনোই তার জনগণের চোখের ভাষা বুঝতে চেষ্টা হয়তো করেননি। তিনি যদি জনগণের চোখের ভাষা বোঝার চেষ্টা করতেন, তাহলে তার পরিস্থিতি হয়তো এমন শোচনীয় হতো না। তিনি যেটা করেছেন সেটা হচ্ছে, রাষ্ট্রের জনগণকে উপেক্ষা করে রাশিয়ার ওপর ভর করে টিকে থাকার চেষ্টা করেছেন। বাশারের পতনের পর সিরিয়ার বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে একটি বিবৃতি প্রকাশ করেছে রুশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘মস্কো গভীর উদ্বেগের সঙ্গে সিরিয়ার ঘটনাবলি পর্যবেক্ষণ করছে’ এবং আরও বলা হয়, ‘আসাদ সরকারের পতন কিন্তু রাশিয়ার মর্যাদার ওপর আঘাত’। রাশিয়ার প্রচণ্ড চেষ্টার পরও বাশার আল-আসাদের এমন কোণঠাসাপূর্ণ পতনে রাশিয়া অনেকটা বিপর্যস্ত, যা তাদের বক্তব্যের মধ্যে স্পষ্ট। এখন কথা হচ্ছে, রাষ্ট্রের জনগণ যাকে চায় না তাকে অন্য রাষ্ট্র কতদিন এবং কীভাবে টিকিয়ে রাখবে, যা বাশার আল-আসাদের এমন বিপর্যয়পূর্ণ পতনের মধ্য দিয়ে বিষয়টি পরিষ্কারভাবে ফুটে উঠেছে।

আমার নানিকে মাঝেমধ্যেই একটা বাংলা প্রবাদ আওড়াতে শুনি—‘আসলে মুষল নাই ঢেঁকিঘরে চাঁদোয়া’, মুষল হচ্ছে ঢেঁকির মোনা অর্থাৎ মুগুরের মতো যে অংশটি ঢেঁকির গড় বা গর্তে পতিত হয়ে শস্য ভানে বা কুটে। ঢেঁকির কাজই হচ্ছে শস্য ভানা কিন্তু এজন্য মোনার প্রয়োজন সর্বাধিক মুষল বা মোনা ছাড়া ঢেঁকি অচল। সে ঢেঁকিতে যে প্রধান কর্তা মুষল তার কোনো ঠিক নেই অথচ ঢেঁকিঘর পরিপাটি করে কাজের জন্য সাজিয়ে রাখা সে ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ অর্থহীন। ঠিক এমনটিই ঘটেছে বাশার আল-আসাদের ক্ষেত্রেও। তিনি নিজের দেশের জনগণের মনস্তাত্ত্বিক প্রয়োজন, তাদের চাওয়া-পাওয়া না বুঝে শুধু রাশিয়ার ওপর ভর করে দেশ শাসন করতে চেয়েছে। তার রাষ্ট্রের মূল রসদ যারা, মূল শক্তি যারা, তাদের সঙ্গে বাশার আল-আসাদের কোনো ধরনের কোনো যোগাযোগ ও সম্পর্কের প্রয়োজনীয়তার বালাই ছিল না বললেই চলে অথচ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে অপ্রয়োজনীয় বিষয়ের ওপর, যার ফল আমরা এরই মধ্যে প্রত্যক্ষ করেছি।

২০১১ সালে শুরু হওয়া সেই বিদ্রোহের মধ্য দিয়ে সংঘটিত সংঘর্ষে সিরিয়ায় এ যাবৎ মৃত্যুর পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় পাঁচ লাখের কাছাকাছি। ঘরবাড়ি ছাড়া ও বাস্তুচ্যুত হয়েছে লাখ লাখ মানুষ। মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ও শারীরিকভাবে অক্ষম হয়েছে লাখ লাখ মানুষ। এই যে এত এত প্রাণ বিসর্জন, এত এত দুঃখ-কষ্টের অবর্ণনীয় দুর্ভোগপূর্ণ জীবনের জন্য কারা দায়ী। যারা নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য জোরপূর্বক টিকিয়ে রাখতে চেয়েছে বাশার আল-আসাদকে। রাষ্ট্রের রাজা যদি রাষ্ট্রের মূলমন্ত্র থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, তাহলে সেখানে সংঘাত অনিবার্য হয়ে ওঠে প্রাণ যেখানে শুধু একটি সংখ্যা হয়ে দাঁড়ায় মাত্র, যেটা আমরা বাশার আল-আসাদের শাসনের মধ্যে স্পষ্টভাবে প্রত্যক্ষ করেছি।

সিরিয়ার মানুষ এরই মধ্যে একটি দীর্ঘ যুদ্ধ ও সংগ্রামপূর্ণ জীবন অতিবাহিত করেছে। আমরা চাইব সিরিয়ায় যেন আর কোনো প্রাণহানি না ঘটে। নতুন যারা সিরিয়ার দায়িত্ব পালন করবেন, তারা অবশ্যই সব গণমানুষের কথা বিবেচনা করে সিরিয়ার সব সংকটাবস্থা দূরীভূত করে শান্তি ও স্বাভাবিক জীবনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য সামগ্রিকভাবে কাজ করবেন।

লেখক: প্রাবন্ধিক

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

তারেক রহমানের বিরুদ্ধে আপত্তিকর মন্তব্যের প্রতিবাদে বিক্ষোভ

‘স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগ মানুষের ভালো থাকার জন্য হতে হবে’

ভারতে জরুরি অবস্থা জারির নির্দেশ

লুকিয়ে রাখা ২৯ কেজি ওজনের বিষ্ণুমূর্তি উদ্ধার, গ্রেপ্তার ৩ 

হাসনাতের ফেসবুক পোস্টে ৩ দাবি

যানজট ও দুর্ঘটনা রোধে মাঠে ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা

রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ডের অভিযোগে জবি শিক্ষার্থী ৩ দিনের রিমান্ডে

মুসলিম বিশ্বে বাংলাদেশকে পরিচিত করেছে ‘সোনারগাঁ’ : মামুনুল হক

‘এ দেশে আ.লীগের নেতাকর্মীদের ভাত নেই’ 

ফিল্ম আর্কাইভে জাতীয় চলচ্চিত্র সংসদের সম্মেলন

১০

‘শাহবাগে বড় স্ক্রিনে দেখানো হবে জুলাই গণহত্যার ডকুমেন্টারি’

১১

নাসিরনগরে দুপক্ষের সংঘর্ষে কৃষক নিহত 

১২

‘সবাইকে কমফোর্ট জোন থেকে বেরিয়ে এসে একযোগে কাজ করতে হবে’

১৩

ভারতের ৩৬ জায়গায় পাকিস্তানের ৪০০ হামলা

১৪

কর্ণফুলীর তীরে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের নির্দেশ সিএমপি কমিশনারের

১৫

অভিযোগও ভারতের, রায়ও ভারতের, হামলাও ভারতের : পাকিস্তান সেনার মুখপাত্র

১৬

আ.লীগের কেন্দ্রীয় উপ-কমিটির সদস্য সাগর গ্রেপ্তার

১৭

ঐক্যবদ্ধ শাহবাগ বিএনপির অপেক্ষায় : সারজিস

১৮

‘এই দেশ কোনো ব্যক্তি বা দলের নয়, জণগণের’

১৯

পাকিস্তানের পাশে দাঁড়াল আরও এক মুসলিম দেশ

২০
X