ইনাম আহমদ চৌধুরী
প্রকাশ : ১৬ জানুয়ারি ২০২৫, ০৩:১০ এএম
আপডেট : ১৬ জানুয়ারি ২০২৫, ০৮:০১ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

মানবদরদি জিমি কার্টার

মানবদরদি জিমি কার্টার

প্রয়াত প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার যখন ১৯৭০ সালের ২০ জানুয়ারি কার্যভার ত্যাগ করলেন, তখন জনপ্রিয়তার সূচকে আমেরিকানদের কাছে তার অবস্থান বেশ নিচেই ছিল বলা চলে। তবে যতই কাল উত্তীর্ণ হতে থাকল, শুধু আমেরিকা নয়, সারা পৃথিবীতেই তার গ্রহণযোগ্যতা ও জনপ্রিয়তা ক্রমবর্ধমান হতে থাকল। আজ যখন এই শতবর্ষী প্রবীণ রাজনীতিক চিরবিদায় নিলেন, পৃথিবীবাসী উপলব্ধি করল জনমানুষের কাছে শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও স্বীকৃতিত্বের সোপানে তার স্থান কত উঁচুতে।

তার জন্ম জর্জিয়ার একটি চীনাবাদাম উৎপাদনকারী পরিবারে—সচ্ছল, মধ্যবিত্ত, ধর্মাশ্রয়ী। কার্টার ইউএস নৌবাহিনী একাডেমি থেকে স্নাতকোত্তর হয়ে যোগ দিলেন নেভির সাবমেরিন সার্ভিসে। বাবর মৃত্যুতে চাকরি ত্যাগ করে এসে যোগ দিলেন পারিবারিক কৃষিকর্মে; আর শুরু করলেন ডেমোক্রেটিক পার্টির স্টেট পর্যায়ের রাজনীতি। সিভিল রাইটস মুভমেন্ট (গণঅধিকার আন্দোলন) এবং বর্ণ-জাতিগত বৈষম্য দূরীকরণের আন্দোলনে পুরোমাত্রায় যোগ দেওয়ার মাধ্যমেই ডেমোক্রেট পার্টির মনোনয়নে তিনি জর্জিয়ার সিনেটে নির্বাচিত হলেন। তার পর তিনি যখন জর্জিয়ার গভর্নর নির্বাচিত হলেন (১৯৭১-৭৫), তখনই শুরু করলেন প্রেসিডেন্সিয়াল নির্বাচনের প্রস্তুতি। কার্টার যখন ডেমোক্রেটিক দলীয় মনোনীত প্রার্থী হিসেবে দায়িত্ব পালনরত রিপাবলিকান প্রার্থী জেরাল্ড ফোর্ডকে পরাজিত করে আমেরিকার ৩৯তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেন, তার আন্তর্জাতিক পরিচিতি ছিল অতি নগণ্য।

অবশ্য বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠা, মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরোধিতা করা এবং সামাজিক-সার্বিক সুবিচার কায়েম করা তার জীবনের মূলমন্ত্র ও পরম লক্ষ্য হিসেবে তিনি গ্রহণ করেছিলেন। প্রেসিডেন্ট হিসেবে তার ২২ কর্মদিবসেই তিনি ভিয়েতনাম যুদ্ধের ‘draft evaders’দের রাষ্ট্রীয় ক্ষমা (Pardon) করে দেন। ভিয়েতনাম যুদ্ধকে তিনি অনৈতিক বলেই বিবেচনা করেছিলেন। পানামা খাল চুক্তি সম্পন্ন করে তিনি ক্ষুদ্র ও দুর্বল রাষ্ট্র পানামাকে বরং তাদের সার্বভৌম অধিকার খাটিয়ে নিজস্ব দেশীয় স্বার্থ রক্ষার জন্য উৎসাহিত করেন। সম্প্রতি আমরা অবশ্য ডোনাল্ড ট্রাম্পের পানামাকে প্রদত্ত সাবধানবাণী শুনেছি—যদি পানামা ক্যানেল পরিচালনায় যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থহানির কোনো সম্ভাবনা দেখা দেয়, তাহলে এর পরিণাম হবে মারাত্মক। অর্থাৎ একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র পানামাকে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থানুকূল কার্যক্রমের কোনো হানি হয়, এমন কিছু করতে দেওয়া হবে না। নির্ভীক হয়ে ন্যায়ের পক্ষে সোচ্চার হতে তিনি কখনো অপারগ হননি। স্মরণ করা যেতে পারে, ১৯৭১ সালের ১২ জানুয়ারি কার্টার যখন জর্জিয়ার গভর্নর হিসেবে শপথ গ্রহণ করলেন, তিনি ঘোষণা করলেন—জাতি-বর্ণগত বৈষম্যের আজ অবসান হলো (জর্জিয়ায়)। তখন কিন্তু তার দলেই বৈষম্য সমর্থক জনগণের যথেষ্ট প্রাধান্য ছিল।

এই ক্ষুদ্র পরিসরে আমি অবশ্য কার্টার প্রেসিডেন্সির কোনো বিশ্লেষণধর্মী বিবরণ করতে চেষ্টা করছি না। ঐতিহাসিকরা তাকে একজন সফল প্রেসিডেন্ট হিসেবে ধর্তব্য জ্ঞান করেননি।

যেসব কারণে তার প্রেসিডেন্সি বিশেষ সফল বা জনপ্রিয় হতে পারেনি, তার মধ্যে রয়েছে আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক মন্দা, অভ্যন্তরীণ ক্রমাগত মুদ্রাস্ফীতি ও মুদ্রা সংকোচন, ১৯৭৯ সালের পাওয়ার-বিভ্রাট (energy problem) এবং ইরানে হোস্টেজ ক্রাইসিস। কিন্তু তার উল্লেখযোগ্য সাফল্যও রয়েছে যেমন—মিশর ও ইসরায়েলের সঙ্গে ক্যাম্প ডেভিড স্বাক্ষর, যা তাকে নোবেল শান্তি পুরস্কারে ভূষিত করল, পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ SALT চুক্তি, যা সোভিয়েত নেতা লিওনিড ব্রেজনেভের সঙ্গে স্বাক্ষরিত হলো। পানামা চুক্তির কথা তো আগেই বলেছি। দুর্ভাগ্যবশত কংগ্রেসের সঙ্গে তার সৌহার্দ্য ছিল না, সহযোগিতারও ছিল অভাব। তবুও তার প্রেসিডেন্সির প্রথম দিকে কংগ্রেসের আনুকূল্যেই তার প্রতিশ্রুত একটি ফেডারেল সমন্বিত শিক্ষা বিভাগ গড়ে তুলতে পেরেছিলেন, যার অনুপস্থিতি শিক্ষানুরাগী অনেককেই পীড়া দিচ্ছিল। তার প্রেসিডেন্সির সময়েই আমেরিকা ফরেন সার্ভিসসহ সব ফেডারেল সরকারি ও সহযোগী সংস্থাতে সব ধরনের লিঙ্গবৈষম্য (তৃতীয় লিঙ্গসহ) দূরীভূত হয়।

কার্টার ছিলেন একজন আদর্শবাদী স্বাপ্নিক এবং সব রকম বৈষম্যের বিরুদ্ধে আজীবন লড়াই করে গেছেন। তার ছিল অটল নীতিনিষ্ঠা, চারিত্রিক দৃঢ়তা এবং মজলুমের প্রতি আন্তরিক দরদ। যুদ্ধবিহীন সংঘর্ষমুক্ত পৃথিবীর স্বপ্ন তিনি দেখেছেন চিরকাল। কাল্পনিক ‘মানুষবিধ্বংসী অস্ত্র—মারণাস্ত্র’ সন্ধানের মিথ্যা অজুহাতে প্রেসিডেন্ট বুশ এবং ব্রিটেনের ব্লেয়ার মধ্যপ্রাচ্য, বিশেষ করে ইরাকে যে মানবতাবিরোধী নৃশংস ধ্বংসকাণ্ড চালিয়েছিলেন, তার প্রতিবাদে কার্টার ছিলেন সোচ্চার। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন, আমেরিকার এই প্রশাসন (বুশ) পৃথিবীতে যে প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে, তা ইতিহাসের নিকৃষ্টতম।

কার্টার সর্বান্তঃকরণে এবং দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন প্যালেস্টানিয়ানদের তাদের স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে স্বদেশে বেঁচে থাকার পরিপূর্ণ অধিকার রয়েছে। ইসরায়েলি ও তাদের কুচক্রী দোসরদের প্যালেস্টাইন অধিকার, গণহত্যা এবং মানবতাবিরোধী কার্যক্রমের তিনি ছিলেন ঘোরতর বিরোধী।

২০০৬ সালে প্রকাশিত এবং নিউইয়র্ক টাইমসের মূল্যায়নে একটি ‘বেস্ট-সেলার’ হিসেবে স্বীকৃত ‘Palestine-Peace not Apartheid’ (প্যালেস্টাইন: শান্তি, কিন্তু বর্ণবাদ নয়) কার্টারের রচিত বইয়ে তিনি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ করেছেন—ইসরায়েল অধিকৃত পশ্চিম তীরে এবং গাজায় ইসরায়েলের অনুসৃত নীতি সম্পূর্ণভাবে বর্ণবাদের শামিল। বেতারে ঘোষিত তার বিশ্লেষণে তিনি বলেছেন, ইসরায়েল অনুসৃত বর্ণবাদ নীতিমালা দক্ষিণ আফ্রিকার চেয়েও নিন্দনীয় ছিল। তিনি বলেন, যখন ইসরায়েল (প্যালেস্টেনীয়) ভূমি অধিকার করে পশ্চিম তীরের গভীরে প্রবেশ করে দুইশ বা ততোধিক অন্যায়ভাবে স্থাপিত বসতির সঙ্গে পারস্পরিক যোগাযোগের জন্য স্থায়ী সড়ক নির্মাণ করে, তখন তো তা দক্ষিণ আফ্রিকার গণপৃথকীকরণ ও বর্ণবাদের চেয়েও নিকৃষ্টতর হয়ে দাঁড়ায়। তার দৃঢ় অভিমত ছিল, যতদিন পর্যন্ত না ইসরায়েল অধিকৃত প্যালেস্টাইনের ভূমি থেকে সরে না যায়, ইসরায়েলে কখনো শান্তি প্রতিষ্ঠা হবে না। তিনি আরও বলেন, এ এলাকায় শান্তি প্রতিষ্ঠাই আমার জীবনের সর্বোচ্চ ব্রত। ২০১০ সালে প্রকাশিত তার আরেকটি গ্রন্থে তিনি বলেন, মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রধান অন্তরায় হচ্ছে অধিকৃত এলাকা এবং বসতি স্থাপন পরিত্যাগ না করার জন্য ইসরায়েলের অনীহা।

প্রেসিডেন্সি-উত্তরকালে কার্টার বিভিন্ন দেশে প্রচুর ভ্রমণ করেছেন। রাজনীতিক সাংঘর্ষিক অবস্থাজনিত উত্তেজনা নিরসন এবং দুস্থ মানবতার সেবা-বৈষম্যবিরোধী কাম্য ক্রম এ-ই ছিল তার মুখ্য উদ্দেশ্য। ১৯৮৬ সালের ১ নভেম্বর তিনি দুদিনের সফরে ঢাকা আসেন। তৎকালীন রাষ্ট্রপতি এরশাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ ছাড়াও তিনি একটি গ্রামীণ স্বাস্থ্য উন্নয়ন কর্মসূচির সূচনা মানসে এক প্রটোকল স্বাক্ষর করেন এবং স্ত্রী রোজালিন কার্টার সমভিব্যাহারে একটি নৌবিহারে যান। নদীর পার্শ্ববর্তী অধিবাসীদের জীবনাচরণ নিরীক্ষণ ছিল তাদের নৌবিহারের মুখ্য উদ্দেশ্য। কার্টার ছিলেন একজন বিনয়ী, মর্যাদাবান, পুরোদস্তুর ভদ্রলোক। তার ভ্রমণ সফল করতে যারাই সহায়তা করেছিলেন, তাদের প্রতি ছিল তার সকৃতজ্ঞ আচরণ। স্মারক হিসেবে তিনি আমাকে ছোট নোটসহ স্বাক্ষরিত ফটোও প্রেরণ করেন।

আমাদের মনে থাকতে পারে যে, কার্টার সেন্টারের পক্ষ থেকে ওয়াশিংটনভিত্তিক ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ইনস্টিটিউটের উদ্যোগের ফলশ্রুতিতে ২০০১ সালের আগস্টে দুই রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী দল—বিএনপি এবং আওয়ামী লীগ একটি গণতান্ত্রিক শান্তিপূর্ণ সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠান প্রচেষ্টার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কার্টার সেন্টার বাংলাদেশে কতিপয় উন্নয়নমূলক প্রজেক্টের সূচনা করে। এর মধ্যে একটি ছিল বাংলাদেশি এনজিও মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের সহযোগিতায় নারীর তথ্য অনুসন্ধান অধিকার প্রতিষ্ঠার বাস্তবায়ন।

একজন সহযোগী নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজেতা প্রেসিডেন্ট কার্টারের প্রয়াণে প্রধান উপদেষ্টা ও সরকারপ্রধান অধ্যাপক ইউনূস গভীর শোক ও সমবেদনা জানিয়ে বলেছিলেন—নারীর ক্ষমতায়ন, সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও গণতন্ত্রের অগ্রগতির নিশ্চিতকরণ প্রচেষ্টায় কার্টার সেন্টারের সহযোগিতামূলক উদ্যোগ বাংলাদেশের প্রতি কার্টারের গভীর নৈকট্য ও মমত্ববোধেরই স্বাক্ষর বহন করে।

আজ যখন প্রায় সারা বিশ্বেই আমরা প্রত্যক্ষ করছি কর্তৃত্ববাদী, ন্যায়নীতিহীন, সাম্প্রদায়িক, সম্প্রসারণবাদী, বিচারহীনতা দুষ্ট দাম্ভিক ক্ষমতাধরের উত্থান, সেখানে কার্টারের মতো একজন নীতিনিষ্ঠ, মানবতা-দরদি, বৈষম্যহীনতা ও শান্তি প্রতিষ্ঠায় নিবেদিতপ্রাণ নেতার অনুপস্থিতি গভীরভাবে অনুভব করি।

কার্টারের মতো নেতারাই শুধু একটি জাতিকে মহান করে তুলতে পারেন—করতে পারেন বিশ্বকে সভ্য মানুষের বাসযোগ্য করে তোলার মহান প্রচেষ্টা।

লেখক: সাবেক সচিব

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

মওলানা ভাসানী সেতুর স্বপ্নযাত্রা শুরু

বিএনপি কর্মীদের নিয়ে দীর্ঘ স্ট্যাটাস দিলেন জয়

খাঁচায় বন্দি রেখে পাখি পালন করা কি জায়েজ আছে?

সাবেক স্ত্রীকে হত্যার পর যুবকের কাণ্ড

বিএনপির ৪৭তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর সপ্তাহব্যাপী কর্মসূচি ঘোষণা

নদীতে ভাসছিল নিখোঁজ চালকের মরদেহ, উধাও অটো

টাইফয়েড টিকার রেজিস্ট্রেশন মোবাইল থেকে যেভাবে করবেন

দুদকের দুই উপ-পরিচালক বরখাস্ত

দলের স্বার্থে খেলে কপাল পুড়ল দুই ক্রিকেটারের, দাবি অশ্বিনের

মহাখালীর সাততলা বস্তিতে ভয়াবহ আগুন 

১০

আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর ১২টা হাতি মরে গেছে : রিজওয়ানা

১১

প্রকাশ্যে ব্যবসায়ীকে কুপিয়ে হত্যা

১২

ঢাবির ১৮ হল সংসদের প্রার্থী ঘোষণা ছাত্রদলের

১৩

স্টার্টআপে বিনিয়োগ ও পরামর্শ দেবে কমিউনিটি ব্যাংক

১৪

মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ

১৫

কুমিল্লায় ৫২টি পাসপোর্টসহ দালাল আটক

১৬

টাকা ছাড়াই খাওয়া যায় যে ক্যাফেতে, দিতে হবে প্লাস্টিক বর্জ্য

১৭

বঞ্চিত কর্মকর্তাগণের আবেদন পর্যালোচনা কমিটির ২য় প্রতিবেদন পেশ

১৮

হাসপাতালে গিয়ে মির্জা ফখরুলকে পেলেন না জামায়াতের প্রতিনিধিদল

১৯

দূরশিক্ষা ও বিজ্ঞানের মহীরুহ ড. শমশের আলীর মহাপ্রস্থান : এক জ্ঞানতাপস

২০
X