কাজী বনফুল
প্রকাশ : ১৮ জানুয়ারি ২০২৫, ০৩:০৪ এএম
আপডেট : ১৮ জানুয়ারি ২০২৫, ০৭:৪৩ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

সবাই এখন ফেসবুক বিদ্যালয়ের ছাত্র

সবাই এখন ফেসবুক বিদ্যালয়ের ছাত্র

সেদিন এক লোক অন্য এক লোককে ডেকে বলছে, ভাই আমার ফোনের ফেসবুক টিপিটা একটু চালু করে দেন তো। এহানে নাকি সব পাওন যায়, সব দেহুন যায়। সবাই খালি ফেসবুক দ্যাহে, আমিও দেহুম ভাই। আমার ফেসবুক টিপিটা একটু চালু করে দেন। ফেসবুক চালু করার পর সেই লোক বাকি সব কাজ বাদ দিয়ে সারাদিন এখন শুধু ফেসবুকের গায়ে ভেসে থাকা মিথ্যা বানোয়াট খবর, ভিডিও দেখে আর মানুষকে ডেকে ডেকে সেই ফেসবুকের খবর শোনায়—অমুক পাতার রস খেলে তো তমুক রোগ উধাও হয়ে যায়, পৃথিবীতে নাকি নতুন সব দৈত্য আসতেছে এক মাসের ভেতর পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে আরও কত গল্প।

এভাবে একটা শ্রেণির ভেতর এমন সব বানোয়াট গল্প ও গুজব মহামারির মতো দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। আগের দিন মানুষের মুখে মুখে ভর করে কোনো স্বাভাবিক ঘটনা রটতে রটতে এমন জায়গায় গিয়ে পৌঁছাত, যার সঙ্গে মূল ঘটনার কোনো ধরনের মিল খুঁজে পাওয়া যেত না। সেই একই প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন স্বাভাবিক ঘটনা এখন রং-চং মাখিয়ে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে ফেসবুকের মাঠে। সেই ফেসবুক গ্যালারিতে আছে লাখ লাখ কোটি কোটি দর্শক। যাদের কাজই হচ্ছে সারাদিন ফেসবুকের ভিডিও দেখা এবং সেগুলোকে কোনো ধরনের বিচার বিবেচনাহীনভাবে শেয়ার করা। ভিউ ব্যবসায়ী ও শেয়ার ব্যবসায়ীরা খুব ভালোভাবেই জানে ফেসবুকে কোন জিনিস কীভাবে ছাড়লে সেটা শেয়ার ও ভিউয়ার হবে সর্বোচ্চ। তাই তারা আবার ভিডিওর ওপর লিখে দেয় আপনি যদি এ ভিডিওটি দেখামাত্র শেয়ার না করেন, তাহলে আপনার ওপর অমুক গজব পড়বে, অমুক ক্ষতি হবে। সাধারণ মানুষ স্বাভাবিকভাবে ভীতু ও কুসংস্কারগ্রস্ত হয়ে থাকে। আর সঙ্গে সঙ্গে শেয়ার হয়ে যায় লাখ লাখ। এভাবেই হাজারো মিথ্যা তথ্য, মিথ্যা বানোয়াট খবর ছড়িয়ে পড়ছে ফেসবুকের রঙিন পাতাজুড়ে। তারপর মানুষ থেকে মানুষে সমাজ থেকে সমাজে সর্বত্র।

আমাদের অঞ্চলে ছোট বাচ্চা থেকে বুড়ো সবাই এখন বুঝে না বুঝে ফেসবুক অ্যাকাউন্টের মালিক। তারা যখন যা ইচ্ছে ফেসবুকে ছাড়তে পারে, শেয়ার করতে পারে। মানুষকে দেখাতে পারে যে কোনো কিছু, নানান আবর্জনা কুড়িয়ে কুড়িয়ে ভরে তুলছে ফেসবুক অ্যাকাউন্টের বেহিসাবি ঘর।

বাংলাদেশের সর্বত্র এখন ফেসবুকের কালো চাদরে ঢেকে গেছে। ফেসবুকে ভেসে বেড়ানো সব পচা-গলা, নষ্ট মাছদের মানুষ গ্রহণ করছে তাজা ও ভালো মাছ হিসেবে। সবাই গো-গ্রাসে ভক্ষণ করছে ফেসবুক থেকে কুড়ানো নষ্ট, পচা মিথ্যা মাছদের। ফেসবুকের নদীতে যারা এখনো সাঁতার কাটতে ব্যর্থ হয়েছে, সমাজ তাদের আনস্মার্ট ও পিছিয়ে পড়া মানুষ হিসেবে বিবেচনা করছে। সবাই ফেসবুকের নদীতে গা ভাসিয়ে ভেসে চলছে দিগন্তহীন অগন্তব্যের পথে। কোথায় যাচ্ছে, কোন দিকে যাচ্ছে এবং এর ভবিষ্যৎ কোথায়, ফিডব্যাক কী, ভবিষ্যৎ আউটপুটইবা কী—তা সম্পর্কে কারও কোনো ভাবনাচিন্তা নেই; শুধু হা হা-হো হো করতে করতে সবাই ভেসে চলছে ফেসবুক নদীতে।

উন্নত দেশগুলোর দিকে তাকালে দেখা যায় তাদের ফেসবুক কার্যক্রম অত্যন্ত সীমিত ও সীমাবদ্ধ। তাদের জীবন ফেসবুকের চার দেয়ালে বন্দি নয়। ফেসবুকের বাইরেও যে জীবন রয়েছে, সেটা সম্পর্কে তাদের ধারণা সুসমৃদ্ধ। তাদের জীবনের স্পেসিফিক মূল্য আছে। জীবনের মূল্যবান সময়কে তারা ফেসবুকের পচা খাতায় বিলিয়ে দিতে আসেনি, তারা নিজেদের জীবনের মূল্যবান সময়কে খুব হিসাব করে খরচ করে। মেটার সর্বোচ্চ ফেসবুক ব্যবহারকারী দেশের মধ্যে বাংলাদেশ নাম শীর্ষে রয়েছে। কারণ বাংলাদেশের মানুষের জীবনের সময়ের হিসাব নেই। নিজেদের ফেসবুক নামক আত্মমৌহিক জালে আবদ্ধ করে রেখেছে তারা। তাদের জীবন কখন যে এই ফেসবুক নামক বাঁকা বড়শিতে এমন পোক্তভাবে গেঁথে গেল, আমরা তা ধরতেই পারিনি। ফেসবুক আমাদের এখন ভাত আর মাছের মতো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। ফেসবুক ছাড়া আমরা চলতে পারি না, হাঁটতে পারি না, গল্প করতে পারি না, খেতে পর্যন্ত পারি না—সবকিছুর ভেতর ফেসবুক ঢুকে গেছে। সবকিছুর ফাঁকে ফাঁকে আমাদের ফেসবুকে উঁকি মারতে হয়। আমাদের এখন আমাদের সঙ্গে কোনো গল্প হয় না, যেটুকু হয় ওই ফেসবুকের তৈলমর্দনকূপ নামক কমেন্ট বক্সে আর আবেগে জড়ানো কালো কালির চিঠি ধ্বংসকারক মেসেঞ্জারে। আমরা আমাদের থেকে ক্রমান্বয়ে দূরে সরে যাচ্ছি, ক্রমাগত তলিয়ে যাচ্ছি অন্ধকারের অতল গহ্বরে। ফেসবুকের রঙিন আলো আমাদের চুষে চুষে অমানবিক, নিষ্ঠুর, রোবোটিক কৃত্রিম মানুষে পরিণত করছে। সামাজিক যোগাযোগের নামে আমাদের করে তুলছে চরম অসামাজিক, হিংস্র ও দুঃখী মানুষ।

আমরা এখন সবাই ফেসবুক বিদ্যালয়ের ছাত্র। আমাদের স্কুল, কলেজ, বিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় সবকিছুই এখন হয়ে উঠছে আমাদের এ ফেসবুক। ফেসবুকে সারাক্ষণ যা দেখি, যা পড়ি, সেটাই আমরা ধারণ করছি, উগড়ে দিচ্ছি সর্বত্র। আমাদের মস্তিষ্কের গুরুত্বপূর্ণ লকারে জমা হচ্ছে ফেসবুকের বাসি, পচা অজ্ঞানতার স্তূপ। প্রয়োজন অনুসারে সেখান থেকে আবার উগড়ে দিই ফেসবুকের সাদা ফাঁকা স্ক্রিনের দেয়ালে। ফেসবুকের ননস্টপ স্কুলের সারাক্ষণের ছাত্র আমরা। আমাদের এই স্কুলের কোনো ছুটি নেই, এখানে সবাই ছাত্র, সবাই শিক্ষক এবং কেউ কেউ অতিশিক্ষক। সবাই উপদেশ আর জ্ঞান বিতরণের ফ্রি চাকরি করেন এখানে। এত এত জ্ঞানের দহনে চারপাশে জ্ঞানের ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন মানুষ। কেউ আর কিছু দেখছে না, চারপাশ ধূমায়িত অন্ধকারে ঢেকে যাচ্ছে।

সেদিন একটা বাচ্চাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম কোন ক্লাসে পড়ো। সে আমাকে উত্তরে বলল, ক্লাস ফিলাস বাদ দেন; ফেসবুকেই এখন সব পাওন যায়। এখন আমরা পড়ালেখা ফেসবুকেই করি। কী জানতে চান কন, সব উত্তর রেডি। আমি বললাম, বাহ এই না হলে সোনার ছেলে। এই নাউ তোমার জন্য এই চকলেট। খুব শুদ্ধ করে বাচ্চাটা ইংরেজিতে ধন্যবাদসমেত কী যেন দুই লাইন শুনিয়ে দিল আমাকে। ফেসবুকের কল্যাণে এখনকার বাচ্চারা ক্লাস ওয়ান থেকে শুরু করে অনার্স-মাস্টার্স, ডিগ্রি সব একসঙ্গেই করতে পারে। সেদিন দেখলাম এক বাচ্চা তার শিক্ষককে অপদস্থ করার জন্য দলবল নিয়ে ঘুরছে কখন তাকে বাগে পাওয়া যায়। কারণ হিসেবে যেটা জানা গেল সেই শিক্ষকের অপরাধ হচ্ছে—তিনি কেন তাকে ক্লাসের ভেতর ফেসবুক ব্যবহার করতে নিষেধ করলেন। আর এ কারণেই শিক্ষককে অপদস্থ করার জন্য তারা অপেক্ষা করছে।

ফেসবুক আমাদের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব একযোগে পালন করছে এতে কোনো সন্দেহ নেই। ফেসবুক বিদ্যালয়ের সাদা ব্ল্যাকবোর্ডে আমরা যখন যা ইচ্ছে তাই লিখতে পারি, যখন যা ইচ্ছে প্রকাশ করতে পারি। অন্যের লেখা উল্টেপাল্টে নিজের নামে চালিয়েও দিতে পারি। ফেসবুক জুড়ে পণ্ডিত, দার্শনিক, উপদেশদাতা, উপদেশ বিক্রেতার ছড়াছড়ি। এত এত জ্ঞানী বিজ্ঞানীতে ভরপুর আমাদের ফেসবুক, যা পৃথিবীর আর কোথাও এমন সমাহার একসঙ্গে দেখতে পাওয়া অসম্ভব। এদিক দিয়ে অবশ্যই আমরা যে কোনো দেশকে বিট করতে সক্ষম।

একটা সময় ছিল যখন সন্ধ্যা বা সকাল হলেই চারপাশ থেকে ভেসে আসত কবিতা পড়ার সুর। চারপাশ গমগম করত আগামীকালকের পড়া তৈরি করার সুরে। সন্ধ্যা হলে আশপাশের বাড়িগুলোতে মায়েরা চিৎকার-চেঁচামেচি করে সন্তানকে পড়ার টেবিলে বসানোর জন্য হৈচৈ শুরু দিত। চারপাশের বাড়িঘরগুলো পরিণত হতো এক-একটা গৃহবিদ্যালয়ে—‘আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে’, ‘মনারে মনা কোথায় যাস বিলের ধারে কাটবো ঘাস’—আরও কত ছড়া-কবিতা এখনো স্মৃতির সন্ধ্যায় চারণকালে কল্পনার কর্ণমূলে ভাসে।

বাচ্চাদের হাতে এখন স্মার্টফোন। তারা এতটুকু বয়সেই খুলে ফেলেছে ফেক আইডিসহ তিন-চারটি আইডি। সেদিন একজন বলল, সে একসঙ্গে পাঁচটা ফেসবুক আইডি চালায়, নামে-বেনামে। আমি বললাম, এতগুলো আইডি দিয়ে কী করা হয়? সে বলল, ট্রেন্ড বস—ট্রেন্ড।

আমরা যে ট্রেন্ডের পথে এগিয়ে চলছি তা কোনোভাবেই সঠিক ও সামগ্রিক কল্যাণকর নয়। আমাদের ফেসবুক নামক কণ্টকী ফল সমগ্র চিত্রকে মদবিহ্বলতায় জাপটে ধরেছে। আমরা যদি এখনো এই বিষ-বিষাদের তেতো ভবিষ্যতের বিষক্রিয়া সম্পর্কে অনুধাবন করতে না পারি, তাহলে আমাদের সর্বনাশ কেউ ঠেকাতে পারবে না।

লেখক: প্রাবন্ধিক

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

কুলাউড়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স / রোগীদের নিম্নমানের খাবার দেওয়ার অভিযোগ

কলম্বোতে টস জিতে ব্যাটিংয়ে বাংলাদেশ, একাদশে ফিরেছেন মিরাজ

বিএনপি নেতার বিরুদ্ধে হাওরে হাউসবোট দখলের অভিযোগ 

বৃহস্পতিবার শুরু এইচএসসি, অংশ নিচ্ছে ১২ লাখ শিক্ষার্থী

অতর্কিত হামলায় ইসরায়েলের ৭ সেনা নিহত

দুদক সচিব খোরশেদা ইয়াসমীন ওএসডি

লাল ডিম না সাদা ডিম, কোনটির পুষ্টিগুণ বেশি

ভুয়া খবর ছড়াচ্ছে দুটি সংবাদমাধ্যম, ট্রাম্পের ক্ষোভ

মার্কিন গোয়েন্দা প্রতিবেদন / বাঙ্কার বাস্টারেও ধ্বংস হয়নি ইরানের পরমাণু কেন্দ্র

ইরানে ফের হামলার চেষ্টা, ইসরায়েলি ড্রোন ভূপাতিত

১০

রাজশাহী মহানগরীর থানা-ওয়ার্ড যুবদলের কমিটি গঠনে সতর্ক চিঠি

১১

ভুল রক্ত পুশ করায় মৃত্যুর মুখে রোগী, পাশে দাঁড়ালেন ইউএনও

১২

একযোগে ৩৩ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রদলের কমিটি ঘোষণা

১৩

চিনি খেলে কি ডায়াবেটিস হয়? কী বলছেন বিশেষজ্ঞরা 

১৪

খামেনির বিপদ কাটেনি, সামাল দিতে হবে নিজ জাতির ক্ষোভ

১৫

ইরানে যুদ্ধের অবসান : তেহরানের বর্তমান পরিস্থিতি

১৬

মাঝ নদীতে ভাসছিল ৪০ যাত্রীসহ ট্রলার, এরপর যা ঘটল

১৭

বিএনপিতে দখলবাজ নেতাকর্মীর স্থান নেই : মিফতাহ্ সিদ্দিকী

১৮

সংবাদ প্রকাশের জেরে সাংবাদিককে কুপিয়ে জখম

১৯

ঢাকায় বৃষ্টি নিয়ে আবহাওয়া অফিসের নতুন বার্তা

২০
X