দেবেশ রায় প্রখ্যাত বাঙালি কথাসাহিত্যিক। তিনি বাংলা সাহিত্যে একজন ছকভাঙা আধুনিক ঔপন্যাসিক হিসেবে সমাদৃত। কথাসাহিত্যিক দেবেশ রায়ের জন্ম ১৯৩৬ সালের ১৭ ডিসেম্বর পাবনা জেলার বাগমারা গ্রামে। পিতা ক্ষিতীশ রায় ও মাতার নাম অপর্ণা রায়। তার পরিবার ১৯৪৩ সালে জলপাইগুড়ি চলে যায়। ১৯৭৯ থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত এক দশক দেবেশ রায় ‘পরিচয়’ পত্রিকা সম্পাদনা করেন। তার বেড়ে ওঠা উত্তরবঙ্গে। ছাত্রজীবন থেকেই তিনি ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির সর্বক্ষণের কর্মী ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ার সময় প্রত্যক্ষ বাম রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। রাজনীতির সূত্রে শিখেছিলেন রাজবংশী ভাষা। কলকাতা শহরেও ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনি সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোশ্যাল সায়েন্সে একজন গবেষণা সহকর্মী ছিলেন। তার প্রথম গল্প প্রকাশিত হয় ১৯৫৩ সালে জলার্ক পত্রিকায়। তার প্রথম উপন্যাস যযাতি। কলকাতায় থাকাকালে সক্রিয়ভাবে ট্রেড ইউনিয়ন করায় শ্রমিক সমাজের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। এসবের পাশাপাশি সাহিত্যচর্চা করতেন। ‘আহ্নিক গতি ও মাঝখানের দরজা’, ‘দুপুর’, ‘পা’, ‘কলকাতা ও গোপাল’, ‘পশ্চাৎভূমি’, ‘ইচ্ছামতী’, ‘নিরস্ত্রীকরণ কেন’ ও ‘উদ্বাস্তু’—এই আটটি গল্প নিয়ে বেরিয়েছিল তার প্রথম গল্পের সংকলন। ‘তিস্তাপারের বৃত্তান্ত’ তার সবচেয়ে জনপ্রিয় উপন্যাস। তার রাজনৈতিক বীক্ষার ছাপ রয়েছে এ উপন্যাসে। রয়েছে উত্তরবঙ্গের জীবনের বহতা ধরা। বাস্তববাদী উপন্যাসের প্রচলিত ছক থেকে সরে গিয়ে বহুস্বরকে নিয়ে আসেন। এ উপন্যাসের জন্যই ১৯৯০ সালে তিনি সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার পান। তার অর্ধশতকের বেশি সাহিত্য জীবনে উল্লেখযোগ্য বইগুলো হলো—যযাতি, আপাতত শান্তিকল্যাণ হয়ে আছে, মানুষ খুন করে কেন (১৯৭৬), মফস্বলী বৃত্তান্ত (১৯৮০), সময় অসময়ের বৃত্তান্ত (১৯৯৩), তিস্তাপারের বৃত্তান্ত (১৯৮৮), তিস্তা পুরাণ, প্রতিবেদন, ইতিহাসের লোকজন, বরিশালের যোগেন মণ্ডল, ইউসুফ জুলেখা, সাংবিধানিক এজলাস (২০১৯), লগন গান্ধার (১৯৯৫) ইত্যাদি। তার অনুবাদ গ্রন্থ—রোমিও জুলিয়েট ও ট্র্রয়ের মেয়েরা। প্রধান প্রবন্ধের বই—রবীন্দ্রনাথ ও তার আদি গদ্য, সময় সমকাল, উপন্যাস নিয়ে, উপন্যাসের নতুন ধরনের খোঁজে, শিল্পের প্রত্যহে, উপনিবেশের সমাজ ও বাংলা সাংবাদিক গদ্য, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়: নিরন্তর মানুষ ও উপন্যাসের বিবিধ সংকট অন্যতম। বাংলা সাহিত্যের অন্যতম এই ঔপন্যাসিক বাংলাদেশেও সমান পরিচিত ছিলেন তার সাহিত্যকর্ম দিয়ে। কথাসাহিত্যে তার বয়ান আলাদা করে চিত্রিত করেছে তাকে। ঢাকার সাহিত্য নিয়ে দেবেশ রায়ের উচ্ছ্বাসও ছিল অনেক। তিনি বিভিন্ন পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ ‘সেতুবন্ধন’ পত্রিকা সম্পাদনার কাজে ব্যস্ত ছিলেন। ২০২০ সালের ১৪ মে কলকাতায় তার জীবনাবসান ঘটে।