ঢাকার কেরানীগঞ্জের আব্দুল্লাহপুর টোল প্লাজায় গতকাল শুক্রবার বাইকের পেছনে ছিল এক ভদ্রলোকের স্ত্রী আর সাত বছরের সন্তান। টাকা দেওয়ার সময় সন্তান বাবার কাছে আবদার করে, ‘বাবা আমি টাকা দেব’। বাবা সন্তানের হাতে টাকা দেন! ঠিক তখনই পেছন থেকে ছুটে আসা দ্রুতগতির বাস সবকিছু স্তব্ধ করে দেয়। কাকতালীয়ভাবে বাবা বেঁচে গেলেও তার চোখের সামনে মারা যায় স্ত্রী আর সন্তান। ভদ্রলোক ঘটনার বিবরণ দিতে গিয়ে বললেন, ‘আমি তাকিয়ে দেখি আমার সন্তানের মাথার ওপর দিয়ে বাসের চাকা চলে গেছে। আমার সন্তানের চোখ বেরিয়ে গেছে। আর আমার বিবিকে চাকার সঙ্গে বিঁধে টেনে নিয়ে গেছে।’ সড়কে এভাবে মৃত্যুর মিছিল কবে বন্ধ হবে? কবে আমরা সচেতন হতে পারব—তার কোনো উত্তর আছে?
একটি দুর্ঘটনা সারা জীবনের কান্না হয়ে রয়ে যায়। অথচ সেই দুর্ঘটনা ঘটছে অহরহ, অবিরত। দেশে প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনার হার বেড়েই চলছে। প্রতিদিন রক্তাক্ত হচ্ছে সড়ক। ঝরছে অসংখ্য প্রাণ। প্রতিদিন টিভি বা পত্রিকার পাতা উল্টালে অসংখ্য সড়ক দুর্ঘটনার খবর চোখে পড়ে। দুর্ঘটনা রোধে আইনকানুন ও বিভিন্ন বিধিনিষেধ থাকলেও তা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হচ্ছে না।
বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় এক বছরে ৩ লাখের বেশি মানুষ আহত হয়েছে। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির জরিপ অনুযায়ী, গত ১০ বছরে দেশে ৬০ হাজার ৯৮০টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। যাতে ১ লাখ ৫ হাজার ৩৩৮ জন নিহত এবং ১ লাখ ৪৯ হাজার ৮৪৭ জন আহত হয়েছে। এভাবে আর কত! কবে বন্ধ হবে সড়কে মৃত্যুর এ মিছিল?
চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত ১ হাজার ৪৬৪ সড়ক দুর্ঘটনায় ১ হাজার ৩৬৭ জন নিহত ও ১ হাজার ৭৭৮ জন আহত হয়। ২০২৩ সালের প্রথম তিন মাসে দুর্ঘটনার সংখ্যা ছিল ১ হাজার ১৭ এবং এতে ১ হাজার ৫১ জন নিহত ও ১ হাজার ৪৪০ জন আহত হয়। সড়ক দুর্ঘটনার তথ্য নিয়ে গত বছরের জানুয়ারিতে বিআরটিএ প্রথম প্রতিবেদন প্রকাশ শুরু করে। বিআরটিএ প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত আগস্ট মাসে ২১৪টি সড়ক দুর্ঘটনায় ২৩১ জন নিহত হয়। আহত হয় ২৮৩ জন। এভাবে বেড়েই চলেছে সড়ক দুর্ঘটনা এবং মৃত্যুর হাহাকার।
সরকারি তত্ত্বাবধানে পরিচালিত এক জরিপে দেখা গেছে, দেশে প্রতিদিন গড়ে ৬৪ জন মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারাচ্ছে। গবেষণায় দেখা গেছে, ৯০ শতাংশ সড়ক দুর্ঘটনার জন্য দায়ী যানবাহনের অতিরিক্ত গতি এবং চালকের বেপরোয়া মনোভাব। এ ছাড়া ফিটনেসবিহীন যানবাহন ও পণ্যবাহী গাড়িতে যাত্রী বহন, পণ্যবাহী যানবাহন বন্ধের সিদ্ধান্ত অমান্য করা, অদক্ষ চালক ও হেলপার দিয়ে যানবাহন চালানো, চালকরা অনেক সময় ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত অবস্থায় গাড়ি চালান। ফলে একসময় নিজের অজান্তেই নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটিয়ে ফেলেন।
সড়ক দুর্ঘটনার নানাবিধ কারণ রয়েছে। সড়ক দুর্ঘটনার মূল কারণ গাড়িচালকদের বেপরোয়া মনোভাব। গাড়িচালকরা যখন গাড়ির স্টিয়ারিংটা ধরেন, তখন তারা নিজেদের রাজা ভাবেন। গতির নির্দিষ্ট সীমারেখা থাকা সত্ত্বেও তারা তা মানতে নারাজ। কেউ কেউ তো আছেন, যারা বিভিন্ন ধরনের নেশাদ্রব্য গ্রহণ করেই গাড়ি চালান। ফলে জরুরি অবস্থায় তাৎক্ষণিকভাবে গাড়ি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয় না তাদের পক্ষে। গতকালের কেরানীগঞ্জের আব্দুল্লাহপুর টোল প্লাজার মর্মান্তিক দুর্ঘটনাই বলে দেয় ড্রাইভারদের এমন চিত্র। আরেকটি লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, রাস্তায় গাড়িচালকদের মধ্যে প্রতিযোগিতা দেখা যায়। এ কারণেও ঘটে অনেক দুর্ঘটনা। আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল না হওয়ার ফলেও বাড়ছে দুর্ঘটনা। পথচারী কিংবা চালক কেউ-ই মানতে চায় না আইন। আর কত প্রাণ শেষ হলে আমরা সতর্ক হবো।
বাংলাদেশে একটি সাধারণ বিষয় হচ্ছে, যেখানে-সেখানে গাড়ি পার্ক করা। অনেক মানুষ আছেন যারা গাড়ি কিনে ভাড়া দেন। কিন্তু যে গাড়িটি নিয়ে যায়, সে অদক্ষ, মাদকাসক্ত, অপ্রাপ্তবয়স্কও হতে পারে, সেদিকে খেয়াল থাকে না গাড়ির মালিকের।
আমরা সড়কে আর মৃত্যু দেখতে চাই না। এজন্য সড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হবে। সিটবেল্ট বাঁধাতে হবে। নিরাপদ ড্রাইভিংয়ের জন্য মনোযোগ থাকতে হবে। অদক্ষ চালক দিয়ে গাড়ি চালানো বন্ধ করতে হবে। কারণ বেশি দুর্ঘটনা ঘটে থাকে অদক্ষ চালকের জন্য।
হুটহাট গাড়ির গতি বাড়ানো বা কমানোর ফলে বড় দুর্ঘটনার কারণ হয়। গাড়ির গতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। অনেক সময় ওভারটেকিং করার জন্য প্রতিযোগিতা করে অনেক ড্রাইভার গাড়ি চালিয়ে থাকে। এটি সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ। প্রতিটি গাড়ির দুটি লুকিং গ্লাস থাকতে হবে। নেশাগ্রস্ত অবস্থায় গাড়ি চালানো বন্ধ করতে হবে। পাশাপাশি আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে হতে হবে দায়িত্বশীল ও কঠোর।
সর্বোপরি সড়কে দুর্ঘটনা রোধে সবাইকে সতর্ক ও সচেতন থাকতে হবে। আমাদের মনে রাখা উচিত, সময়ের চেয়ে জীবনের মূল্য অনেক বেশি।
সাকিবুল হাছান, শিক্ষার্থী, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ
ঢাকা কলেজ, ঢাকা