আমি দীর্ঘ সময় সিডনিতে বসবাস করি। কিন্তু কখনোই দেশছাড়া নই। তাই আমি জানি, এ কথা মানতেই হবে আমাদের তারুণ্য মেধাবী। তাদের মেধা আর শ্রম এক হলে যে বড় বড় কাজ হয়, তা বলাই বাহুল্য। রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ সব মিলিয়ে তারুণ্যের জয়জয়কার হলেই দেশ এগিয়ে চলে। আমরা যারা দেশের বাইরে থাকি আমাদের জানা আছে, তারুণ্য কীভাবে শ্রমমুখী আর কর্মনিষ্ঠ হয়। যখন আমি প্রথম এ দেশে আসি তখন আমার যৌবন প্রায় নিভু নিভু। কিন্তু তারুণ্য ছিল মনে। সে তরুণ চোখে আমি যা দেখেছি বা জেনেছি, তার মূল্য অপরিসীম। বহু বছর আগে সিডনি এসে প্রথম যে অনুভব, তা ছিল দেশ আর মা-বোনসহ বন্ধুদের মিস করা। আর একটা কথা বলতেই হবে, শুধু মানুষ নয়; আমি ঘরের দরজা বন্ধ করে চট্টগ্রামের জন্য কান্নাকাটি করতাম। এই যে মায়া, এর নাম দেশপ্রেম কি না জানি না; কিন্তু এই মায়া আমাদের দেশের বড় সম্বল। সম্বল বা ভালোবাসার এই দান আমাদের জনগোষ্ঠীকে মায়ায় বেঁধে রেখেছে। আজকাল সেটা কিছুটা কম বোঝা গেলেও এটাই সত্য।
ছাব্বিশ বছর আগে এক ভোরবেলা এ দেশের মাটিতে পা রেখেছিলাম। ট্যাক্সিতে চড়ে যাওয়ার সময় ছবির মতো বাড়িঘর, সামনে বাগান, সারি সারি বৃক্ষ ও সাজানো রাস্তাঘাট দেখে মনে হচ্ছিল—আমি কোনো সিনেমার শুটিং স্পটে এসেছি। টালির ছাউনি, মসৃণ রাস্তাঘাট পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। যত মানুষ তার তিনগুণ বাড়িঘর।
তারপর কত জল গড়াল। এসেছিলাম অভিবাসন নিয়ে। দুই বছর পর নাগরিক হলাম। জন্মভূমি ও ক্যাঙারুর দেশের দ্বৈত নাগরিকত্ব থাকায় সানন্দে তা নিয়েছি। এর সুদিকটা হলো—পৃথিবীর বহু দেশে বিনা ভিসায় ঝামেলামুক্ত ভ্রমণ, নীল পাসপোর্টের খাতির বা সন্দেহের চোখে না তাকানো। কুদিকও আছে। নাগরিক মানে ভোটার। আর ভোট না দিলে মোটা অঙ্কের ডলার জরিমানা।
শুরুতে ঠিক বুঝতে পারছিলাম না, কী জাতীয় চাকরি পাব। কঠিন শারীরিক কাজ বা তেমন কিছু পারব না, এটা জানতাম। কয়েক মাসের ভেতরেই চাকরি পেলাম ব্যাংকে। দেশের অভিজ্ঞতায় বুক দুরুদুরু করত। ইউনিয়ন যদি বদলি করিয়ে দেয় কালো চামড়া বলে কিংবা বড় সাহেবের বদ নজরে পড়ে যদি কিছু হয়? দেখি পুরা বিপরীত। এরাই বলছে তুমি কিন্তু এ এলাকার বাইরে কোনো অফিসে যাবে না কোনোদিন। রিজিওনাল কর্ত্রী এসে চুপটি করে পেছনে দাঁড়িয়ে থাকে কখন হাতের কাজ সেরে তার সঙ্গে দুই মিনিট কথা বলা যাবে। বেশিরভাগ সময়ই তা ছিল সুখবর কিংবা অভিনন্দন জাতীয় আলাপ। একসময় দেখি তারাই জোর করে পদোন্নতি দেয়। মনোজাগতিক দুর্বলতা কাটতে কাটতে একসময় সেবা উপদেষ্টার কাজও করে ফেললাম। সতেরো বছর পর অর্ধ অবসরে এসে ভাবলাম, কিছু তো করা উচিত। অনেকটা যেচেই চাকরি দেওয়া হলো পরীক্ষকের। লেখাপড়া সংশ্লিষ্ট এমন কাজের প্রতি চিরকালের লোভ। তা-ও আবার বিশ্ববিদ্যালয়ের। সঙ্গে জুটল ইংরেজি পরীক্ষা আয়োজন ও পরীক্ষকের কাজ।
আমার ছেলে এদেশে এসেছিল তার শিশুকালে। একদিন স্কুলে না যাওয়ার জন্য কান্না, অর্কের ভয় ছিল ভাষার। পরে ও তাদের ইংরেজি পড়িয়েছে। নিজের ইচ্ছামতো অভিনয় জগৎ বেছে নিয়ে এ দেশের প্রথম এশিয়ান তরুণ ও বাংলাদেশি হিসেবে হলিউড মুভিতে অভিনয় করেছে। এখানকার প্রধান রাজনৈতিক দল লিবারেল ও লেবর উভয় দলই সম্মান জানিয়েছে তাকে। এবার অস্ট্রেলিয়া ডে উদযাপনে অর্ক রয়েছে বিচারকের আসনে। সিডনি শর্টফিল্ম ফেস্টিভ্যালের জুরিও হয়েছে।
এই দেশের নামের অর্থ মিলনস্থল। এই অস্ট্রেলিয়া নামটি এসেছে অ্যাবরজিনাল বা আদিবাসীদের কাছ থেকে। ৫০ হাজার বছরেরও অধিক যাদের ইতিহাস বলে দাবি করা হয়, তারা অবশ্য ভাষা লুপ্ত এক জনগোষ্ঠী। তাদের ভাষা কেড়ে নেওয়া হয়েছে। ইংরেজরা জানত কোন দেশে থাকা যাবে, কোন দেশে শাসন করে তারপর ফিরতে হবে। সেভাবেই সেসব দেশকে গড়ে তুলত, সাজাত বলে অস্ট্রেলিয়া হয়েছে ইংল্যান্ডের মতো। এটাও ঠিক, তারা এসেছিল আর সেভাবে গড়ে তুলেছে বলেই আমরা সবাই এসেছি। নানা কারণে বসত গেড়েছি।
পৃথিবীর মানচিত্রে ছোট মহাদেশের বড় দেশ। এটাও দেখেছি কথায় না কাজে; কতটা মানবিক, কতটা উদার দানে। যে পরিমাণ ডলার মানুষ দান করে, তা ভাবাও কঠিন। আজ বেড়াতে এসে এমন এক রেস্তোরাঁয় খেলাম, যারা একটি মিল বিক্রি করলে একজন অভুক্ত মানুষের খাবারের টাকা দেয় মুনাফা থেকে। এ পর্যন্ত ৬ কোটিরও বেশি মানুষকে খাবার জুগিয়েছ ওরা। যে কোনো কাজে ভলনটিয়ার বা স্বেচ্ছাসেবক হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী থেকে সাধারণ মানুষ। নিজের জীবন তুচ্ছ করে কোয়েলা ক্যাঙারুর বাচ্চা বুকে নিয়ে ছোটে নারী। এমন মমতা বিরল। আমার মতো ঠোঁট কাটা মন খুলে কথা বলা মানুষের বড় বিপদ। বাংলাদেশের সমাজ ও রাজনৈতিক জীবনে পদে পদে ভয় ও অপমান। এদেশ তা থেকে মুক্ত রেখেছে আমাকে। এখানেও বাঙালির নিচুতা যায়নি। তবে তাদের আপনি অনায়াসে এড়িয়ে বলতে পারেন,
‘মেঘেরা যা খুশি লিখে রেখে যাক
আকাশের গায়ে কখনো লাগে না দাগ।’
কোনো তদবির বা যোগাযোগ ছাড়াই আমি পেয়েছি প্রথমবারের মতো আদিবাসী ও বহুজাতিক পদক।
এই কথাগুলো বললাম। কারণ, আমাদের দেশের সমাজ ও জীবন যেন গণতন্ত্র বহুজাতিকতা আর সর্বজনীনতা থেকে কিছু শিখতে পারে। আমি এ কথা জোর গলায় বলতে পারি—আমরা পারি। আমি বহু বছর দেশ ছেড়ে এলেও দেশ বা জাতির সঙ্গে আছি, থাকি। তাই আমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারি, সাময়িক সব বাধা পেরিয়ে একদিন তারুণ্য এ দেশকে মুক্তিযুদ্ধ ও পরবর্তী সময়ের সব সংগ্রাম নিয়েই এগোবে। একনায়ক বা ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে সে সমাজ, তার পথে কাঁটা থাকলেও তা একসময় দূর হবেই।
এখন বাংলাদেশের সামনে নতুন সম্ভাবনার যে হাতছানি, তা আগেও এসেছিল। কিন্তু তার ব্যবহার করা হয়নি। একসময় উন্নয়ন আর সংহতিও প্রশ্নবোধক হয়ে যায়, যদি জনগণের অংশগ্রহণ না থাকে। সেই গণতন্ত্রই হচ্ছে আধুনিক রাষ্ট্রের ভিত্তি। যেসব দেশ বা সমাজকে আমরা গণতন্ত্রের সমাজ বা দেশ বলে জানি, তাদের বাইরে-ভেতরে বহুজন মতবাদ আর সবার জন্য সবকিছু এই নিয়ম থাকে। আশা করি আমরাও সেই পথে অগ্রসর হবো। সবাইকে অস্ট্রেলিয়া ডের অগ্রিম অভিবাদন।
লেখক: অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী ছড়াকার ও কলামিস্ট